• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় ঋদ্ধিমা

পঁচিশে বৈশাখ

হাওড়ার বাউড়িয়ায় আমাদের একটা বাড়ি আছে। আসলে ওটাই আমাদের আদি বাড়ি। প্রায় ১৫০ বছর পুরোনো। কোনো এক সময় ওটা এক বড় ব্যবসায়ীর বাড়ি ছিল। আজ সেই প্রাচুর্যের ছাপমাত্র নেই। বাড়ির সবাই কোনো না কোনো চাকরি সূত্রে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়। মানে সবাই চরম ব্যস্ত তাদের Struggle for Existence নিয়ে। এই অবস্থা শুরু আমার বাবার জেনারেশন থেকে। ঠাকুরদারা আট ভাইবোন পুরনো সঞ্চয় ও চাষের জমির আয়ে বসে খেয়েছে নিশ্চিন্তে।
এখন আর পুরোনো কোনো রীতি বা সাবেকিয়ানার কোনো ছাপ সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ছিটেফোঁটা এখনও রয়ে গেছে ২৫ শে বৈশাখ আর দুর্গাপুজোয়।
যে ব্যবসায়ীর কথা প্রথমেই বলেছি, তিনি ছিলেন আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাবা হেমেশচন্দ্র বসু। উনি ব্যবসায়ী হলেও ওনার বড় ছেলে উমেশচন্দ্রের গান, বাজনা, সাহিত্য এবং এরম বিভিন্ন চর্চা ছিল। সেই উমেশচন্দ্রই শুরু করেন এ বাড়িতে ২৫ শে বৈশাখ পালন। তিনি আসলে বিশ্বভারতীতে সরাসরি রবীন্দ্রনাথের ছাত্র ছিলেন। এবং কাকতালীয়ভাবে এই ২৫ শে বৈশাখই ওনার বাবা হেমেশচন্দ্রেরও জন্মদিন। সুতরাং এই দিনটি পালিত হতো আড়ম্বরেই। পিসি ঠাম্মার কাছে শুনেছি গোটা গ্রামের মানুষের নিমন্ত্রণ থাকতো এই দিনে। তাদের পাত পেড়ে খাওয়ানো হতো পোলাও, মাংস, মিষ্টি।
আমার পিসিঠাম্মা। শুনেছি উনি বাল্যবিধবা। ঠাকুরদা সেইসময়ই ওনাকে নিয়ে চলে আসেন বসু বাড়িতেই। ছোটবেলা থেকেই ওনাকে দেখেছি একজন অত্যন্ত দায়িত্ব, কর্তব্য, মূল্যবোধের এক পার্ফেক্ট কম্বো। আর আছে ওনার ভুবনভোলানো হাসি আর মিষ্টি ব্যবহার। তাই আট থেকে আশি আমরা সবাই তাঁর খুব ভক্ত। শুধু এ বাড়িই নয়, তার শ্বশুরবাড়ির মানুষের কাছে আজও তিনি বড় প্রিয়।
এ বছর লকডাউন চলছে। তাই আমরা সবাই জানতাম এ বছর আর ২৫ শে বৈশাখ পালন সম্ভব নয়। বাড়ির বয়স্করা তাতে বড় মনোকষ্টে ভুগছিলেন। বছরে এই দুবারই তো তাঁরা ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিদের দেখতে পান।
আমাদের বাড়িটা কাছাকাছি বলে তবু ছুটিছাটায় আমাদের যাওয়া হয় সেখানে। তবে ২৫ শে বৈশাখের এই আনন্দ বছরের আর কোনো সময়েই উপভোগ্য হয় না। হঠাৎ একদিন ফোন এলো পিসিঠাম্মার
— কি রে! ব্যাগপত্তর গুছিয়েছিস? আসতে হবে তো?
— কিসের ব্যাগপত্তর? এবছর তো লকডাউন, যাবো কি করে?
— আমি বেঁচে থাকতে ২৫শে বৈশাখ হবে না তাই কখনও হয়! সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই, একটু সর্দি জ্বর আর কি! তুই বাকি ভাইবোনেদের একটু ফোন করে দে সোনা। আমি আর এত পারিনা। তোদের সবাইকে দেখলে আমি এমনিই সুস্থ হয়ে উঠবো। এখন রাখি বুঝলি!
ফোনটা পেয়ে তো আমার খুশি আর ধরে না। আমি সবাইকে জানিয়ে দিলাম ফোন করে।অবশেষে পিসি ঠাম্মার উদ্যোগে আমরা সবাই আবার একসাথে আনন্দ করার সুযোগ পেলাম। পিসি ঠাম্মা এই লকডাউনেও বিশেষ পারমিশন করিয়ে সবার বাড়ি থেকে গাড়ি করে আমাদের আনানোর ব্যবস্থা করলেন। পিসিঠাম্মার শ্বশুরবাড়ির তরফের নিকটাত্মীয় পুলিশ কমিশনার হওয়ায় কাজটা খুব কঠিন হলো না।
আমরা সবাই এক সপ্তাহ আগেই পৌঁছে গেলাম। অনুষ্ঠানের তোড়জোড়, রিহার্সাল আরও কত কাজ! এই লকডাউনের সময় যখন বহু মানুষ সম্পূর্ণ বেকার হয়ে গেছিল তখন আমাদের এই অনুষ্ঠানের কারণে তারা আবার কাজ পেলো। যিনি প্যান্ডেল বাঁধেন, যিনি লাইটের কাজ করেন, যিনি রান্না করেন, তারপর চেয়ার, টেবিল, সাউন্ড, ফুল এইসব নিয়ে যাদের জীবন তাদের একটা হিল্লে হলো এই সুযোগে। ২৫ শে বৈশাখ দিনটা যে এই বাড়িতে কতখানি তা বলে বোঝানো যাবে না। মনে হয় যেন একদিনের দুর্গাপুজো। গোটা বাড়িটা সেজে ওঠে রঙিন কাপড়ে, প্রচুর ফুলে, আলোয় আর প্রাণের মানুষে। আমাদের এই বাড়িতে না এলে বোঝা যাবে না মানুষ কত বৈচিত্র্যময়। কারও সাথে কারও মতের মিল নেই তবু সবাই বেঁধে বেঁধে থাকে ঠিক হাতের পাঁচটা আঙুলের মতো। এই বাড়িতে একজনের কথাই শেষ কথা, সে হলো আমার ঠাকুরদা। তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর এখনও কারও কথা চলে না।
প্রতিবছর এই দিনটায় আমাদের এলাকার যত মানুষ সবাইকে একসাথে বসিয়ে পাত পেড়ে পোলাও মাংস খাওয়ানো হয়। এইবার লকডাউন তাই জমায়েত করা বারণ। দাদু বললেন
— এই দিন গ্রামের সবার নিমন্ত্রণ থাকে এ বাড়িতে। এ বড় পুরোনো রীতি এই বসু পরিবারের তোরা সবাই আছিস এখানে, মতামত দে এবছর তার কি হবে!
বড়দা বলল,
— চিন্তা করো না দাদুভাই। খাবার আয়োজন করো। আমরা বাড়ি বাড়ি প্যাকেট করে দিয়ে আসবো সেই খাবার। নিয়ম মেনে সবাই মাস্ক পরে।
তাই ঠিক হলো এবছর আমরা ভাইবোনেরা মিলে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসবো।
অবশেষে সেই দিন এলো। এবার বাড়িটা একটু ঘুরে দেখা যাক। সদর দরজা থেকে শুরু করে গোটা বাড়ি ফুল, আলো আর রঙ বেরঙের কাপড় দিয়ে সাজানো। ঠাকুরদালানেই অনুষ্ঠান হবে। গোটা বারান্দা জুড়ে রান্নার আয়োজন চলছে। রান্নাঘরে চলছে রান্না। গোটা একতলাটা খাবারের গন্ধে ম ম করছে। আর এখানে যাকেই চোখে পড়ছে সবাই ভীষণ ব্যস্ত সবাই দৌড়চ্ছে। পিসিঠাম্মা এখন ঠাকুরদালানে আলপনা দিতে বসেছে সবে। বারান্দার কোণের সিঁড়িটা ধরে উঠে গেলাম দোতালায়। জুঁই ফুল আর রজনীগন্ধার গন্ধে ভরে গেছে চারিদিক। সবাই যে যার নাচ গান কবিতা নাটক নিয়ে ব্যস্ত। এ বছরের মূল আকর্ষণ চিত্রাঙ্গদা। বড়দা অর্জুন হবে। প্র্যাকটিস চলছে পুরোদমে। আমি আর দাদু করবো কর্ণ কুন্তি সংবাদ। সেটা পুরো তৈরি। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার রিহার্সালের ফাঁকে পোষাক গুছিয়ে রাখছে রাতে পরারা জন্য। গোটা বাড়িটা জুড়েই একটা অন্যরকমের উন্মাদনা, হইহই, রইরই রব।
দুপুরের আগেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম সবার বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে। সবার মুখের সেই চওড়া হাসি মনটা যেন ভরিয়ে দিল।
সন্ধ্যে হয়ে গেলো। সবাই অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হচ্ছি। বাড়ির লোকেই ভরে গেলো উঠোন। প্রোগ্রাম শুরু হলো দাদু আর পিসিঠাম্মার গান দিয়ে– মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না। মা গাইলেন– ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা/ প্রভু তোমার পানে তোমার পানে তোমার পানে।
অনুষ্ঠান শেষ হলো। এইবছরের অনুষ্ঠান এককথায় দ্য বেস্ট হয়েছে। এত কম দিনের রিহার্সালে এমন অনুষ্ঠান ভাবাই যায় না। পাড়ার মণি কাকু, চম্পা পিসিদের খুব মিস করলাম। প্রচুর খাটাখাটুনি হয়েছে সারাদিন তাই সবাই খেয়েদেয়ে যেযার ঘরে শুয়ে পড়েছে তাড়াতাড়ি।
হঠাৎ সকাল সকাল সবার চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো। ঘর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে দেখলাম পিসি ঠাম্মার ঘরের বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে ভিড় করে। বড়দা গলা ছেড়ে কাঁদছে। জন্মের পর এই প্রথম বড়দাকে কাঁদতে শুনলাম। ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই দেখলাম পিসিঠাম্মা চুপচাপ পাথরের মতো শুয়ে আছে বিছানায়। আমি কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরলাম পিসিঠাম্মার। কী ঠান্ডা! গা টা শিউরে উঠলো। পিসি ঠাম্মা এই বাড়ির একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা। আমাদের সকলের জীবনেই পিসিঠাম্মার কিছু না কিছু অবদান আছেই। বড়দার জীবনে সবচেয়ে বেশি। বড়দার আমেরিকায় পড়াশুনা, তারপর ওখানে সেটল হওয়া সবটাই পিসিঠাম্মার জন্যই। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল আমার। ভীষণ। তাও চোখে জল ছিল না। সব জল যেন শুকিয়ে গেছে। পুলিশ এসে পিসিঠাম্মার লাশ নিয়ে যায়।
তিনদিন পরে জানতে পারলাম করোনায় মৃত্যু পিসিঠাম্মার। আমাদের সবার টেস্ট করা হলো। আরও কয়েকদিন সময় লাগলো রিপোর্ট আসতে। তার মধ্যেই চোখের সামনে দিয়ে ছাই হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো পিসিঠাম্মা। আমরা শেষবারের মতো দেখতে পেলাম না। পুলিশ দিলো না দেখতে।
রিপোর্ট এলো সবার করোনা পজিটিভ। বড়দা আগে থেকেই জানতো। তবুও কি কারণে যেন লুকিয়ে গিয়েছিল। দেড় মাস আগে এয়ারপোর্টেই জানতে পারে ও আক্রান্ত তবুও….। দেখলাম অপরাধবোধের আগুন বড়দাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে। বড়দা একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। একটা করে দিন যায় আর বড়দার শরীর ভাঙতে থাকে একটু একটু করে। ও মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট।
আমরা সবাই সেল্ফ কোয়ারান্টাইন আর মেডিকেশনে থেকে সুস্থ হয়ে উঠলাম আস্তে আস্তে। কিন্তু বড়দা বাঁচলো না। ও চলে গেলো পিসিঠাম্মার কাছে ক্ষমা চাইতে। আমাদের গোটা বাড়ি ডুবে গেল কালো অশৌচে। বন্ধ হলো চিরদিনের মতো পঁচিশে বৈশাখ পালন। দাদু ভেঙে পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। সেদিন দাদুর ঘর ভেসে আসছিল–
তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ কোথাও মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদও নাই….
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *