• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে সম্বুদ্ধ সান্যাল (পর্ব – ৪)

এবং সপ্তেন্দ্রিয়…

“বললামই তো ওই রাখ, আর কিছু দিতে পারব না। এখন এস তো।”
“না, মানে যদি আর কিছুটা এগিয়ে দিতেন তবে বড় ভালো হত।”
“এখন ওই রাখ তো। পরে আবার এস, তখন দেখা যাবে।”
“আসলে আমার আর পাঁচ হাজার টাকারই দরকার ছিল। সাড়ে ছ’শ টাকা নিয়ে কী হবে বলুন?”
“দেখ, বেশি ভ্যান্তারা কোরো না। যা পেরেছি, দিয়েছি তো। আবার কী? এখন যাও দেখি। বেলা বাড়ছে, স্নানে যেতে হবে। আবার পরের সপ্তাহে এস। তখন যা পারব, দেব।”
“এখন আমি কোথায় যাই। বাকি টাকাটা আমার আজকেই দিতে হবে…”
“আবার নাকে কাঁদছ কেন। কাকে দেবে কী দেবে তোমার সমস্যা। আমি যতটুকু পেরেছি, দিলাম তো। আবার কী? এখন যাও দেখি। মাথাটা ধরিয়ে দিল। যত্তসব…!”
বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফিরে এলাম। গত তিন মাসের ইলেকট্রিক বিল বাকি। এবার গরমে এসিটা আর না কিনে পারিনি। নন্দিনীর গরম লাগে। একজন সাধারণ কবির পক্ষে যেটুকু সম্ভব, তাই জমিয়ে না হয় এসিটা কেনা গেল। কিন্তু নিয়মিত সারাদিন চলায় যা হওয়ার, তাই হয়েছে। তিন মাসে তেরো হাজার টাকা বিল। আমার মাথায় হাত। সাপ্লাই থেকে হুমকি দিয়েছে লাইন কেটে দেবে বলে। কাল পরশুই এসে পড়বে সব। তাই সকাল সকাল কিছু টাকার জোগাড় করতে বেরিয়েছিলাম। সাকুল্যে সাড়ে ছ’শ টাকা নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই নন্দিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার উপরে, “সংসারের প্রয়োজনটুকু মেটাতে পার না আবার বিয়ে কর কেন? এখন কে দেবে এই টাকা? আমি কিচ্ছু জানি না। এসি না হলেই ফ্যানই চলবে আমার। ঘর করেছি এটুকু মেনে নিতে পারব। তবে তোমার জন্য পাখা বন্ধ করে বসে থাকতে পারব না। এখন টাকা কীভাবে জোগাড় করবে, কোত্থেকে জোগাড় করবে তোমার ব্যাপার।”
“মানে, আমি সুকেশবাবুর কাছে গেলাম তো। উনি এর বেশি দিতে না পারলে আমি কী করব? তুমি এই মাসের মতো তোমার মায়ের থেকে চেয়ে একটু ম্যানেজ করে দাও, পরের সপ্তাহে উনি দিলেই আমি ফেরৎ দিয়ে দেব।”
“শেষে মায়ের থেকে টাকা চাইব আমি? ভগবান, এ কোন ভিখারিকে আমার ঘাড়ে জোটালে!”
আমি ভিখারি নই, একজন সামান্য কবি মাত্র। ছোট পত্রিকায় কিছুটা জনপ্রিয়। মাঝেসাঝে এদিক ওদিকের পত্রিকায় কিছু লেখা ছেপে বেরোয়, সামান্য আয়। সংসারের বাকিটা এদিক ওদিক করে জুটে যায়। তবে এতক্ষণ যা বুঝলেন, তেমন অভাব আমার সংসারে নেই। উপরোক্ত সমস্ত কথা আমার বিধির বিধান, নিয়তি। সমস্যাটা আর কিছুই নয়, সুকেশবাবু বছর তিনেক আগে আমার থেকে হাজার বিশেক টাকা ধার নিয়েছিলেন। সেই তাগাদাই করতে গিয়েছিলাম শুধু।
ক’দিন আগেও সুকেশবাবুর ব্যবহার এমন ছিল না। যখন প্রথম প্রথম টাকা ধার নিলেন, তখন তার অমায়িক আচরণের কথা আমি ভুলব না। নন্দিনীর সুকেশদাকে আমার প্রথমবারেই ভীষণ ভালোই লেগেছিল। সম্পর্কে তার মাসির ছেলে। কাছাকাছিই থাকেন। বছর চারেক আগে হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। নন্দিনীর সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ নেই। একদিন সকালে দেখি জলভরা সন্দেশের প্যাকেটসমেত আমাদের বাড়িতে হাজির। পরিচয় দিতেই নন্দিনী ‘ও মা, সুকুদা। এতদিন কোথায় ছিলে? কতদিন দেখিনি।’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুপুরে মটনের আয়োজনও হল, নন্দিনী নিজে হাতে রেঁধে খাওয়ালো তাকে। রাতে নিজেই একখানা ব্ল্যাক ডগ নিয়ে এসে সেদিন সন্ধ্যে জমিয়ে দিয়েছিল সুকেশদা। সত্যিই তো, খেতে হলে দামী জিনিস খাওয়া ভালো, নম্বর ওয়ান তো আকছার সবাই খায়।
মাস ছয়েক বাদে সুকেশদা আবার আমাদের বাড়িতে হাজির, এবার হাতে ওয়াইনের বোতল। শেষ করার পর উনি বাড়ি ফিরলে রাতে শোয়ার সময় নন্দিনী আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দেখলেই তো আমার মাসির ছেলেকে। মনটা বড় ভালো। যখনই আসে, কিছু না কিছু নিয়ে আসে। নিশ্চয়ই কোনও বিপদে পড়েছে। মাত্র তো বিশ হাজার টাকা। দিয়ে দাও, ঠিক ফেরত পেয়ে যাবে। আমাদের অত ছোট পরিবার নয় যে কথার খেলাপ করবে ও।”
এসিটা যখন কিনতে গিয়েছিলাম, তখন কবিতার অফ সিজন, গরমকাল। হাতে পয়সাকড়িও বেশি ছিল না। সব বন্ধুর বাড়িতে এসি আছে, নন্দিনীর নেই, ব্যাপারটা বড় দৃষ্টিকটু লাগছিল তার। অগত্যা আমাকেই উদ্যোগী হয়ে অতুলের বাড়িতে যেতে হল। অতুল আমার বাল্যবন্ধু, পয়সাকড়ি বা অন্য সমস্যায় পড়লে আমি তার দ্বারস্থ হই। বিচক্ষণ সংসারী ছেলে। আমার মতো উড়নচণ্ডী নয় বলে এই একমাত্র বন্ধুর সঙ্গ নন্দিনী সহ্য করে। সমস্যার উত্থাপন করতেই সে বলল, “ওসব ধার-টারের মধ্যে যাস না। নিবি তো ক্যাশে নিবি, রেলাই আলাদা। দোকানে বাকি করবি কেন?”
“না, মানে একবারে অত পয়সা পাব কোথায়। জমাতে জমাতে গরম পেরিয়ে শীত এসে যাবে যে। হাজার দশেক টাকা আছে হাতে।”
“তাতে কী? বুদ্ধি থাকলেই সব হয় ভাই। দাঁড়া, আমি আমার এক বন্ধুকে ফোন করে দিচ্ছি, অসুবিধা হবে না। আমাকে তো খুব হেল্প করে সবসময়। নিশ্চিন্তে থাক।” বলে হাতের মোবাইলে নম্বর ডায়াল করল, “ভাই পবন, বলছি যে একটা হেল্প করবি? আমার এক বন্ধু খুব বিপদে পড়েছে, এসি কিনবে। পুরো পয়সা হচ্ছে না। তোর নম্বর দিয়ে দিলাম, কথা বলে নিস।”
নম্বরটা দিতেই আলোচনায় জানলাম পবন একজন ফাইনান্স কোম্পানির এজেন্ট, ঘরোয়া সামগ্রী ফাইনান্স করে। জানতে পেরেই অতুলকে বললাম, “এ ক্যাশে কোথায় হল? ফাইন্যান্স তো। তুই যে বললি ধারে কিছু কেনা উচিত নয়।”
“তাতে কী? আর এটা ধার কোথায়, ফাইন্যান্স। দোকান তো ক্যাশ পেয়ে যাবে এদের থেকে, তোর বাপের কী? পরে আস্তে আস্তে প্রতি মাসে এর টাকা শোধ করে দিবি। মাত্র দশটা টাকা ইন্টারেস্ট, ওটুকু পারবি না?”
মাত্র দশ টাকা বেশিতে এত টাকার সংস্থান হওয়ায় বড়ই উৎসাহিত হয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম এসি কিনে। পরের মাসে মাথায় বাজ পড়ল, যখন দেখলাম দশ টাকা বেড়ে কখন যেন মাসে তিন হাজার টাকা ইন্টারেস্ট দাঁড়িয়েছে। গত এক বছর ধরে সেই টাকা ধীরে ধীরে নিয়মিত শোধ করার পরে এখন ইলেক্ট্রিক বিলের চাপ। কে বলবে কয়েকদিন আগে নন্দিনী আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল, “যাক, এতদিনে তাহলে এসির টাকা শোধ হল। এবার নিশ্চিন্তে খোলা মনে এসির হাওয়া খাওয়া যাবে।”
বুদ্ধদেব যখন সবেমাত্র বোধিপ্রাপ্ত হয়ে আধ্যাত্মবাদের চূড়ান্তে অবস্থান করছেন, তখন একবার তাঁর কাছের সহচর ধৌপিলকে ডেকে বললেন, “বুঝলে ধৌপিল, আমি এখন আধ্যাত্মবাদের চূড়ান্তে অবস্থান করছি ঠিকই, যোগ সাধনাতেও চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছি। আমার মন এখন জাপানের ন্যাশনাল হাইওয়ের মতোই সাফসুতরো। কিন্তু তবুও যেন মনে একটা খামতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিদ্রায় ঠিক তেমন আরাম নাই, আহারে ঠিক তেমন সুখ নাই। আমি অন্তর্মননে বিশ্লেষণ করে দেখেছি তা, তবে এর থেকে নিষ্ক্রমণের কোনও উপায় অদ্যবধি পাইনি। তুমি যদি কিছু সাহায্য কর।”
ধৌপিল সমস্ত সমস্যা পুনর্বার শুনে গভীর চিন্তান্বিত হয়ে জানালেন, “হে দেবাত্মন, আমার মনে হচ্ছে আপনি এতদিন গৃহের বাইরে থাকার দরুণ আপনার এই সমস্যা হচ্ছে। আপনি আজ রাতে নিদ্রামধ্যে কী ধরণের স্বপ্ন দেখছেন জানতে পারলে আমি হয় এই সমস্যা নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারি।”
“তোমার কীভাবে মনে হল যে আমার এই সমস্যা গৃহের বাইরে থাকার দরুণ হচ্ছে? গৃহ তো আমি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছি। সেই লিপ্সা থেকে আমি চিরমুক্তিপ্রাপ্ত।”
“হে জ্ঞানী সর্বজ্ঞ। আপনি হয়ত য়ুরোপীও দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের নাম শুনে থাকবেন।”
“ওরেবাবা, হ্যাঁ হ্যাঁ, তিনি তো মহা জ্ঞানী ব্যক্তি। কে কী ভাবছে ঝটাঝট নাকি ধরে ফেলেন। তা শোনাও দেখি তুমি কতদূর জান তাঁর সম্পর্কে।”
“হ্যাঁ জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ, আমি তাঁর ধারণা সম্পর্কেই আপনাকে আলোকিত করার চেষ্টা করছি। আশাকরি আপনি এই তত্ত্ব শুনলে সম্যক হয়ে উঠবেন। ফ্রয়েড বলেছেন আমাদের চেতন মন ও অবচেতন মন বলে মনের দুটি বিভাগ আছে। চেতন মন হল আমাদের যা করা কর্তব্য একজন মানুষ হিসেবে, অবচেতন মন হল যা করতে মন চায়, কিন্তু করতে পারি না। পশুদের সঙ্গে মানুষের এখানেই পার্থক্য। আপনি দৈবজ্ঞ, আপনি আপনার চেতন মনে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছেন। এখন আপনার পরীক্ষা শুধুই নিজের উপর। আপনি আধ্যাত্মবাদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছেন, তা জানার খিদে আপনাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে আপনারই অবচেতনে। এখন আপনার উচিত মনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেয়েছেন কিনা তা জানতে নিজগৃহে গোপাদেবীর কাছে ফিরে যান এবং বৎসরকাল সংসার করে দেখুন আপনার মন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে নাকি। আমিও ততদিনে য়ুরোপে আপনার দর্শন ছড়িয়ে দিয়ে আসি এবং সেখানে ফ্রয়েড সাহেবের কাছ থেকে আরও কিছু তত্ত্বাপোদেশ সংগ্রহ করে আনছি। যদি এই বৎসরকালান্তে আপনার মন বিচলিত হয়, তবে আপনার বোধিলাভ সম্পূর্ণ হয়নি বলে ধরে নেবেন, এবং আমিও সেই সময়ে ফিরে এসে আবার আপনাকে সঙ্গ দেব।”
এই আলোচনার পর বুদ্ধদেব কপিলাবস্তুতে ফিরে আসেন এবং গোপাদেবীর সঙ্গে সংসারও শুরু করেন। কিছুদিন পর যখন তিনি গোপাদেবীর সাংসারিক দাবীগুলি নিয়ে পুরোপুরি নিস্পৃহ থাকতে পারেন, তখনই তিনি উপলব্ধি করেন এইবার তাঁর ষোলআনা বোধিলাভ হল। শোনা যায় এই কালক্রমে য়ুরোপে অবস্থিত ধৌপিল তার সঙ্গে সিগমুন্ডিয় বার্তালাপের মাধ্যমে তাঁকে অনেক সাহায্য করেন। য়ুরোপ এবং তৎকালীন ভারতের মননসূত্র স্থাপনে ধৌপিলের অবদান ইতিহাস থেকে মুছে গেছে।
আমার মতো নশ্বর কবি বৌদ্ধত্বের থেকে বহু যোজন দূরে অবস্থান করি। তাই সেদিন বৌয়ের দাবি না ফেলতে পেরে তার আদরের সুকেশদাকে বিশ হাজার টাকা দিতেই হয়েছিল। তার পর থেকে যখনই সেই টাকার তাগাদা করে এসে নন্দিনীকে বলেছি, সে কেবলই একটাই উত্তর দিয়েছে, “তোমার সমস্যা তুমি বোঝো, মানুষ চিনে টাকা ধার দিতে পার না?”
বাজারে আমাদের সাধনদার নামডাক আছে ধার নেওয়ার ব্যাপারে। প্রত্যেকের সঙ্গে তার ওঠাবসা, সুসম্পর্ক। সাধনদা বিশেষ কিছুই করেন না ধার করা ছাড়া। তিনি চাইলেও ধার করেন, না চাইলেও ধার করেন। কতদিন হয়েছে পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে গিয়েও এক ব্যাগ বাজারসমেত ট্যাঁকে সম্পূর্ণ টাকা বেঁধে বাড়ি ফিরেছেন। সবাই তাকে চেনে, সবার কাছে তার ধার। তিনি বলেন ধার রাখলে আত্মীয়তা বাড়ে। সবাই তাই তাকে খুব পছন্দ করে।
এই হেন সাধনদার ত্থেকেও আমাকে একবার ধার করতে হয়েছিল প্রয়োজনে। সাধনদা সেই টাকাও তার পাশের বাড়ির থেকে ধার করে এনে আমাকে দিয়েছিলেন। প্রয়োজন মিটলে একদিন আমি তার বাড়িতে গেলে তাঁর বৌ কিন্তু নন্দিনীর মতো তার স্বামীর পাশ থেকে সরে যায়নি। টাকা শোধ করতে গেলে আমি তার বাড়ির সামনে থেকে ডাকলাম, “সাধনদা, ও সাধনদা…।”
অনেকক্ষণ কোনও সাড়াশব্দ নেই। প্রায় আধঘন্টা ধরে বাড়ির সামনে চিৎকার চেঁচামেচি করার পর এক সময় বৌদি বেরিয়ে এল বাইরে, মুখে একরাশ সংশয়, “কে আপনি? কী চাই?”
“সাধনদা আছেন?”
“না, মানে উনি তো একটু আগেই মেয়ের বাড়ি কৃষ্ণনগরে… তা আপনার কী চাই?”
“ও উনি নেই? আসলে বৌদি, সাধনদার কাছ থেকে ক’দিন আগেই আমি কিছু টাকা ধার নিয়েছিলাম। শোধ করতে এসেছি।”
মুহূর্তের মধ্যে বৌদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। ভেতরে এসো। আসলে উনি একটু আগেই ভাবছিলেন কৃষ্ণনগরে মেয়ের বাড়িতে যাবেন। ঘরেই আছেন এখনও। ভিতরে এসে দেখা করে যাও। চা খাও তুমি? আমি করে আনছি।”
এই হল পতিপ্রেম, যার থেকে আমি চিরবঞ্চিত। টাকা ধার দেওয়ার সময়কার চিন্তাভাবনাতে নন্দিনীর অমত যেহেতু সুকেশদা তার বাপের বাড়ির সম্পর্কে আত্মীয়, আবার ফেরৎ পাওয়ার চিন্তাতেও তার আপত্তি, কারণ সেই একই। এই প্রসঙ্গে প্রাতঃস্মরণীয় গোপালদার কথা মনে আসে। গোপালদা আমদের মুদির দোকানি, ব্যবসায়ী মানুষ। একদিন চায়ের দোকানে দেখা হওয়ায় বললাম, “গোপালদা, অনেকদিন বাদে দেখা হল, আজকে চা খাওয়াও।”
গোপালদা ব্যাজার মুখ করে বলল, “আর ভাই চায়ের কথা কী বলব, বলতেও খারাপ লাগে। পকেটে পয়সা কী রেখেছে তোর বৌদি? খালি ঘন্টায় ঘন্টায় একশ টাকা দাও, পাঁচশ টাকা দাও, হাজার টাকা দাও। দুঃখের কথা কী আর বলি তোমায়!”
“সেকী! এত দাবি কীসের তার? এ তো মারাত্মক ব্যাপার। তা কী করে এত টাকা দিয়ে?”
গোপালদা – কী করে বলি ভাই। কোনও দিন তো দিইনি, কী যে করে অত টাকা দিয়ে বলতে পারব না।”
সুতরাং পত্নীকে বশে রাখার যে আর্ট, তা হয়ত আমার হন্তরেখায় লেখা নেই। রুগ্ন কবি হিসেবে মেনে নিই সে যা বলে, বড়লোকের মেয়ে বলে কথা। এমনিতেই নন্দিনীর এক বান্ধবীর বিয়ের কথা ক’দিন আগে সে শোনাচ্ছিল। তার বান্ধবীর নাম সুকন্যা। প্রেম করত অজিতের সঙ্গে। বছরকালের প্রেম, একই অফিসে চাকরি। বহুদিন ধরেই সুকন্যা অজিতকে বিয়ের কথা বলে, কিন্তু অজিত রাজি হয় না। একদিন সকালে অজিতের মা একটি ফোন কল পেলেন, “হ্যালো মাসিমা, আমি সুকন্যা বলছি। ক’দিন ধরেই আমার সঙ্গে অজিত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এমন চললে কিন্তু আমি ওর নামে শ্লীলতাহানির কেসে পুলিশে ডায়রি করব।”
মাসিমার তো মাথায় হাত। এখনকার মেয়েদের প্রচুর ক্ষমতা তা তিনি জানেন। প্রধানমন্ত্রীও ভয় খায়, তিনি তো কোন ছাড়। তবুও তিনি শেষ রক্ষা করতে মোক্ষম চাল দিলেন, “ছি ছি সুকন্যা, তুমি না আমাদের মেয়ের মতো। এ কী কথা বলছ তুমি? তোমাকে এত ভালোবাসার এই প্রতিদান দিচ্ছ তুমি?”
এই কথোপকথন মেয়েলি দ্বন্দ্বের যৌক্তিকতা, আমার আপনার বোঝার বাইরে। ওরা ইমোশনালি একে অপরকে পর্যুদস্ত করতে এই হেন নানা রকম বাণ প্রয়োগ করে শুরুতে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এই ব্রহ্মাস্ত্রকে ত্বাষ্ট্র মেরে ঘুরিয়ে দিয়ে সুকন্যা উত্তর দিল, “হ্যাঁ মাসিমা। আপনাদের ভালোবাসার কথা কী করে ভুলি? তবে মাসিমা আমি কোনও কিছুরই ঋণ রাখতে ভালোবাসি না, সুদসমেত ফেরত দিই। সেটা এখন আমার পেটে বাড়ছে। আসলটা না হোক, সুদটিকে নিয়ে অন্তত আমায় দায়মুক্ত করুন।”
গতমাসে যেমন বিজয় মালিয়া ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের আদালতে হলফনামা ফেলেছে, “ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী মাতালের সঙ্গে কোনও রকম চুক্তি অবৈধ বলে ঘোষণা হবে। সেই প্রসঙ্গে আমার মক্কেলের নামে কোনওরকম চুক্তিবিরুদ্ধ আইন প্রয়োগ করা উচিত নয়, কারণ তিনি মদের ফ্যাক্টরি চালান এবং ঘুম বাদে দিনের বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকেন, তার প্রমাণ যে কোনও মেডিয়ার থেকেই দাবি করা যেতে পারে। ইউটিউবেও ভিডিও আছে।”
এই প্রসঙ্গে নানা বাদানুবাদ, আলোচনায় যখন সেই টাকা ফেরৎ পাওয়ার আর কোনও আশা নেই, তখন সমস্ত বামপন্থা ঝেড়ে ফেলে চাণক্যনীতি নিতেই হয়। বামপন্থীদের মতে চাণক্যের কোনও গুরুত্ব সমাজে যুক্তিহীন, কারণ চাণক্য অর্থশাস্ত্রের প্রণেতা এবং শাস্ত্র মানেই তা বামপন্থা বিরোধী। কবি সমাজে যেহেতু বামপন্থা ব্যাপারটা খায় ভালো, তাই বেশিরভাগ সময়েই তা সেজে থাকা কবি মানসিকতায় উন্নতির লক্ষণ। কিন্তু প্রয়োজনে অতি কট্টর বামপন্থীও এই ধারার বিপক্ষে যেতে কসুর করে না যখন, তো আমার মতো নিমিত্ত কবিরই কী বা যায় আসে? তাবড় তাবড় প্রাক্তন নেতামন্ত্রীর ছেলেমেয়েরা যেখানে দেশে ফিরছে বামপন্থা বিরোধী আমেরিকার থেকে ডিগ্রি নিয়ে। সুতরাং একসময় দেশজ শঠে শাঠ্যং নীতি নিতে বাধ্যই হলাম। ফোন করলাম সুকেশদাকে, “হ্যালো সুকেশদা। বলছি যে আগামী সপ্তাহে বাড়িতে আসতে পারবেন? একটা ছোট পার্টি ডেকেছি।”
ওপার থেকে উত্তর আসল, “তাই নাকি? বাঃ বাঃ বেশ বেশ। তা কী মনে করে হঠাৎ।”
“আর বলেন কেন, আপনার বোনই তো খবরটা দেবে ভাবছিল। কিন্তু পার্টি আর ব্যাঙ্ক নিয়ে এত ব্যাস্ত। আমিও আবার ওই আর্থিক ব্যাপার স্যাপার ঠিক বুঝি না কিনা, তোমরা তো জানই…।”
“ব্যাঙ্ক! আবার ব্যাঙ্কে নন্দিনীর এত কাজ কী পড়ল? তা পার্টিটা কবে?”
“ওই পরের সপ্তাহের শনিবার রাতে। আসলে হঠাৎ এক লটারীতে লাখ পাঁচেক টাকা পেয়েছি কিনা। হঠাৎই পাওয়া, তাই সবাইকে জানানো হয়নি তাড়াহুড়োয়। আপনি আসবেন কিন্তু ওই দিন।”
সুকেশদা এসেছিল এক বাক্স মিষ্টি আর রেড লেবেলের একটা বোতল হাতে। সঙ্গে বিশ হাজার টাকার পুরোটা দিয়ে গেছে নন্দিনীর হাতে। বলে গেছে আমার নাকি জীবনে অনেক উন্নতি হবে। তার পরেরদিন থেকে সুকেশদার ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছি আমি।

ক্রমশ …

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।