• Uncategorized
  • 0

স্মরণে কাদম্বরী দেবী – লিখেছেন যশোবন্ত‌ বসু

মরণঘুম

মোটে ৯ বছর ২ মাস। মেয়েটি এই নিতান্ত বালিকা বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিল এই বাড়িতে। সদ্য যুবা স্বামীটি তখন এই জমিদার বাড়ির সবচেয়ে উজ্জ্বল সন্তান। সর্ব গুণান্বিত ও বিখ্যাত। সাহিত্যচর্চা, নাট্যাভিনয় ও বিচিত্র কাজেকর্মে তিনি সদা ব্যস্ত। বালিকা বধূটির প্রতি মনোযোগী হবার সময় কোথায় তাঁর !
নববধূটি তার চেয়ে বয়সে বছর দেড়েকের ছোট দেওরটিকেই খেলার সাথি হিসেবে পছন্দ করে ফেলল। তার আগে পর্যন্ত মাতৃহারা বালক দেওরটির দিন কেটে যাচ্ছিল হেলাফেলায় এলোমেলো। জীবনে বেঁচে থাকবার মতো স্বচ্ছলতা ছিল যথেষ্ট কিন্তু তাতে স্নেহ ও আদরের নিবিড় ছোঁয়াচটুকুও ছিল না।
“ এমন সময় একদিন বাজল সানাই বারোঁয়া সুরে। বাড়িতে এল নতুন বউ, কচি শ্যামলা হাতে সরু সোনার চুড়ি। পলক ফেলতেই ফাঁক হয়ে গেল বেড়া, দেখা দিল চেনাশোনার বাহির সীমানা থেকে মায়াবী দেশের নতুন মানুষ। দূরে দূরে ঘুরে বেড়াই, সাহস হয়না কাছে আসতে। ও এসে বসেছে আদরের আসনে, আমি যে হেলাফেলার ছেলেমানুষ।”
কিন্তু খুব দ্রুত সংকোচ ও আড়ষ্ট দূরত্বের আড় ভেঙে দেড় বছরের ছোট দেওরটিকে কাছে টেনে নিল বধূটি। সেই দেওর অচিরেই হয়ে উঠল বালিকা বধূর খেলার সাথি।
“ হঠাৎ দূর পাহাড় থেকে বর্ষার জল নেমে সাবেক বাঁধের তলা খইয়ে দেয়, এবার তাই ঘটল। বাড়িতে নতুন আইন চালালেন কর্ত্রী। বউঠাকরুনের জায়গা হল বাড়ির ছাদের লাগোয়া ঘরে। পুতুলের বিয়েতে ভোজের পাত পড়ত সেই খানে। নেমন্তন্নের দিনে প্রধান ব্যক্তি হয়ে উঠত এই ছেলেমানুষ। বউঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভালো, খাওয়াতে ভালোবাসতেন, এই খাওয়াবার শখ মেটাতে আমাকে হাজির পেতেন।”
শৈশবের সেই ছেলেমানুষি, ঝগড়া খুনসুটি, মান অভিমানের রং দুজনেরই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যেতে লাগল। কিশোর দেওরটি যে ভবিষ্যতে জগতখ্যাত কবি হয়ে উঠবে, তার কাব্য ও সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষকে একেবারে চোখের সামনে বিকশিত হতে দেখেছেন দেওরের সকল সৃজনের প্রেরণাদাত্রী নতুন বৌঠান কাদম্বরী।
অজস্র বৃষ্টিদিন, অলস দুপুর, অকেজো মুহূর্ত কেটেছে কবি ও বৌঠানের এক সঙ্গে। এইসব সঙ্গযাপন, মান-অভিমানের অন্তরঙ্গতার মধ্য দিয়ে লেখা হয়েছে ‘শৈশব সঙ্গীত’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’।
সেই সময়ের একেকটি দিন একেকটি সম্পত্তির মতো। ১৯২৬ সালের রচনা
‘একটি দিন’-এ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘মনে পড়ছে সেই দুপুরবেলাটি। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টিধারা ক্লান্ত হয়ে আসে, আবার দমকা হাওয়ায় তাকে মাতিয়ে তোলে।
ঘরে অন্ধকার, কাজে মন যায়না। যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বর্ষার গানে মল্লারের সুর লাগালেম।
পাশের ঘর থেকে একবার সে কেবল দুয়ার পর্যন্ত এল। আবার ফিরে গেল। আবার একবার বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে ভেতরে এসে বসল।
হাতে তার সেলাইয়ের কাজ ছিল, মাথা নিচু করে সেলাই করতে লাগল। তারপরে সেলাই বন্ধ করে জানলার বাইরে ঝাপসা গাছগুলোর দিকে চেয়ে রইল।
বৃষ্টি ধরে এল, আমার গান থামল। সে উঠে চুল বাঁধতে গেল।
এইটুকু ছাড়া আর কিছুই না। বৃষ্টিতে গানেতে অকাজে, আঁধারে জড়ানো কেবল সেই একটি দুপুরবেলা।”
রচনাটির উপসংহার লেখা হচ্ছে এইভাবে,
“একটি দুপুরবেলার ছোটো একটু কথার টুকরো দুর্লভ রত্নের মতো কালের কৌটোর মধ্যে লুকনো রইল। দুটি লোক তার খবর জানে।”
কালের কৌটোর মধ্যে আফিমের গুলিও ছিল, যা সেই সন্তানহীনা, স্বামীসঙ্গহীনা, হতভাগী অভিমানিনী, ভালোবাসার কাঙালিনীকে একেবারে মরণঘুমের মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে।
উনিশ-কুড়ি বছরের বিবাহিত জীবনে এই জমাট কঠিন কষ্ট আর অব্যক্ত ব্যথাটুকুই কাদম্বরীর প্রাপ্তি।
১৮৮৩-র ৯ ডিসেম্বর বাইশ বছরের যুবক রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করলেন দশ বছরের ভবতারিণীকে, পরে কবির নতুন নামকরণে যিনি মৃণালিনী হবেন।
বিয়ের পর থেকেই দেওর রবি নতুন বৌঠানের প্রতি কেমন যেন উদাসীন। একটা ছাড়াছাড়া এড়িয়ে চলার ভাব। বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে নানা কাজে দিন কাটায়। তার অন্য অনেক বন্ধুবান্ধবও জুটেছে। ওদিকে স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জগত নিয়ে মশগুল। বহু পরিশ্রম ও অর্থব্যয়ের ফসল তাঁর জাহাজ ‘সরোজিনী’ জলে ভেসেছে। কিছুদিনের মধ্যেই তার বাণিজ্যিক যাতায়াত শুরু হবে।
৮ বৈশাখ, ১২৯১( ১৯ এপ্রিল,১৮৮৪)। জ্যোৎস্না রাতে গঙ্গাবক্ষে সেই ‘সরোজিনী’ জাহাজে আজ এক পারিবারিক উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। বহুদিন পর আজ কাদম্বরী বাইরে বেরোবেন, যোগ দেবেন পারিবারিক এই আনন্দোৎসবে। সন্ধেবেলায় স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজে আসবেন তাঁকে সেখানে নিয়ে যেতে।
বিকেল থেকেই অনেকটা সময় নিয়ে সযত্নে সাজলেন কাদম্বরী। সন্ধে ছটা থেকেই অধীর অপেক্ষা। ক্রমশ সাত, আট করে দশটা বেজে গেল, এখনও এলেননা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ! এত দেরি তো হবার কথা নয়। এগারোটাও বাজল। তবে কি সেই উৎসব বাতিল হয়ে গেল কোনও কারণে ? কিন্তু তা হলে তো সবাই বাড়ি ফিরে আসবে। তবে কি কাদম্বরীর কথা সবাই ভুলে গেল ? প্রিয় স্বামী, প্রিয় দেওর রবি, সবাই ?
কাদম্বরীর মাথার ভেতর ভীষণ তোলপাড় হতে লাগল। বুক ঠেলে কান্না আসছে অথচ চোখ ভিজছে না জলে, সারা শরীরে অসহ্য ছটফটানি।। কেমন যেন পাগল-পাগল লাগছে। সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে। বড় অশান্ত, অস্থির। ছেঁড়া ছেঁড়া কতরকম চিন্তাই যে মনে আসছে। স্বামী, শ্বশুরবাড়ি আর ১৯-২০ বছরের অন্তরঙ্গ সঙ্গী প্রিয় রবিকে ঘিরে কত অজস্র স্মৃতি।
ক্রমশ সব কিছুর ওপর যেন অবসাদের গাঢ় কালো আস্তরণ এসে পড়ছে। একে একে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে মানবিক অনুভূতিগুলি। একবগ্‌গা মন প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে উঠছে। নিজের ওপরেই কি প্রতিশোধ ? নাকি প্রতিকার, এত দীর্ঘ অপমান আর অবহেলার যোগ্য জবাব ?
চরম সিদ্ধান্তটি কাদম্বরী নিয়েই ফেললেন। আলমারির গোপন স্থান থেকে বেরোল চন্দন কাঠের তৈরি গয়নার বাক্স, ওপরে হাতির দাঁতের সুদৃশ্য কারুকাজ। গয়নার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কাগজের মোড়কে চার খানা কালো রঙের বড়ি। অত্যন্ত কড়া মাত্রার আফিম মিশিয়ে বানানো।
এই গয়নার বাক্সের মধ্যেই লুকিয়ে রাখা আছে তিন খানি চিঠি। একটি পাওয়া গেছল ধোপার কাছে কাচতে দেওয়ার আগে তাঁর স্বামীর এক জোব্বার পকেটে, বাকি দুটি এক মোটা অভিধানের ভাঁজে। চিঠিগুলির কথা কাদম্বরী তাঁর নামী স্বামীকে কোনওদিনই জানাননি।
আবার পড়লেন চিঠিগুলি। একই মেয়েলি হস্তাক্ষরে লেখা, ওপরে সম্বোধনে প্রাণাধিকেষু, তলায় কোনও নাম নেই। পড়ার পর সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মেঝেতে। তারপর সেই চারটি আফিমের বড়িই একসঙ্গে খেয়ে নিলেন।
ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার হিসেবের খাতায় ডাক্তার,বদ্যি ময়নাতদন্ত ইত্যাদির খরচের বিবরণ থেকে অনুমান করা যায়, কাদম্বরীর আত্মহননের চেষ্টার প্রায় দু’দিন পর ২১ এপ্রিল,১৮৮৪ সবরকমের চিকিৎসার আয়োজন ব্যর্থ করে তাঁর সেই কাঙ্ক্ষিত মৃত্যুটি ঘটে।
তথ্যসূত্র –
১) রবীন্দ্ররচনাবলি ( ইন্টারনেট সংস্করণ )
২) রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী/ রিমঝিম রায়, সংযুক্তা দাশ(সিগনেট প্রেস)
৩) প্রথম আলো / সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (আনন্দ পাবলিশার্স)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।