• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ১৩)

কু ঝিক ঝিক দিন

১৩.

অমর জ্যেঠুর বাড়িটা অনেক কারনেই আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল। টিভি ফ্রিজ টেলিফোনের পাশাপাশি তাদের বিশাল বাড়ির একতলার কোনার দিকে এসবেসটাস দেওয়া দুটো ঘরও ছিল।এই ঘরে ভাড়া নিয়ে এসেছিল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মলয় কাকু।পাড়াতে সবার প্রথম আমার সঙ্গেই তার পরিচয় হয়।এবং সেই সূত্রে তিনি দ্রুত হয়ে উঠলেন আমার বন্ধু বড়কাকু আর আমি তার বন্ধু মনদিদি।
তার ঘরে আমার অগাধ বিচরণ। সেই বিচরণের পিছনে একদিকে যেমন গল্প শোনার আকর্ষণ ছিল, তেমনি তার তাকে রাখা সারি সারি কাচের কৌটোও ছিল।তাতে রাখা থাকত নানান ধরনের চানাচুর,বাদাম,কাজু বাদাম,কিসমিস, ও লজেন্স। কাকু নিজে এর কোনোটাই সেভাবে খেত না।সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতাম আমরা বোনেরা ও আমাদের বন্ধুরা।
কাকু অফিস যাওয়ার আগে দরজাটা ভেজিয়ে রেখে বাথরুমে যেত।আমাদেরও তখন স্কুলে যাওয়ার তাড়া।তারমধ্যেই এক দৌড়ে চলে যেতাম তার ঘরে।তারপর সেই কাচের জারগুলো থেকে যতটা সামগ্রী হাতের মুঠোয় ধরত নিতাম,বন্ধুরাও একই পদ্ধতিতে নিয়ে নিত।
এটা যে চুরি করা সেটা কোনোদিন মাথাতেও আসেনি।বরং মনে হত এগুলো আমার জন্যেই রাখা।কিন্তু একটা জিনিস মনে হত,রোজ জারগুলো আমরা ফাঁকা করে দিই,পরদিন সকালেই আবার কী করে ভরতি হয়ে যায়!কাকু কি বুঝতে পারে না যে আমরা এগুলো রোজ খেয়ে নিই!কিন্তু সেগুলো নিয়ে ভাবনাটা এতই সাময়িক ছিল যে পরদিন আবার সব ভুলে চুপিচুপি ঢুকে সব নিয়ে নিতাম।
মা বাবার সঙ্গেও বড় কাকুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।কাকু বইয়ের পোকা।আর আমার বাবা সম্পাদক, প্রকাশক।তাছাড়া বাবার অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব নারী পুরুষ বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাইকেই সমান আকর্ষণ করত।কাকুরও তখন কাজ শেষে একা লাগে।ফলত আমাদের সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হল।
একদিন কাকু কথার ছলে মাকে বলেছিল, বৌদি আপনি একটু মোটা হয়ে যাচ্ছেন।
আমার ছোটোবোন মায়ের ব্যাপারে অস্বাভাবিক পজেসিভ।তার মনে হয় মা একমাত্র তার।কাজেই মাকে মোটা বলা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারল না।মেজবোনও মা ন্যাওটা।ফলে তারা দুজনে মিলে ষড়যন্ত্র করল,কাকুকে শাস্তি দেবার।আমার মেজবোন কখনো আমাকে কিছু লুকাতো না।কিন্তু এই বিষয়টা লুকিয়ে গেল।সম্ভবত তার মনে হয়েছিল কাকুর আদরের মনদিদি জানলে তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাবে।
কাকু একদিন অফিস যাবার জন্য তৈরি হবে বলে স্নানে ঢুকেছে। সেই ফাঁকে তারা দুটো ইটের ফাঁকে রেখে এল একটা ব্লেট উঁচু করে।যাতে পা পড়লেই কেটে যায়।
কাকু অফিস থেকে ফিরে পায়ে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে আমাদের বাড়ি এল।মা কাকুর ওই অবস্থা দেখে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করল।ওষুধ লাগাবার জন্য ব্যস্ত হল।
কাকু সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে খালি বলল,কে যে ব্লেড রেখে দিয়েছিল,খেয়াল করিনি,পা ঘন ভাবে কেটে গেছে। আর একটু হলে হয়তো পা টা বাদই দিতে হত।তবে এখন আর চিন্তা করবেন না,আমি ওষুধ লাগিয়ে নিয়েছি।
কিন্তু কে এভাবে ব্লেড রাখল!মায়ের অনুসন্ধানী মন। পৃথিবীর সব শিশুর মায়েরাই সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা হয়।আমার মাও সেরকম ভাবেই আমাদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল ঠিক কী ঘটেছে!
কাকু বলল,সে কি করে জানব!হয়তো আমিই ছুঁড়ে বাইরে ফেলেছি।
এবার কাকুর ওই অবস্থা দেখে দুই বোন কেঁদে ফেলল।মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,আমরাই করেছি।তোমাকে মোটা বলেছিল বলে।কিন্তু সত্যি যে এমন হবে ভাবতে পারিনি।মা তো রেগে আগুন।
আমার মাকে দেখে সেই মুহূর্তে সুকুমার রায়ের গোঁফ চুরি কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল।নিজের মনেই বলে উঠলাম-রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি,
“কারো কথার ধার ধারিনে, সব ব্যাটাকেই চিনি ।
নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা,এমন গোঁফ তো রাখতো জানি শ্যামবাবুদের গয়লা ।
কিন্তু কাকুর তো গোঁফ চুরি যায় নি।যা গেছে সেটা অবশ্য গোঁফের থেকেও ভয়াবহ। এখন কি উপায় মায়ের হাত থেকে বাঁচার!
কাকু কিন্তু একটা কথাও বলল না। শুধু বলল,আর কোরো না বেশ।পা টা যদি বাদ হয়ে যেত আমি তো হাঁটতে পারতাম না।তখন তোমাদেরই আমাকে ধরে ধরে অফিস নিয়ে যেতে হত।আমার তো এখানে কেউ নেই তোমরা ছাড়া।
কাকুর আসল বাড়ি ছিল খড়গপুর।এখানে সে আর ছোটোকাকু থাকত।আত্মীয় পরিবার পরিজন হয়ে উঠেছিলাম আমরাই।ফলে বোনেরা কান্না জুড়ে দিল,অন্যায় হয়ে গেছে বলে।
পরদিন সকালে দেখি কাকু স্বাভাবিকভাবেই হাঁটছে।ব্যান্ডেজ বাঁধাটাও খোলা।
আসলে হয়েছিল কী,কাকু বাথরুম থেকেই লক্ষ করেছিল তাদের কান্ডকারখানা। বেরিয়ে এসে ব্লেডটা সরিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে ঢুকেছিল।কিন্তু বোনেরা নিজেরাই যাতে দোষ স্বীকার করে নেয় এবং অনুতপ্ত হয় তাই এই অভিনয়।
এর কদিন বাদেই কাকু অন্য জায়গায় চলে গেল।যাবার আগে ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল জানতে, রোজ আমরা নিচ্ছি কাজু,কিসমিস, আখরোট,চানাচুর জেনেও কেন আবার ভরতি করে রাখত সেগুলো!কেনই বা কখনো এই নিয়ে বকেনি।অভিযোগ করেনি।
উত্তরটা পেয়েছিলাম বহুদিন বাদে।কাকু যখন কাকিমাকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল,আর সঙ্গে নিয়ে এল প্যাকেট ভরতি সেই পছন্দের জিনিসগুলো।সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম,কাকু সব জেনেও শুধু আমি ও আমার নেতৃত্বে আসা বন্ধুদের জন্যই এনে রাখত ওগুলো।কারন ওগুলো যে তার মনদিদির বড় প্রিয়।
আজ এতবছর পরে নিজের ঘরে মুঠোমুঠো এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও খাওয়া হয় না। ওই চুরি করে খাওয়ার স্বাদ আর ফিরে আসে না।আমি যে আর কোনোভাবেই ফিরে যেতে পারি না আমার দশ এগারো বছরে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।