বাইরে তখন বেশ অন্ধকার। হয়তো লোডশেডিং হয়েছে। শহরের পূর্বদিকের আকাশটা লাল হয়ে উঠছে মনে হলো। সম্ভবত স্টিল প্লান্টের জন্য এমনটা হয়েছে, ওরা রাতের বেলা গলানো লোহার গাদ বাইরে ফেলে। আকাশ এভাবে লাল হয়ে উঠলেই আবহাওয়ার উষ্ণতা বেড়ে যায়, লোকদের জলের তেষ্টা জাগে। আমিও তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠি, কিন্তু ধারে কাছে কোথাও পানীয়জলের কোনো ব্যবস্থা নেই, আমি ঠিক করলাম বাড়ি ফিরে জলতেষ্টা মেটানোর কাজটা সারাবো। আকাশে লাল আলোর দ্যুতিতে মনে হচ্ছে অসংখ্য পাখি বন্দি হয়ে পড়েছে, তাদের ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে চক্রাকারে আকাশে ওড়ার ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পাখিগুলো যেন আলোর খামখেয়ালিপনায় কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত। চারদিকে যেন এক অনন্ত মরীচিকা, তারা বিস্মিত হয়ে দেখছে এখনো আলোর ঝলকানি রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে সকালকে ডেকে আনছে, আবার কিছুক্ষণের মধ্যে ভোরের আলো নিভে গিয়ে রাতের গভীর অন্ধকার ফিরে আসছে!
আমি বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। হঠাৎ আমি অনুভব করলাম চতুর্দিকে এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে, ঠিক যেন ঝড়ের পূর্বের স্তব্ধতা। কোথাও কোনো গাড়ি-ঘোড়া চলছে না, রাস্তায় লোকজনও তেমন কেউ নেই। অবশ্য বেওয়ারিশ কিছু কুকুর রাস্তায় এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। সাধারণত এই কুকুরগুলোকে এমন উত্তেজিত হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না, বিশেষ করে এই ভোরবেলাতে, কিন্তু স্তব্ধতার এই নিবিড় বাঙ্ময়তায় বিপর্যস্ত কুকুরগুলো হয়তো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ক্ষিপ্ত কুকুরগুলো আমাকে আবার না তেড়ে আসে এই চিন্তায় আমি বেশ আতঙ্কিত হয়ে হাঁটছি, কিন্তু আমার বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত তেমন কিছুই ঘটলো না।কিন্তু কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিলো কিছু একটা ঘটবে।
আমার বাড়ির সামনে কিছু লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা আতঙ্ক নেমে আসে। লোকজনকে কিছুটা উপেক্ষা করে আমি বাড়িতে ঢুকলাম। আমার স্ত্রী চেয়ারে বসে হরিশংকর জলদাসের আমি মৃণালিনী নই পড়ছিলো। আমি তার দুচোখে এক আতঙ্কের ছাপ দেখতে পেলাম। রহস্য-রোমাঞ্চের গল্প, উপন্যাস পড়ার জন্য আতঙ্কিত হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা আমার স্ত্রীর আছে।
এই গত মাসেই তার পীড়াপীড়িতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলো বইটা লুকিয়ে ফেলতে হয়েছিল আমাকে। উপন্যাসটা পড়ার সময় বাতাসের জন্য জানালায় সামান্য শব্দ হলেই তার মনে হতো শার্শিতে রবী ঝাপটা মারছে বোধহয়। কখনো-কখনো সে আমাকে জানালার পাল্লাদুটো ভাল করে বন্ধ করে পর্দা টেনে দিতে বলতো। বৌঠান বৌঠান ডাকটা ধোঁয়ার আকার নিয়ে জানালা-দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে এমন ভয়ের কথাও সে বেশ কয়েকবার বলেছে আমাকে।
আজ পচিঁশে বৈশাখ ভোরের বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ,দুই মগ চা করে নিয়ে এসে বসলাম বৌয়ের সামনে। টিভি রিমোট চাপতেই বহুদূর থেকে ভেসে এলো-
তুমি কি কেবলই ছবি?
শুধু পটে লিখা
ওই যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়
ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি
তুমি কি তাদের মতো সত্য নও?
হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি
তুমি কি কেবলই ছবি?
পলকে হাতের বই ছুঁড়ে ফেলে সে পাগলের মতো চিৎকার করতে শুরু করলো বন্ধ কর,এক্ষুনি বন্ধ কর আমাকে মেরে ফেলবে। আমি বিস্ময়ে জানতে চাইলাম যে,একটা গান শুনে সে এমন ভয় পাচ্ছে কেন? উত্তরে সে বলেছিল, গান নয় এটা তো মৃত্যুর ডাক,রবির রূপ ধরে ঘরে ঢুকেছে তার প্রাণ নেবে বলে।