• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৯১)

পর্ব – ৯১

৯০

শ‍্যামলী কারখানায় ঢুকে দেখল তখনও দুজন মজুর গাড়ি নিচে শুয়ে কাজ করছে। সে হেডমিস্ত্রিকে বলল, ছটা যে অনেকক্ষণ বেজে গেছে। এবার ওদের কাজ গুটোতে বলুন।
হেডমিস্ত্রি একগাল হেসে বলল, আজ অনেক কাজ এসেছে। সব ক’টা আজ নিতে পারি নি। কাল করে দেব, কথা দিয়েছি। ফোনে অনেক কাজ এল।
শ‍্যামলী বলল, আজ আপনি বাকি বোনাসটা পেয়ে যাবেন।
হেডমিস্ত্রি অবাক হয়ে বলল, পেয়ে যাব?
শ‍্যামলী গম্ভীর হয়ে বলল, হ‍্যাঁ। পাবেন। গাড়ি সারানোর বকেয়া টাকাটা পুরোটা পাওয়া গিয়েছে। তারপর শ‍্যামলী বলল, কই আজকের হিসাব দেখান।
কারখানা থেকে বেরিয়ে পড়ার আগে সে হেডমিস্ত্রিকে হুকুম দিল আজ বোনাস মিটিয়ে দিয়েছি। ছেলে বৌয়ের জন‍্য আজই নতুন জামাকাপড় কিনে নিয়ে যাবেন। তারপর বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ তো ভাল কাজ হয়েছে। কালও এমন কাজ হলে রুটি আর ডিমের কারি হবে। তারপর হেডমিস্ত্রির দিকে তাকিয়ে বলল, সকালে উঠে দোকানে অর্ডার দিয়ে দেবেন।
বাচ্চা শ্রমিকটি উদাস হয়ে এক কোণে বসেছিল। শ‍্যামলী তাকে জিজ্ঞাসা করল, কি রে বাড়ি যাস্ নি কেন? সে উত্তর না দিয়ে মুখ গোঁজ করে অন‍্য দিকে তাকিয়ে র‌ইল। শ‍্যামলী ধমকে উঠে বলল, কি হল কি, বড়রা কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিতে হয়, জানিস্ না?
সে তখন বলল, ছোড়দি, তোমাকে বাড়ি না পৌঁছে আমি কোনো দিন বাড়ি যাই না, তুমি সেটা ভালোই জানো।
শ‍্যামলী হেসে বলল, তবে চ, আমায় পৌঁছে দিবি।
কারখানা থেকে বেরিয়ে পড়ল সে। চলল পোশাকের দোকানে। বাচ্চা শ্রমিকটা বলল, এদিকে যাচ্ছ কেন? তোমার ঘর তো ওদিকে।
শ‍্যামলী তাকে আলতো করে একটা চাঁটি মেরে বলল, আমার সঙ্গে যাবি তো চ। ন‌ইলে পালা।
ওকে নিয়ে পোশাকের দোকানে ঢুকল শ‍্যামলী। দোকানিকে বলল, এরজন্য একটা প‍্যান্ট আর দুটো শার্ট দেবেন। তারপর ছেলেটাকে বলল, ফুলপ‍্যান্ট নে। বড় হচ্ছিস।
তারপর বিল মিটিয়ে তার হাতে দশটা টাকা দিয়ে শ‍্যামলী বলল পুজোয় ঠাকুর দেখতে গিয়ে ক‍্যাম্পা কোলা খাস্। দোকানি তা দেখে হেসে বলল, আমাদের ছোটবেলায় কোকাকোলা ছিল। কি টেস্ট! এখন আর পাওয়া যায় না।
তার পর ছেলেটাকে বলল, প‍্যান্টটা পরে দেখে নাও খোকা। কাল বিকেলে বন্ধ দেব।
কাতর মুখে ছেলেটা শ‍্যামলীর দিকে চাইল।
শ‍্যামলী জানে, এ ছেলেটা  অন্তর্বাস পরে না। দোকানদারকে বলল এর বয়সী ছেলের জাঙ্গিয়া আছে এখানে?
বাচ্চা শ্রমিকটার হাতে সেটা দিয়ে বলল, ফুলপ‍্যান্ট পরলে ভিতরে এটা পরবি। পরতে হয়।
বাচ্চাটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
তারপর দোকানদারকে শ‍্যামলী বলল, একটা কমবয়সী বিধবা মানুষের শাড়ি দেখান তো।
কারখানার কালেকশন আর নিজের স্কলারশিপের টাকা কিছুতেই মেলায় না শ‍্যামলী। টুক করে দেখে নিল, নিজের কাছে ঠিক কত টাকা আছে।
ফেরবার সময় দোকানি বলল, আপনি দরদাম করেন না, এটা আমাদের খুব ভাল লাগে।
শ‍্যামলী হেসে উঠল। বলল, কেন, দরদাম করতে জানি না বলে কি আমায় বোকা ঠাউরালেন?
দোকানি বলল, না, একেকজন বড্ড কষাকষি করে। আমাদের জেদ ধরে যায়। আমাদের পুঁজি কম। তবে ওভারহেড‌ও কম। দোকান সাজাতে পারি নি। ঝলমলে কাচের শোকেস আনতে পারিনি। দোকানে ঢুকলেই ঠাণ্ডার বোতল দেবার কথা ভাবতে পারি না। কিন্তু দোকানি যা দেয়, কোনো কিছুই নিজের পকেট থেকে দেয় না। সব খদ্দের সেটা বুঝতে পারে না। তারা ছোটো দোকানে বড্ড দরদাম করে আর বড় দোকানের দেখনদারির কাছে গলে যায়।
একটা রিকশাচালক জড়ানো গলায় হিন্দি ছবির গান গাইতে গাইতে আসছে। দোকানি বলল, পুজোর দিনে একটু বেশি পয়সা হাতে আসতেই সাততাড়াতাড়ি নেশা করে ফেলেছে। চল্লিশ বছর, জোর পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই ফুটে যাবে এরা। তদ্দিনে তিন চারটে ছেলেমেয়ের বাপ হয়ে গেছে। চলে যখন যাবে, তখন ছোটোটা দশ পেরোয় নি। আর বড়টা নেশা করা ধরেছে।
বাচ্চা শ্রমিকটা সে কথা শুনে চোখে হাত চাপা দিল। শ‍্যামলী তার হাতের নড়া ধরে টান দিয়ে বলল, চ, আমায় বাড়ি পৌঁছে দিবি না? কান্নার দমকে বাচ্চাটা কথা বলতে পারছিল না। সে আজ এত ভালবাসা পেয়ে নিজের মরা বাবাকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
মদের নেশায় লিভার পচিয়ে বড় অসময়ে মরে গেছে ওর বাবা। মরে গিয়ে ওকে উপহার দিয়ে গেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
নিজের ভায়েদের কথা মনে পড়ল শ‍্যামলীর। নিজের দিদির শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে দিদির ব‍্যাগ থেকে টাকা চুরি করে সেই টাকায় নেশা করে ফিরে জামাইবাবুর কাছে ঘাড়ধাক্কা খেয়েছে। অথচ সেই নিয়ে মা স্পিকটি নট।
বর্ণপরিচয়কার ভুবনের গল্প বলেছেন। ভুবন তার মাসির কান কামড়ে দিয়েছিল। সন্তানের বেচাল দেখলে সঠিক সময়ে সঠিক শাসন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ। কিন্তু তিনি তাঁর মৃত্যুর তিরানব্ব‌ই বছর পরেও স্বদেশবাসীর চেতনায় স্থান পান নি। পূজা কিছু কিছু পেয়েছেন। ভালবাসা পান নি। পথ চলতে চলতে, “তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি,” গানটা মনে করার চেষ্টা করে শ‍্যামলী। গানের সুরটি অন্তরের গহন থেকে টেনে আনে গানের বাণীকে।
তোমার পূজার   ছলে তোমায়   ভুলেই থাকি।
বুঝতে নারি   কখন্‌ তুমি   দাও-যে ফাঁকি ॥
ফুলের মালা   দীপের আলো   ধূপের ধোঁওয়ার
পিছন হতে   পাই নে সুযোগ   চরণ-ছোঁওয়ার,
স্তবের বাণীর   আড়াল টানি   তোমায় ঢাকি ॥
দেখব ব’লে   এই আয়োজন   মিথ্যা রাখি,
আছে তো মোর   তৃষা-কাতর   আপন আঁখি।
কাজ কী আমার   মন্দিরেতে   আনাগোনায়–
পাতব আসন   আপন মনের   একটি কোণায়,
সরল প্রাণে   নীরব হয়ে   তোমায় ডাকি ॥

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।