অণুগল্প ১ বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় স্নেহাশীষ চক্রবর্তী
by
·
Published
· Updated
প্রলম্বিতা
দিকচক্রবালের আড়ালে মিলিয়ে গেছে পোস্টমাষ্টারের নৌকা, প্রায় একটা বছর একসাথে বাস । কেমন যেন এক ঘোরে নদীর ঘাটে বসেই আছে রতন, দুটো দিন অতিক্রান্ত । অবসন্ন বিষণ্ণ মনে সে অপেক্ষায়, পোস্টমাষ্টার ফিরে আসবেই । না, আর শরীর টেনে চলতে পারছে না রতন । ধীর পায়ে ফিরে গেল পোস্টমাষ্টারের ভাড়া করা বাড়িতেই । অল্প সিদ্ধভাত খেতে খেতে তার নজরে আসল পোস্টমাষ্টারের ব্যবহার্য কয়েকটি দামি কাঁসার পাত্র । রতন দেরি করল না, সেদিন ছিল হাটবার, হাটে দুটো দামী কাঁসার বাসন সে বিক্রি করল, বিনিময়ে মণিহারী এক দোকান থেকে কিনে আনল একটি সিঁদুরের কৌটো । স্নান সেরে এসে পোস্টমাষ্টারের ব্যবহার্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁথি নিল সিঁদুরে রাঙিয়ে, কপালে পড়ল সিঁদুরের এক বড়ো টিপ । রতন মনে মনে ভাবছে, হে ভগবান, এখন আমাকে মৃত্যু দাও, আমি চলে যাই পরপারে যেখানে আমি অপেক্ষায় থাকব দিগন্ত-বিস্তৃত সময় নিয়ে ।
দরজার আওয়াজে রতনের ঘুম ভাঙল, একি – বাবু আপনি ? পোস্টমাষ্টার জবাব দিলেন, হ্যাঁ রে, তোকে নিয়ে যেতে এসেছি । কিন্তু তোর যে বিয়ে হয়েছে সে খবর তো দিসনি আগে ! রতন জানায় – সে বিয়ে হিন্দুমতে নয়, গান্ধর্বমতে, তাই বলিনি । পোস্টমাষ্টারবাবু জানতে চান, তাহলে তুই কি করে আমার সাথে যাবি, আমি যে তোকে নিতেই এলাম । রতন জানায়, সে যাবে, কারণ তার স্বামী হয়তো তাকে স্ত্রী হিসেবে মনেই রাখেনি । পোস্টমাষ্টার আর কথা বাড়াননি । কারণ গত কয়েক মাসে পোস্টমাষ্টারবাবু নিজে এইটুকু বুঝেছিলেন যে, রতন তাকে খুব ভালোবাসে এবং রতনের এই ভালোবাসায় হয়তো তার অসুস্থ মা সুস্থও হয়ে উঠতে পারেন । পোস্টমাষ্টারবাবু বলেন, নে, তাহলে তাড়াতাড়ি কর, গুছিয়ে নে তুই তোর যা যা নেবার, ঘাটে নৌকা আমি দাঁড় করিয়ে এসেছি । রতন তার পরনের দুটো শাড়ি, নতুন কেনা সিঁদুরের কৌটোটা পুঁটুলিতে নিয়ে রওয়ানা হল পোস্টমাষ্টারবাবুর সাথে ।
সারাপথ বিশেষ কিছু কথা হয়নি । কয়েকমাসের মধ্যেই পোস্টমাষ্টারবাবুর ও তার মায়ের সেবা করতে করতে রতন অসুস্থ হয়ে পড়ল । কয়েকটা দিন পর অসুখ চরমে উঠল । সেদিন মাঝরাতে রতনের কথা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়, হাত পা অসাড়, পোস্টমাষ্টারবাবু সেদিন ছিলেন রতনের কাছেই বসে । রতন পোস্টমাষ্টারবাবুকে কোনোমতে আস্তে আস্তে শুধু বলল, বাবু, গত ক’দিন অসুখে সিঁদুর পড়তে পারিনি, আমি চলে যাচ্ছি তোমার কাছ থেকে চিরতরে, শেষবারের মতো সিঁদুরটা কি তুমি একবার আমার মাথায় দিয়ে দেবে । স্থবির পোস্টমাষ্টার রতনের অবস্থা বুঝে বিনাবাক্যব্যয়ে রতনের সিঁথিতে রাঙিয়ে দিলেন সিঁদুর । অল্পসময়ের মধ্যেই রতন শেষ-শ্বাস নিয়ে মুখবন্ধ করল ।
শোনা যায়, মায়ের মৃত্যুর পরে পোস্টমাষ্টারও সারাজীবন বিয়ে করেননি ।
( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাষ্টার’ গল্পের প্রলম্বন )