• Uncategorized
  • 0

অন্তহীন ইরফান

লিখেছেন – সঞ্জীবন হাটী 

আমি যেন এক দ্রুতগামী ট্রেনের যাত্রী। আমার আশা, আকাঙ্খা নিয়ে ছুটে চলছি। হঠাৎ করেই কেউ, যেন এক টিকিট চেকার, কাঁধে হাত দিয়ে আমায় বলল নেমে যেতে। আমি অনুরোধ করলাম, আমার গন্তব্য আসেনি। আমি নামতে চাই না। কিন্তু আমাকে বারবার বলা হচ্ছে যাত্রা শেষ করতে।‘  

মাসখানেক আগের ইরফান খানের করা এই ট্যুইটটাই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে মনের মধ্যে। এর মধ্যে কোনো তারকাচিত দ্যুতি নেই, বৈভব নেই, গরিমাও নেই। কেবল এই পৃথিবীতে থেকে জীবনকে উদযাপন করার আপরিসীম ইচ্ছা আছে। হয়তো আমাদের মতনই অজস্র মানুষ চেয়েছিলেন ইরফান সুস্থ হয়ে যাক। ফিরে আসুক স্বমহিমায়। যখন বারবার ওঁর অসুস্থতার কথা সামনে এসেছে, কাগজে, অনলাইনে, টিভিতে দেখেছি ওঁর চিকিৎসা চলার সমাচার, নিজের মনেই নিজের অজান্তেই প্রতিবার প্রার্থনা করেছি ওঁর আরোগ্যের। ঠিক কি কারণে জানিনা, তবে এই প্রথমবার বাণিজ্যনগরীর চলচ্চিত্র সাম্রাজ্যের কোনো তারকার প্রয়াণে বড় শূন্য বোধ হচ্ছে। এ যেন কোনো আত্মীয় বিয়োগের বিষণ্ণতা। এর সঠিক কি কারণ আমার জানা নেই, তবে যে কারণটা মুখ্য বলে মনে হচ্ছে, তা এই রকম। ইরফান কোনো ছবি করিয়ে বাড়ির ছেলে নন, কোনো অত্যাধুনিক শহুরে বিনোদনও ওঁর শৈশবকে অতিরঞ্জিত করে রাখেনি। রাজস্থানের খাজুরিয়া গ্রামের এক সাদামাটা মুসলিম পরিবারে ওঁর জন্ম, বড়ো হওয়া। ভারতীয় ক্রিকেটে নির্বাচিত হওয়ার পরও আর্থিক দুর্বলতার কারণে তাঁর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনা। অতঃপর এন এস ডি, স্কলারশিপ, অভিনেতা হওয়ার দৌড় শুরু। বলা বাহুল্য, খ্যাতি, গুণ, প্রাচুর্য এবং শৈল্পিক নান্দনিকতার যে উচ্চতায় তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার রাস্তা তাঁর নিজের তৈরি করা। আর এখানেই তিনি আপামোর সাধারণ মানুষের কাছে নিকট আত্মীয়। রাজস্থান বা উত্তর প্রদেশের কোনো সুদূর গ্রামে যে ঘরোয়া ছেলেটা বা মেয়েটা বলিউডে পা ফেলার স্বপ্ন দেখে, তাদের সেই স্বপ্ন দেখার সাহসকেই কয়েক’শ ধাপ অবলীলায় বাড়িয়ে দেন ইরফান খান। আর এখানেই তিনি আলাদা, বলিউডের সমস্ত ঘষামাজা হিসেব কেটে সম্রাট হয়েও এখানেই তিনি সর্বসাধারণের নিকট আত্মীয়।  

এই লেখা তাঁর ছবির বিষয়ে নয়, তাঁর কাজের প্রশংসা বা আলোচনারও নয়। এই লেখা যখন ছেপে বেড়োবে, ততক্ষণে ইরফান খানের ভৌত উপস্থিতিটা আর হয়তো থাকবেওনা মুম্বইতে। শুধু সিনেমার সঙ্গে যুক্ত থাকা বা না-থাকা অনেক মানুষের অন্তরে, কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আর ডিভিডি, সিডি, সেলুলয়েডে একইরকম থেকে যাবে ওঁর অভিজাত উপস্থিতি। ইরফান তাঁর সব ছবিতেই কোথাও না কোথাও যেন আমাদের চারপাশে দেখা মানুষ হয়েই থেকে যান। ‘দ্য নেমসেক’র আটপৌরে বাঙালি অশোক গাঙ্গুলী থেকে ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’র কিছুটা কনফিউজড, বেশী বয়সী, উচ্ছ্বল মন্টি – এরা সবাই রোজ আমাদের সঙ্গে বাসে-ট্রামে চড়ে অফিসে যায়, সিনেমা দেখতে যায়, ময়দানে বসে গল্প করে।

ইরফান নিজের যোগ্য সম্মান পেয়েছিলেন অনেক পড়ে। তাঁর যাত্রাপথে কোনো ফিল্মি পরিবারের আনুকূল্য বা কোনো সহৃদয় শিল্পীর অকস্মাৎ কাকতালীয় সাহচর্যও ছিলোনা। নিজের পরিশ্রমে, বছরের পর বছর একটু একটু করে নিজের চেষ্টায় নিজের জায়গা তৈরী করে নিয়েছিলেন এই তথাকথিতআউটসাইডার ওঁর শরীরে স্বভাবসিদ্ধ হিন্দী ছবির নায়কোচিত কোনো স্বপ্নিল দীপ্তি ছিলোনা। আর ইরফান সেটার ধারও ধারেননি কখনও। প্রসঙ্গত সেই জন্যেই তিনি সাধারণ মানুষের সেই স্বপ্নের বলিউড আর তাদের নিজেদের প্রতিনিধি স্বরূপ অবয়বের মধ্যে এক সুষম সেতু গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, যেটা আজ পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে খুব কম সংখ্যক শিল্পীই করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর সেখানেই তিনি রাজা। অধ্যাবসায়, নন্দনবোধ এবং সততার সংমিশ্রণেই যে একজন আদ্যান্ত শিল্পী হওয়া যায়, এবং কোনো শিবিরের তাঁবেদারি না করেও যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধারাকে সগৌরবে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় একদম সাধারণ মানুষের সামনে, সেটা আবারও প্রমাণ করে দিয়েছিলেন ইরফান।  

খবরটা আসার পর থেকেই শোকপ্রকাশ করেছেন সকলে। ইরফান রেখে গেছেন স্ত্রী সুতপা শিকদার, সন্তান বাবলি অয়নকে। এখন দিন সব চ্যানেলে ইরফান থাকবেন। ওঁকে নিয়েই শিরোনাম হবে, আলোচনা হবে। শেষবারের মতন রাজার হাসিতে ঝলমল করবে ওঁর মুখটা। তারপর কালের নিয়মে আস্তে আস্তে চাপা পড়তে থাকবে এই সমস্ত আলোচনা, স্মৃতিচারণ। কেবল সিনেমার ইতিহাসে উজ্জ্বল উপস্থিতি থেকে যাবেদ্য নেমসেক’-এর আশোক গাঙ্গুলি, ‘মকবুল’-এর মকবুল, ‘ইয়ে সালি জিন্দেগি’-এর অরুণ বাদ্য লাঞ্চবক্স’-এর সাজন ফার্নান্ডেজের। আজ থেকে বহুবছর পরে ভারতের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে বসে আবারও অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখবে অন্যকোনো ইরফান। শিল্পীর মৃত্যু হয়না, ইরফান খানও বেঁচে থাকবেন এক অপ্রতিরোধ্য, অদম্য প্রাণরসের স্বতস্ফুর্ত উদযাপন হয়ে। শুরুর ট্যুইটটার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বলা যায়, সেই জার্নিটায় ওঁকে ট্রেন থেকে কোনোদিনও নেমে যেতে হবেনা, সেখানে ওঁ অমর, সেই অন্তহীন যাত্রাপথের উদ্দেশ্যেই এবার সত্যি সত্যিই পাড়ি দিলেন ইরফান।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।