‘আমি যেন এক দ্রুতগামী ট্রেনের যাত্রী। আমার আশা, আকাঙ্খা নিয়ে ছুটে চলছি। হঠাৎ করেই কেউ, যেন এক টিকিট চেকার, কাঁধে হাত দিয়ে আমায় বলল নেমে যেতে। আমি অনুরোধ করলাম, আমার গন্তব্য আসেনি। আমি নামতে চাই না। কিন্তু আমাকে বারবার বলা হচ্ছে যাত্রা শেষ করতে।‘ মাসখানেক আগের ইরফান খানের করা এই ট্যুইটটাই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে মনের মধ্যে। এর মধ্যে কোনো তারকাচিত দ্যুতি নেই, বৈভব নেই, গরিমাও নেই। কেবল এই পৃথিবীতে থেকে জীবনকে উদযাপন করার আপরিসীম ইচ্ছা আছে। হয়তো আমাদের মতনই অজস্র মানুষ চেয়েছিলেন ইরফান সুস্থ হয়ে যাক। ফিরে আসুক স্বমহিমায়। যখন বারবার ওঁর অসুস্থতার কথা সামনে এসেছে, কাগজে, অনলাইনে, টিভিতে দেখেছি ওঁর চিকিৎসা চলার সমাচার, নিজের মনেই নিজের অজান্তেই প্রতিবার প্রার্থনা করেছি ওঁর আরোগ্যের। ঠিক কি কারণে জানিনা, তবে এই প্রথমবার বাণিজ্যনগরীর চলচ্চিত্র সাম্রাজ্যের কোনো তারকার প্রয়াণে বড় শূন্য বোধ হচ্ছে। এ যেন কোনো আত্মীয় বিয়োগের বিষণ্ণতা। এর সঠিক কি কারণ আমার জানা নেই, তবে যে কারণটা মুখ্য বলে মনে হচ্ছে, তা এই রকম। ইরফান কোনো ছবি করিয়ে বাড়ির ছেলে নন, কোনো অত্যাধুনিক শহুরে বিনোদনও ওঁর শৈশবকে অতিরঞ্জিত করে রাখেনি। রাজস্থানের খাজুরিয়া গ্রামের এক সাদামাটা মুসলিম পরিবারে ওঁর জন্ম, বড়ো হওয়া। ভারতীয় ক্রিকেটে নির্বাচিত হওয়ার পরও আর্থিক দুর্বলতার কারণে তাঁর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনা। অতঃপর এন এস ডি, স্কলারশিপ, অভিনেতা হওয়ার দৌড় শুরু। বলা বাহুল্য, খ্যাতি, গুণ, প্রাচুর্য এবং শৈল্পিক নান্দনিকতার যে উচ্চতায় তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার রাস্তা তাঁর নিজের তৈরি করা। আর এখানেই তিনি আপামোর সাধারণ মানুষের কাছে নিকট আত্মীয়। রাজস্থান বা উত্তর প্রদেশের কোনো সুদূর গ্রামে যে ঘরোয়া ছেলেটা বা মেয়েটা বলিউডে পা ফেলার স্বপ্ন দেখে, তাদের সেই স্বপ্ন দেখার সাহসকেই কয়েক’শ ধাপ অবলীলায় বাড়িয়ে দেন ইরফান খান। আর এখানেই তিনি আলাদা, বলিউডের সমস্ত ঘষামাজা হিসেব কেটে সম্রাট হয়েও এখানেই তিনি সর্বসাধারণের নিকট আত্মীয়। এই লেখা তাঁর ছবির বিষয়ে নয়, তাঁর কাজের প্রশংসা বা আলোচনারও নয়। এই লেখা যখন ছেপে বেড়োবে, ততক্ষণে ইরফান খানের ভৌত উপস্থিতিটা আর হয়তো থাকবেওনা মুম্বইতে। শুধু সিনেমার সঙ্গে যুক্ত থাকা বা না-থাকা অনেক মানুষের অন্তরে, কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আর ডিভিডি, সিডি, সেলুলয়েডে একইরকম থেকে যাবে ওঁর অভিজাত উপস্থিতি। ইরফান তাঁর সব ছবিতেই কোথাও না কোথাও যেন আমাদের চারপাশে দেখা মানুষ হয়েই থেকে যান। ‘দ্য নেমসেক’র আটপৌরে বাঙালি অশোক গাঙ্গুলী থেকে ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’র কিছুটা কনফিউজড, বেশী বয়সী, উচ্ছ্বল মন্টি – এরা সবাই রোজ আমাদের সঙ্গে বাসে-ট্রামে চড়ে অফিসে যায়, সিনেমা দেখতে যায়, ময়দানে বসে গল্প করে। ইরফাননিজেরযোগ্যসম্মানপেয়েছিলেনঅনেকপড়ে।তাঁরযাত্রাপথেকোনোফিল্মিপরিবারেরআনুকূল্যবাকোনোসহৃদয়শিল্পীরঅকস্মাৎকাকতালীয়সাহচর্যওছিলোনা।নিজেরপরিশ্রমে, বছরেরপরবছরএকটুএকটুকরেনিজেরচেষ্টায়নিজেরজায়গাতৈরীকরেনিয়েছিলেনএইতথাকথিত ‘আউটসাইডার’।ওঁরশরীরেস্বভাবসিদ্ধহিন্দীছবিরনায়কোচিতকোনোস্বপ্নিলদীপ্তিছিলোনা।আরইরফানসেটারধারওধারেননিকখনও।প্রসঙ্গতসেইজন্যেইতিনিসাধারণমানুষেরসেইস্বপ্নেরবলিউডআরতাদেরনিজেদেরপ্রতিনিধিস্বরূপঅবয়বেরমধ্যেএকসুষমসেতুগড়েতুলতেপেরেছিলেন, যেটাআজপর্যন্তভারতীয়চলচ্চিত্রেরইতিহাসেখুবকমসংখ্যকশিল্পীইকরতেসক্ষমহয়েছিলেন।আরসেখানেইতিনিরাজা।অধ্যাবসায়, নন্দনবোধএবংসততারসংমিশ্রণেইযেএকজনআদ্যান্তশিল্পীহওয়াযায়, এবংকোনোশিবিরেরতাঁবেদারিনাকরেওযেসম্পূর্ণভিন্নএকধারাকেসগৌরবেএনেদাঁড়করিয়েদেওয়াযায়একদমসাধারণমানুষেরসামনে, সেটাআবারওপ্রমাণকরেদিয়েছিলেনইরফান। খবরটাআসারপরথেকেইশোকপ্রকাশকরেছেনসকলে।ইরফানরেখেগেছেনস্ত্রীসুতপাশিকদার, সন্তানবাবলিওঅয়নকে।এখনক’দিনসবচ্যানেলেইরফানথাকবেন।ওঁকেনিয়েইশিরোনামহবে, আলোচনাহবে।শেষবারেরমতনরাজারহাসিতেঝলমলকরবেওঁরমুখটা।তারপরকালেরনিয়মেআস্তেআস্তেচাপাপড়তেথাকবেএইসমস্তআলোচনা, স্মৃতিচারণ।কেবলসিনেমারইতিহাসেউজ্জ্বলউপস্থিতিথেকেযাবে ‘দ্যনেমসেক’-এরআশোকগাঙ্গুলি, ‘মকবুল’-এরমকবুল, ‘ইয়েসালিজিন্দেগি’-এরঅরুণবা ‘দ্যলাঞ্চবক্স’-এরসাজনফার্নান্ডেজের।আজথেকেবহুবছরপরেভারতেরকোনোপ্রত্যন্তগ্রামেবসেআবারওঅভিনেতাহওয়ারস্বপ্নদেখবেঅন্যকোনোইরফান।শিল্পীরমৃত্যুহয়না, ইরফানখানওবেঁচেথাকবেনএকঅপ্রতিরোধ্য, অদম্যপ্রাণরসেরস্বতস্ফুর্তউদযাপনহয়ে।শুরুর ট্যুইটটার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বলা যায়, সেই জার্নিটায় ওঁকে ট্রেন থেকে কোনোদিনও নেমে যেতে হবেনা, সেখানে ওঁ অমর, সেই অন্তহীন যাত্রাপথের উদ্দেশ্যেই এবার সত্যি সত্যিই পাড়ি দিলেন ইরফান।