এক মাস কেটে গেল কোনরকমে। থারো আবার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। অসহ্য বেদনা আবার তাকে বাধ্য করেছে ঘর থেকে বেরোতে। যদিও তার মনে হচ্ছিল শরীরের হাড়গুলো একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। প্রতি পদক্ষেপে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যাচ্ছিল সে। আবার সেই সন্ধ্যার প্রাকমুহূর্ত। তার আঙ্গুল আবার জড়িয়ে ধরেছে একে অপরকে। মৃদুস্বরে অদৃশ্য প্রভুকে স্মরণ করতে করতে মেঠো রাস্তায় সে চলেছে পরবর্তী শিকারের আশায়। তার চলনশক্তি আরো মন্থর হয়েছে। নড়বড়ে মাথাটা ঘাড়ের ওপর বসিয়ে রাখাই দায়। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে সাথে শরীরের প্রতিটি সন্ধিতে যেন পেরেক ফোটানোর যন্ত্রনা। যে মানুষটির আশা তার মনে ছিল, এখন মনে হচ্ছে সেই দূরত্ব আর বোধহয় সে অতিক্রম করতে পারবেনা। সন্ধ্যের মুখে খামারের কাজ সেরে ফিরছিল একদল তরুণ। নিজেদের মধ্যে গল্প গুজবে এত মত্ত তারা, থারোকে সেভাবে লক্ষ্য করল না। ওদের প্রাণোচ্ছলতায় তার বেদনা দাবানলের মতো জ্বলে উঠল আবার। যৌবন! যৌবন মানুষের সবচেয়ে আশ্চর্য সময়। থারো ভীষণ ভালোবাসে এই প্রাণশক্তিকে। যৌবনে প্রতিটা মানুষ একজন জাদুগর। ইচ্ছা করলে ওরা সব করতে পারে। না, যৌবনের উপর কোন হিংসা নেই থারোর।
আধ মাইলের বেশি রাস্তা কিভাবে পেরিয়েছে সে মনে করতে পারে না। দেহের সমস্ত শক্তিকে সে এখন জড়ো করেছে তার হাতের দুই আঙুলে। মধ্যমা আর তর্জনী আবারও শক্ত করে বেঁধেছে একে অপরকে। দূরবর্তী বাড়িটি এবার থারোর ঝাপসা দৃষ্টির সামনে। হঠাৎই তার সঙ্গী যেন ভেতর থেকে পান করতে শুরু করল তাকে। গুটিয়ে গেল থারো। তীব্র যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাতে হারাতে অনুভব করল মটরদানার মতো কিছু একটা তার নাভিতে বিদ্ধ হয়ে গেল। থারো গড়িয়ে পড়ল রাস্তার একধারে। জ্ঞান ফিরলে আস্তে আস্তে চোখের অন্ধকার সরিয়ে সে অবাক হয়ে দেখল, বাড়ির প্রবেশমুখে তিনটি মোমবাতি, তিনটি লাল টকটকে কার্নেশন, তিন রঙের শস্যদানা এবং তিনটি ছোট ছোট ফল রাখা রয়েছে। এই নিবেদন, থারো জানে অশুভ নিবারণে, শুভ আত্মার উদ্দেশ্যে। এর অর্থ বাড়িটি সুরক্ষিত। অসহায়ের মতো চারদিকে তাকাল সে। একটি ছোট ছেলে আপাদমস্তক সাদা পোশাকে ঢাকা, খুব কাছেই একটা ন্যাশপাতি গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে বসে আছে। বাচ্চা ছেলে – প্রার্থনা করছে যেন থারো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ জায়গা ছেড়ে চলে যায়। থারোর নাভিতে বিষাক্ত মটরদানা আবার নড়েচড়ে উঠল। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সে পা চালাল বাড়ির দিকে।
থারো তার সেই ভীষণ অন্ধকার ঘরে পৌছেই উপুড় হয়ে পড়ল বিছানাতে। সান্ত্বনাহীন চাপা কান্নায় বারবার কেঁপে কেঁপে উঠল বিছানা। সে তার ছায়াসঙ্গীর কাছে কাতর অনুনয় জানালো, যেন সে তাকে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু নিস্তার নেই তার। সেই লোমশ অশুভ শক্তি তার কানে অবিরাম গুনগুন করে চলেছে। কান থেকে সেই গুঞ্জন ছড়িয়ে যাচ্ছে তার সরু সরু স্নায়ুর সূতোগুলোতে। বুভুক্ষু, অতিপ্রাকৃত কোন ক্ষমতায় সে থারোকে তাড়না করে আরও একটি মানব আত্মার দাবিতে। সে আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। এক্ষুনি, এক্ষুনি প্রয়োজন একটি তাজা মানবাত্মার। কিন্তু থারো অসহায়। থারোর জীবন তার নিজের প্রজন্মকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছে। এখন সে তার পরবর্তী চতুর্থ প্রজন্মের সাথে বাস করে। প্রকৃতির নিয়ম সে ভেঙেছে অনেক আগেই। এবার প্রকৃতির বদলা নেবার দিন এসেছে। এসব ভাবনা থারোকে আরও দুর্বল করে দেয়। সে ভীষণভাবে জানে, তার শরীরের ভেতরের এই ক্ষুধার্ত চিৎকার সে কিছুতেই থামাতে পারবেনা। শুভ-অশুভের মাঝখানে সে যেন এক দোদুল্যমান সেতু। পুতুলের মতই তুচ্ছ।