বাবার দিকে তাকিয়ে সে বলল, জানো তো বাবা, পাড়ার যে দোকান নিয়মিত খোলা থাকে, সব রকম জিনিস পাওয়া যায়, লোকজন সেখানে যেতে পছন্দ করে। তেমনি তোমার কারখানা ছুটির দিনেও খোলা থাকলে লোকের মনে আস্থা আর বিশ্বাস তৈরি হবে যে, পালের ওখানে গেলে একটা কিছু ব্যবস্থা হবে।
এই যে আস্থা আর বিশ্বাস, এটাই কিন্তু ব্যবসার আসল জায়গা। যে কারবারী এটা বজায় রাখতে পারে, তার ব্যবসা ডোবে না।
বাসন্তীবালা বললেন, শ্যামলী, তোকে বলি বলি করে কাল বলতে পারিনি, আমার হাতে একদম টাকা পয়সা নেই। সেদিন রমানাথ এসেছিল, নানা রকম ফল আনিয়ে ছিলাম সবিতাকে দিয়ে। সব সেদিন খরচা হয়ে গেছে।
শ্যামলী ইঙ্গিতে বাবাকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, পাল অটোর মালিক বসে আছে, তাঁকে ধরো।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তোমাকে কিন্তু খুব বুঝে চলতে হবে। শান্তুদের এই হাতটানের অভ্যেসটা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। ওদের হাত থেকে সংসারটা যদি বাঁচাতে চাও, তোমাকে শক্ত হতে হবে।
বাসন্তীবালা বললেন, আমি শক্ত হব কেমন করে, ওরা যদি সব কিছু হাঁটকায়, তাহলে আমি যাই কোথায়?
শশাঙ্ক বললেন, সেও সত্যি। নিজের বাড়িতে মানুষ নিশ্চিন্তে থাকবে, ঘুমাবে, বাথরুমে যাবে। বাড়ির কোনো লোককে যদি চোখে চোখে রাখতে হয়, তার মতো লজ্জা আর নেই।
বাসন্তীবালা বললেন, কি করব বলো, নাড়িছেঁড়া ধন, ফেলে দেব তো বলতে পারি না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, ধরো আমার কথায় শ্যামলী তোমাকে কিছু টাকা দিল, সে টাকা যে তুমি ঠিক কাজে লাগাতে পারবে, তার গ্যারান্টি কই?
বাসন্তীবালা রেগে উঠে বললেন, কি জানি বাবা, এমন বিটকেল অবস্থায় তো কোনোদিন পড়িনি, পয়সা থাকত তোমার কাছে, মুখের কথাটি খসাতে না খসাতে তুমি ব্যাগ বোঝাই করে জিনিস এনে দিতে। দৈনিক তিন চার রকম মাছ, মিষ্টি, ফল, বাড়িতে কেউ আসব বললে কোনোদিন দোকানে লোক পাঠাতে হত না। এখনই দেখছি যত অসৈরণ কাণ্ড কারখানা।
এমন সময় সবিতা এসে বলল, বৌমণি, ছোটো খোকা বলছে পিসি লুচি মাংস খাব। কি বলবে বলো।
শশাঙ্ক পাল বললেন, আজ অষ্টমীর দিন মাংস খাবার কথা ওঠে কেন? চিরকাল লুচি ছোলার ডাল ধোঁকার ডালনা টমেটোর চাটনি, সুজির পায়েস হয়েছে, এবারেও তাই হবে। অষ্টমীতে আমিষ খাব বললেই হবে?
বাসন্তীবালা বললেন, ছোটোখোকা বরাবরই খেতে ভালবাসে। সেদিন মেয়েটার জন্যে দুপিস মাছ রাখা ছিল। ওটা ওর ভাগের টুকু ছিল। ছোটোখোকা সবিতার উপর ধমক ধামক করে সে মাছ খেয়ে নিয়েছে। একবারও ভাবে নি পর্যন্ত, আর কারো খাওয়া হয়েছে কি না।
শ্যামলী বলল, মা, এইসব আলোচনার মধ্যে আমার থাকতে ভাল লাগে না। আমায় রেহাই দাও। টাকা পাল অটোর। বাবাকে চেকবই ফিরিয়ে দিয়েছি। তোমার সংসার তুমি কিভাবে সামলাতে চাও তুমি বোঝো।
শশাঙ্ক পাল বললেন, এইসবের মধ্যেই তো জীবন।
শ্যামলী বলল, বাবা, আমি কারখানায় যাচ্ছি। আজকে তো ব্যাঙ্ক খোলা পাব না। গাড়ি সারাইয়ের কাজ পেলে বিকেলে কিছু টাকা যদি বল, অ্যাডভান্স করব।
সবিতা বলল, সে কি শ্যামলিমা, তুই খেয়ে যাবি না?
শ্যামলী বলল, তোমার খোকনদের তুমি দেখভাল করো, আদর করো। আমাকে বাদ দাও। আমি কারখানায় গিয়ে দুপুরে কিছু খেয়ে নেব।
বাসন্তীবালা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওগো ওকে কিছু বলো? দিনের পর দিন ও দুপুরে বাইরে খায় বলে। কি খায়, না খায়, জানি না। তা বলে আজ অষ্টমী তিথিতেও বাইরে খাবে?
শ্যামলী বলল, বাবা, ওরা বদভ্যাস করে ফেলেছে। আর পুরোদস্তুর প্রশ্রয় পাচ্ছে। এ সংসারের হাল ফেরা শক্ত। অন্তু কোন্ সাহসে মাংস খাবার বায়না করে আমি তো ভাবতে পারছি না। কাল বেল পেয়ে বাড়ি ফিরে ও কি ভাবছে রাজ্যজয় করে ফিরেছে?
বাসন্তীবালা বললেন, যা হয়েছে হয়েছে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে, এখন আর ওসব কথা তুলিস না।
শ্যামলী বলল, মা, আমি তোমার আদরের খোকাদের কোনো কথায়ই থাকতে চাই না। আমি একটু নিরালায় নিজের মনে থাকব বলেই কারখানায় যেতে চাচ্ছি। তোমাদের এই ঘর সংসারের আলোচনার মধ্যে আমায় টেনো না।
শশাঙ্ক বাবু ব্যথার হাসি হেসে বললেন, গতকাল তুইই আমাকে এসকেপিজম নিয়ে বলছিলি। তুই নিজেই বললি পালিয়ে বাঁচা যাবে না। আর রাতটুকু কাটার পরে সেই তুই অন্য কথা বলছিস?
শ্যামলী বলল বাবা, ওরা তোমার ছেলে। ওদের কথা তোমাকে ভাবতে হবে। আমি কেন শুধু শুধু এভাবে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছি বলতে পার? কাল রাতে আমি ঠিক মতো ঘুমাতে পারি নি।
সবিতা বলল, সে কিরে? কেন?
শ্যামলী বলল, যার ভাইয়েরা বেশ্যাবাড়ি যায়, সে মেয়ে কি করে নিশ্চিন্তে ঘুমাবে বলতে পার?
এই একটা রাতের মধ্যে আমার বয়স বিশ বছর বেড়ে গেছে।
সবিতা বলল, নিজের বাবার বাড়ি ভাল না লাগে তো বিয়ে করে নিলেই পারিস। তাহলে তো আর আমাদের নুন হলুদের কথায় থাকতে হয় না। রমানাথ টা কত আসে। ওরা যখন প্রথম এল, তখনই যদি মন ঠিক করে ফেলতিস, তো অ্যাদ্দিনে তোর হিল্লে হয়ে যেত।
শ্যামলী বলল, কেউ একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছে বলেই সেটা আমার পরম সৌভাগ্য বলে মনে করব কেন? বাবা, আমার কলেজের হোস্টেল যদি খোলা থাকত তো কোনো মেয়ের গেস্ট হয়ে সেখানে থেকে যেতাম। এখানে আমার দমবন্ধ লাগছে।
শশাঙ্ক পাল বেদনার্ত গলায় বললেন, একলাটি ফেলে চলে যাবি বলেই কি আমায় যমের মুখ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলি?
বাসন্তীবালার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
সবিতা এগিয়ে এসে শ্যামলীর গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, আজ অষ্টমী পুজো, আজকের দিনে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব বলতে নেই। চ, পরোটা আর আলু তরকারি করেছি, খেয়ে তবে কাজে যাস্।শ্যামলী নীরবে পিসির পিছন পিছন রান্নাঘরে চলে গেল।