• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১০৫)

পর্ব – ১০৫

ধীরে ধীরে বাবাকে ধরে ধরে উপরের ঘরে নিয়ে গেল শ‍্যামলী।
শশাঙ্ক পাল বললেন, শ‍্যামলী রে, শরীরটা ভাল লাগছে না।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, তোমাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প বলি? জানো বাবা, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন নামকরা কবির ঘরে। জামাইয়ের নাম শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী। জামাইয়ের বাবা, মানে রবীন্দ্রনাথের বেয়াইমশাই ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। তিনি ঠাকুর পরিবারের আপনজন হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অল্প বয়স থেকেই। রবি ঠাকুরের নতুন দাদার ব‌উ কাদম্বরী দেবীর কাছে বিহারীলাল আসতেন।
শশাঙ্ক পাল বললেন, সে কি রে, বাড়ির ব‌উয়ের কাছে বাইরের পুরুষমানুষ আসবে?
শ‍্যামলী বলল, তাতে কি বাবা? বিহারীলাল নামকরা কবি। জ‍্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। তিনিও কবি ছিলেন। রবিঠাকুরও কবি। তিন কবিকে সাহিত্যের ব‍্যাপারে উৎসাহ যোগাতেন নতুন ব‌উদি।
শশাঙ্ক পাল বললেন, শ‍্যামলী, রবিঠাকুরের গল্প অন‍্য দিন বলিস। এখন বল্ তো, এই ঝঞ্ঝাট থেকে রক্ষা পাই কি করে?
বাসন্তীবালা ঘরে এসে বললেন, শ‍্যামলী, বাবাকে আর বকাস না। শরীর ঠিক নেই। টেনশন নিতে পারছে না।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, খুব বেশি চিন্তা কোরো না। পুলিশ এদের ভারি কেস দেয়নি। হালকা কেস। উকিল দিতে হবে। আমাকে ওসি বলেছেন। তুমি উকিলের সঙ্গে কথা বলে নিও। বেশি ঝামেলা হবে বলে মনে হচ্ছে না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তোর সাথে ওসির এই নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে!
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ, ওসি নিজের থেকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছেন, বেশি শাস্তি হবে না।
 বাসন্তীবালা বললেন, পুলিশ শাস্তিও দেবে?
শশাঙ্কবাবু বললেন, তা শাস্তি আর দেবে না! ওরা কাজটা কি খুব ভাল করেছে! শাস্তি তো হবেই।
শ‍্যামলী বলল, শাস্তি তো পুলিশ দেয় না। পুলিশ ইনভেসটিগেশন করে, রিপোর্ট তৈরি করে, চার্জশিট দেয়। এই মামলাটা হবে জুডিশিয়াল ম‍্যাজিস্ট্রেট এর কোর্টে।
বাসন্তীবালা বললেন, ছেলে দুটোকে জেলে ভরে দেবে? তারপর বললেন, উকিল কিছু করতে পারবে না?
শশাঙ্ক পাল বলল, তা কেন পারবে না? উকিলবাবুদের কায়দা কেতাতেই তো মামলায় দিনের পর দিন ডেট পড়ে। হাকিমের পর হাকিম বদলে যায়, নতুন হাকিম এসে পুরোনো কাগজপত্র দেখে বুঝে হাত লাগাতে চাইলে আবার ডেট।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, উকিলবাবুরা এটা কারো স্বার্থে করে কিনা ভেবে দেখেছ?
 শশাঙ্কবাবু বললেন, সে তো বটেই, যার শাস্তি হতে পারে, সে নিজের উকিলকে পয়সা কবুল করে ডেট ফেলাবে, এমনকি অপর পক্ষের উকিলকে কেনার চেষ্টা করবে। যাতে অন‍্যপক্ষের উকিল ডেট ফেলা নিয়ে আপত্তি না করে। এই রকম ভাবে দুই উকিল তালমিল করে ডেট নিয়ে নিয়ে মামলাটাকে পচিয়ে দেবার চেষ্টা করে যাবে। ততদিনে সাব ইনসপেকটর কোথায় না কোথায় বদলি হয়ে গিয়েছে। মামলা তদারকি কে করবে?
বাসন্তীবালা বললেন, ছেলেদুটোকে বাঁচাতে যা করতে হয় করো।
শ‍্যামলী মাথা নিচু করে বসে থাকে।
শশাঙ্কবাবু নিজের স্ত্রীকে ব‍্যঙ্গ করে বললেন, আশ্চর্য, দুটো বদ বাঁদরকে জেলের ঘানি টানার হাত থেকে বাঁচানোর জন‍্য তোমার কত আগ্রহ।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, কথায় কথা বেড়ে চলবে। তুমি এবার শুয়ে পড়ো তো। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।
এমন সময় সবিতা এসে বলল, বৌমণি, ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি কি ওদের কাছে থাকব, রাতে যদি জ্বর আসে?
শ‍্যামলী বলে উঠল, না, রাতে ওদের আর জ্বর আসবে না। তুমি নিজের ঘরে ভাল করে দোর দিয়ে তবে শুয়ো।
বাসন্তীবালা বললেন, যদি জ্বর আসে, তখন কি করবে?
শ‍্যামলী বলল, ওদের যদি হাজতে রেখে দিত, তাহলে কে দেখাশুনা করত? বেল পেয়ে গেছে, তাই বাড়িতে ঢুকতে পারল। ন‌ইলে কি করতে?
বাসন্তীবালা বললেন, ঠাকুর রক্ষা করেছেন।
শ‍্যামলী বলল, তার তোশকের নিচ থেকে যখন টাকা উধাও হচ্ছিল, তখন তোমার ঠাকুর খপ করে চোরের হাতটা চেপে ধরলে আজ আর জুয়াড়ি হিসেবে ধরা পড়তে হত না।
বাসন্তীবালা বললেন, শ‍্যামলী, তোর সব ভাল, কিন্তু এই বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে চিমটি কেটে কথা বলার অভ‍্যেসটা ছাড়্। জীবনে মারাত্মক কষ্ট পাবি।
সবিতা আবার বলল, তা হলে আমি কি করব?
শ‍্যামলী কঠিন স্বরে বলল, ওরা খারাপ পাড়ায় জুয়া খেলতে খেলতে মারামারি করে ধরা পড়েছে। ইশকুলের নিচু ক্লাশের বাচ্চাদের মধ‍্যে মারামারি নয়। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, মা রে, তুইও এবার শুতে যা।
এই যাই বাবা। যাবার আগে তোমার মশারিটা খাটিয়ে দি‌ই। মা, বাবার হাতে ওষুধ আর জলের গ্লাসটা এগিয়ে দাও।
বাসন্তীবালা বললেন, আমি সব করে দিচ্ছি। তুই এবার শুতে যা। রাত অনেক হল।
শ‍্যামলী ভাবল রাতে তার ঘুম আসবে কি না। এমন একটা বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যেন তাকে আব্রুহীন ফুটপাতের বিপন্নতায় ঠেলে দিয়েছে মনে হল তার। অন্ধকার ঘরে বিষধর সাপের মধ‍্যে থাকতে হলে যেমন দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে, শ‍্যামলীর তাই হচ্ছিল।
শশাঙ্ক পাল তার মুখ দেখে উদ্বেগের কারণ আঁচ করলেন। বললেন, তুইও খুব ভালো করে খিল এঁটে শুবি। টর্চটা হাতের কাছে রাখবি।
বাসন্তীবালা একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলতে চেয়ে ব‍্যর্থ হলেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।