• Uncategorized
  • 0

অণুগল্প ১ বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় ( ছোটগল্প )

এভাবেও ফিরে আসা যায়

শুধু কালো দীঘির মত টলটলে চোখের মণি দুটো বের করা পেমলার । মাথা থেকে মুখ অবধি মুখটা দোপাট্টায় আষ্টেপিষ্টে মুড়ে নিয়েছে সে। নিজেদের কুঁড়ে সংলগ্ন একফালি জমি থেকে সেদিনের মত কি আনাজপাতি পাওয়া যায় খুঁজতে বেরিয়েছে। । আগের দিন রাতেই তার মা বলে রেখেছে, পরের দিনের রসদ বলতে ঘরে শুধু এক কুনকে চাল আর দুটো আলু পড়ে আছে। সরকার থেকে নাকি প্যাকেট বেঁধে সবেমাত্র চাল, ডাল, নুন, তেল আর আলু দেওয়া শুরু হচ্ছে। তারাও পাবে দু একদিনের মধ্যেই। তাই আশায় বুক বেঁধে বসে আছে বাড়ির চারজন। ফ্রি তে রেশন দেবে বলেছে। কবে দেবে তা জানেনা তারা।
পেমলার খুব গোছ তাই রক্ষে। তার মা দুঃখ করে করোনার বাজারেও বলে উঠছে তা দেখে “অতি বড় ঘরুণী, না পেল ঘর”। টিভির খবরে ঘরবন্দীর কথা শুনেই রোজ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাঁধাবাড়া করছে মেয়েটা। ধানজমিও আছে একটু। তবে সেটা তাদের ঘর থেকে বেশ অনেকটা দূরে। এখন পেমলা তার বাবা কে যেতে দিতে চায়না ।
নিদাঘ তাতে সব বোরো ধান জ্বলে হেজে গেল রে। ভালো ধান রুইয়ে ছিলুম এবার। দামী বীজ ছিল। পেকে ওঠার সময় হয়ে গেল তো।
ধানচারার যা হয় হোকগে। তুমি যাবে না। একেই তোমার বয়েস হয়েছে তায় টিভিতে বলেছে হাঁপানি থাকলে এই রোগ নাকি চট করে ধরে যায়। পেমলার ছোট্ট মেয়ে আদুরী শ্লেট পেন্সিল নিয়ে দাদুর কোলের কাছে গিয়ে বসে বলে, মা একটুও মুড়ি নেই আর? না রে মা, বলে ওঠে পেমলার বাবা। পেমলা অমনি এক সানকি মুড়ি এনে বাবার কাছে দিয়ে বলে বাবা এই যে, কিছুটা তুলে রেখেছিলাম, তুমি আর আদুরী খাও দিকিনি। এই বলে শাকপাতার খোঁজ করতে বেরুচ্ছিল পেমলা।
বাপ মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে হেসে বলে হ্যাঁ রে মা, আমাদের লালীটা আজ ঠিকমত দুধ দিল তো
 হ্যাঁ বাবা, আমাদের জন্যে রেখে বাকীটা পাশের ঘরে দিয়ে এসেছি। ওদের ঘরে চারটে বাচ্ছা। অনেকদিন হল তো লালীটার। বাছুরটাও বড় হয়ে গেল। দুধ কমে এসেছে। আর খোল, চুনি, ভুষি সব শেষ যে। খাবার বলতে বাড়ির মাড়, নুন দিয়ে। আনাজের খোসাও নেই যে দেব একটু।
সেদিন নিজেদের জমি থেকে লকলকে কুমড়োশাক, দুটো পোকালাগা বেগুণ আর ক’টা কাঁচালংকা নিয়ে আসে পেমলা। গাছগুলোয় জল দিয়েও এল। বৃষ্টি এখন হবেনা। আরও দু চারটে ডগা বেরোলে কদিন বাদে আবার খেতে পারবে তাঁরা। ঝুড়িতে দুটো মোটে আলু পড়ে আছে। একটা চচ্চড়ি হয়ে যাবে সেদিনের মত।
চারটে মুরগী রয়েছে ওদের । তাদের ডেরায় উঁকিঝুঁকি মেরে লাভ হলনা। ডিম নেই সেদিন ওদের ভাগ্যে।
পুকুরটাও একটু দূরে। নয়ত গামছা ফেললেই চুনোচানা মাছ পাওয়া যেত। অনেক লোক ঘাটে জড়ো হওয়া বারণ এখন।আগেরমত জটলা করা যাবেনা। খবর পেল পাশের বাড়ির জানলা দিয়ে। পুলিশ এসে মাঝেমাঝেই টহল দিচ্ছে পুকুড়পাড়ে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শাকপাতাগুলো নিয়ে ঘরের দিকে আসতেই আদুরী চেঁচিয়ে উঠে মায়ের দিকে এসে বলল, দাদু দেখ, মা আজকেও কত্ত বাজার এনেছে। পেমলা বলল, খুব মজা না? ইশকুল নেই, মিড ডে মিলের গরম ডিম ভাত নেই, অঙ্ককষা নেই, নামতা পড়া নেই। আজ আমি বানান ধরব কিন্তু । টিভি তে দেখ শহরের বাচ্চারা ঘরে বন্দী হয়েও কেলাস করছে কেমন!
মা আজ রাতে কি খাব আমরা? আদুরী বলে ওঠে।
সস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত রেখে পেমলা বলল, কেন? কাল যে বললি পেয়াজকুচি দিয়ে গোলা রুটি ভালো লেগেছে তোর।
ঘরের ভেতর থেকে পেমলার মায়ের সন্ধে দেবার শাঁখের ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসতেই পেমলার বাবা দুহাত জোড় করে মাথায় ঠেকালো। জয় মা শেতলা ! কবে এই রোগের থেকে মুক্তি হবে মানুষের! মা বলে ওঠে, আমি মানত করেছি গো। সব মিটলে দশটাকার বাতাসা দেব বসন্ত বুড়ীর থানে। নদীর জল তুলে এনে দণ্ডী কাটব মা। হরির লুঠ দেব হরিসভায়। সবাই কে সুস্থ রাখো।
পেমলার বাবা চোখে একটু কম দেখে আজকাল। ছানি পড়ছে বোধহয়। সন্ধের আলো আঁধারিতে তবুও দূর থেকে একটা সাইকেল দুবার ক্রিং ক্রিং করে এসে ওদের বেড়ার ওপারে থামল দেখে বলে উঠল, কে ওখানে? কে রে? এখন লোকজনের আসা যাওয়া বারণ জানো না? সাইকেলারোহী নেমে সেখানে দাঁড়িয়েই বলল, আজ্ঞে আমি রতন।
অনেকদিন পর গলাটা চেনা লাগল পেমলার। আদুরী হবার পর রতন তাকে ছেড়ে চলে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছিল। বেদম নেশা করে মারধোর করত খুব। দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন সে মেয়ে কোলে করে চলে এসেছিল বাপ-মায়ের কাছে। মাধ্যমিক পাশ পেমলা টিউশান পড়ানো ধরেছিল গ্রামের বাচ্চাদের।
এইবার পেমলা মুখ খুলল। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, কি মনে করে এদ্দিন বাদে আমাদের এখানে?
রতন বলল, আদুরীটার জন্যে বড় চিন্তা হচ্ছিল। আর সত্যি বলতে কি তোমার জন্যেও। তাই সাইকেল চড়েই এতটা পথ এসে গেলুম। ঢুকতে দেবেনা? পেমলা বলল, টিভিতে দেখোনি? পাশের গ্রামে দূর থেকে এমন কত লোক এসে গাছের ওপর দু’হপ্তা ধরে রয়েছে?
রতন বলল, আমার হাঁচি, কাশি, জ্বর কিছুই হয়নি। সত্যি বলছি, মা কালী। মা শেতলার দিব্যি।
কেন তোমার বৌ?
রতন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, বউটা বোধহয় বাঁচবে না আর। যে কাজের বাড়িতে ঠিকের কাজ করে সেখান থেকে রোগ এনেছে। তেনারা  নাকি  বিদেশ থেকে এসেছিল কবে একটা। সরকারী গাড়ী এসে পরশু তুলে নে গেছে হাসপাতালে। দোহাই, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও।
ও তাই বলে এখানে দিতে রোগ এসেছো বুঝি?
পেমলা তার বাবা আর মেয়েকে নিয়ে মুখের ওপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।