এক দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে চাঁদ দেখছে সেলিম৷ মন বড়ই অস্থির৷ কিছুক্ষণ আগেই নিউজে দেখিয়েছে বাংলা দেশে আতঙ্কবাদী হামলা হয়েছে৷ বেছে বেছে শুধু তারা হিন্দু দের মারছে৷ শিশু নারী কেউ তাদের হাত থেকে রেহায় পায় না৷ ভারত তো আতঙ্কবাদী হামলায় প্রথম স্থানে৷কোথাও যেন নিরাপদ নয় বলে মনে হয়৷ চাঁদ কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে৷আর চাঁদ দেখতে পেল না সেলিম৷ বিছানায় আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল৷ সাদা ধপধপে বিছানা৷ তবু কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না৷ শুলেই হাজার চিন্তা মাথায় কিল বিল করে৷
সেলিমের আব্বু ছিল গোড়া মুসলিম৷ তার সাথে তার আব্বুর কোন দিনও বনিবনা ছিল না৷ আম্মির শিক্ষায় বড় হয়েছে সেলিম৷ আম্মি ভালো রান্না করতো৷ গান গাইতো৷ সেলিমের আব্বু কোন দিন চায় নি তার আম্মি গান করুক৷ আব্বু বলতো, গান বাঈজি রা করে৷ আম্মির গলা একদিন টিপে ধরল,আর চিরদিনের মত তার গান বন্ধ হয়ে গেল৷
সেলিম দেখেছে তার আম্মি সব শখ বিসর্জন দিয়ে শুধু তার আব্বুর নির্দেশ মত সাত সাতটা বাচ্চার জন্ম দিয়ে গেছে৷
সেলিমের ঘেন্না হয়৷ ঘেন্নায় বমি আসে৷ বমি হয়৷ মাথা ঘুরতে থাকে৷ আবার বিছানায় আসে৷ চোখ বন্ধ করলেই ভেসে আসে রক্ত৷ কিছু অসহায় মানুষের চিৎকার৷ গুলির শব্দ৷
মুখে দাঁড়ি৷ মাথায় টুপি আর সাদা পাঞ্জাবি পরে সেলিম সে দিন যাচ্ছিল মসজিদে৷ মসজিদ বেশ দুরে৷ একটা গাড়ি ভাড়া করে ছিল৷ গাড়ি চলতে চলতে সেলিম দেখল, দুটি কিশোরি দাঁড়িয়ে৷ ফাঁকা রাস্তা৷ সেলিম ড্রাইভার কে গাড়ি থামাতে বললো৷ জানালা দিয়ে ডাক দিল, তোমরা ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন? তোমরা কোথায় যাবে বলো,আমি পৌঁছে দেব৷
মেয়ে দুটি ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো৷ একজন ঘাড় নেড়ে বললো ,না৷ বাস এসে যাবে৷
ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট নিল৷সেলিম স্পষ্ট শুনতে পেল, মেয়ে দুটি আলোচনা করছে ,কি জানি আতঙ্কবাদি কিনা৷ এক জন বললো, আমার তো মুসলমান দেখলেই ভয় হয়৷
সেলিম সে দিন চুল দাঁড়ি কামিয়ে ফেলেছিল৷ মুসলমানের কোন চিহ্ন রাখল না শরীরে৷ আব্বু ঘাড় ধাক্কা দিল৷ আশ্রয় নিল ভাড়া বাড়িতে৷ ভাড়া দিতে মানুষ ভয় পায় তাদের কে৷ সেলিম সে দিন বুঝেছিল৷
কেউ রাম নামে রাজনীতি করছে৷ কেউ আল্লার নামে মানুষ খুন করছে৷ সেলিম এখন শুধু মানুষ হতে চায়৷
ইউনিভার্সিতে কমলিকার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল৷ এক সন্ধেতে কমলিকার সঙ্গে দেখা করে সেলিম বলেছিল,আমি তোমায় ভালবাসি কমলিকা৷
কমলিকা বলেছিল,সমাজ ধর্ম মানবে না৷
সেলিম বলেছিল,চল আমরা পালিয়ে যাই৷ যেখানে সমাজ নেই, রাজনীতি নেই, ধর্ম নেই৷
কমলিকা হাসতে হাসতে বলেছিল,এমন দেশ আমার জানা নেই৷
সেলিম অনেক বুঝিয়ে ছিল৷ কিছুতেই বুঝতে চায় নি কমলিকা৷
আমি ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে সেলিম৷ বাবা কে মন্দিরে ঢুকতে দেবে না৷ পুজোর আয়ে আমাদের সংসার চলে৷
সেলিম সে দিনও আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল চাঁদ কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে৷ আর চাঁদের প্রতি তার আকর্ষন নেই৷ চাঁদ কে তার বিশ্বাসঘাতক বলে মনে হয়৷
সেলিম আবার ঘুমোবার চেষ্টা করলো৷ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল৷ চলে গেল স্বপ্নের জগতে৷
রক্ত৷ চারিদিকে শুধু রক্ত৷ রাম ,রহিমের ভক্তদের যুদ্ধ চলছে৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে শহর৷
সেলিম দেখে এক দল বুদ্ধিজীবী ছুটে আসছে৷ মুখে তাদের একটি নিরিহ পশুর মাংসর টুকরো৷ রক্তে তাদের জীব, দাঁত লাল হয়ে আছে৷ সেলিম দেখছে, তারা তাদের নিজেদের ধর্মের সর্বনাশ করে তার ধর্মের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে৷
ঘুম ভেঙে যায় সেলিমের৷ রাস্তায় নেমে পড়ে৷ ভোরের আলো ফুটতে তখনো অনেক দেরি৷ পথ শিশুরা পথেই ঘুমিয়ে৷ পথের মানুষ রা সব নিশ্চিন্তে ঘুমের দুনিয়ায়৷ এক দল কালো মুখোশ পরা মানুষ ছুটে আসে সেলিমের দিকে৷গুলি বর্ষন চলতে থাকে৷ ঘুমন্ত মানুষ রা মৃৃৃৃত্যুর মুখে ঢোলে পড়ে৷ সেলিম চিৎকার করে ওঠে৷আমি সেলিম৷ আমি তোমাদের মত৷ ধর্ম এক৷ রক্ত এক৷
সেলিমের কথা কারুর কানে পৌঁছায় না৷ গুলি ছুড়তে থাকে৷ লুটিয়ে পড়ে সেলিম৷ এক দৃৃৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে৷ মেঘের কোলে লুকিয়ে থাকা চাঁদ কে খুঁজতে থাকে৷ চলে যায় চাঁদের দেশে৷ অস্পষ্ট শব্দে বলতে থাকে আলো দাও, আলো দাও৷