অণুগল্প ১ বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় তুষার পণ্ডিত
ইস্ক্রা পত্রিকার সম্পাদক ও সাহিত্যিক প্রগতি মাইতির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রাবন্ধিক তুষার পণ্ডিত
বিষয়: অণুগল্প
তুষার: আপনি নিজে এবং আপনার সম্পাদিত ইসক্রা পত্রিকা বহুদিন ধরে অণুগল্প চর্চা করছেন। আমার জানতে ইচ্ছে করছে যে, অণুগল্প নিয়ে কী কী কাজ করতে পেরেছেন?
প্রগতি: ঠিকই বলেছো। ১৯৯৪ সাল থেকে আমরা অণুগল্প নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি। অণুগল্প নিয়ে এখনো পর্যন্ত যে কাজগুলো করতে পেরেছি সেগুলি হল:
১) বাংলা সাহিত্যের বাছাই করে অণুগল্প – ১০০,
২)ব্যঙ্গ বিদ্রুপ শ্লেষের অণুগল্প,
৩) হাসির অণুগল্প,
৪) বারোয়ারি অণুগল্প,
৫) কবিতা থেকে অণুগল্প,
৬) পুরনো দিনের ও সমকালীন অণুগল্প – ১৫০,
৭)শতাধিক অণুগল্প, বিষয় : বেঁচে থাকা,
৮) প্রান্তিক মানুষের ওপর শতাধিক অণুগল্প,
৯) জাত পাত দাঙ্গা বিরোধী অণুগল্প ইত্যাদি।
এখনও আমরা থেমে নেই। অণুগল্পের ওপর আরও কাজ করছি।
তুষার: কয়েকটি অণুগল্পের পত্রিকার নাম বলতে পারেন?
প্রগতি: কফিহাউস, অল্প কথায় গল্প পত্রিকা, লহমা, মূহুর্ত গল্প, স্বল্প কথায় গল্প ইত্যাদি। এছাড়া বহু পত্রিকা অণুগল্পের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। যেমন : অনুরণন, ক্রন্দসী, সোনার তরী, পারক প্রভৃতি।
তুষার: এই পত্রিকাগুলো কেমন চলছে?
প্রগতি: এক কথায় দারুণ।
তুষার: অণুগল্পের জনপ্রিয়তা মোটামুটি কবে থেকে, অন্তত বাংলা সাহিত্যে?
প্রগতি: বাংলা সাহিত্যে অণুগল্পকে জনপ্রিয় করে তুলতে প্রয়াত অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের অবদান অনেক। ১৯৭০ সালে তাঁর সম্পাদিত ” পত্রাণু” – র ভূমিকা অনস্বীকার্য। এখন তো অণুগল্পের রমরমা।
তুষার: অণুগল্প কি ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত রূপ?
প্রগতি: একদমই না। অণুগল্প একেবারে স্বতন্ত্র। বরং অণুগল্পের মধ্যে ছোটগল্প বা উপন্যাসের বীজ সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এর উদাহরণও আছে।
তুষার: বাংলা সাহিত্যে অণুগল্পের প্রাসঙ্গিকতা কতখানি আছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রগতি: দেখো, সামন্ততন্ত্রের সময় মানুষের হাতে অঢেল সময় ছিল। তাই তখন সময় কাটানোর জন্য মানুষ ঢাউস ঢাউস উপন্যাস পড়তো। ৯ শতক থেকে ১৫ শতক সময়ে প্রথম উপন্যাস লেখেন জাপানের মুরাসাকি শিকিবু। তাঁর উপন্যাসের নাম – দ্য টেল অব গেনজি। ১৬০৫-এ ইউরোপের মিন্ডয়েল দে সারভাস্তেস লেখেন ” ডন কি হোতে”। ১৭১৯-এ রবিনসন ক্রুশো লেখেন ” দ্যানিয়ল দেফো” ।পরবর্তী সময়ে যখন পুঁজিতন্ত্র এলো তখন মানুষ সময়ের পেছনে দৌড়েতে থাকল। এলো শিল্প বিপ্লব। ১৮৫০ থেকে বিশ শতক পর্যন্ত ছোটগল্পের রমরমা। ১৭৯১ সালে ইংল্যান্ডের রিচার্ড কাম্বোল্যান্ড ছোটগল্প লিখেছেন ” দ্য পয়জনার অব মনট্রেমস”। ১৮৭৭-এ রবীন্দ্রনাথ লিখলেন “ভিখারিণী “। যাই হোক, এখন যে ভোগবাদী সমাজের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তাতে মানুষের হাতে একদম সময় নেই। অর্থের পেছনে সে দৌড়চ্ছে। তাই দেখো,পূর্ণাঙ্গ নাটকের জায়গায় এসেছে একাঙ্ক নাটক, স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রও এসেছে, টেস্ট ম্যাচের চেয়ে টি-২০ অনেক বেশি জনপ্রিয়, উপন্যাসের জায়গায় নভেলা, আর ঠিক তেমনি ছোটগল্পের স্থান অনেকটা নিয়েছে অণুগল্প। আমি তুমি চাই বা না চাই – কালের বিবর্তনে অণুগল্পের প্রাসঙ্গিকতা মেনে না নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
তুষার: অণুগল্পের সাথে কবিতার কি কোনো সম্পর্ক আছে? একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে পারলে ভালো হতো।
প্রগতি: অণুগল্পকে কবিতার অনুসারী বলা হয়। কবিতার মতো এখানেও খুব সংযমী হতে হয় শব্দ চয়নে। যেহেতু অণুগল্পে সীমিত শব্দ সংখ্যা, তাই বিষয়ের বিস্তারে ( বিষয় থাকাটা জরুরি নয়) কুঁদে কুঁদে শব্দ ব্যবহার করতে হয়। এখানেও অনুচ্চারিত থাকে বক্তব্য। তবে একটা কবিতা অণুগল্পের চরিত্র পেতে পারে না। কিন্তু অণুগল্পে কবিতার চরিত্র থাকে। আমি আমারই লেখা একটা অণুগল্প এখানে উল্লেখ করছি।
ভাষা – – – – তুমি যখন কোলাহলের ভাষায় গলা মেলাও, আমি তখন নির্জনতার ভাষা খুঁজি। এই নির্জনতার ভাষাও একদিন কোলাহলে মিশে যাবে। ভাষা নিশ্চুপ থাকে না। ভাষা সময়ের অপেক্ষায় থাকে।
এই অণুগল্পটিকে যদি লাইনের পর লাইনে সাজিয়ে লেখা যায় তো কবিতা হতে পারে না কি? তুষার : রবীন্দ্রনাথও কি অণুগল্প লিখেছেন? বিশ্বসাহিত্যেও কি অণুগল্পের চল্ আছে?
প্রগতি: রবীন্দ্রনাথ অণুগল্প লেখার জন্য অণুগল্প লেখেননি। ১৯২২ সালে
“লিপিকা”-য় প্রকাশিত বাঁশি, সন্ধ্যা ও প্রভাত, গলি, একটি দিন, কৃতঘ্ন শোক, প্রশ্ন, রথযাত্রা ইত্যাদি গল্পগুলি সার্থক অণুগল্প।
আর তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলি, বিশ্বসাহিত্যেও অণুগল্পের চর্চা ব্যাপক। ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, জাপান, স্পেন ইত্যাদি দেশে রীতিমত অণুগল্প লেখা হচ্ছে।
তুষার: অণুগল্পের আর এক প্রবাদ পুরুষ বনফুল। আপনি এ সম্পর্কে কিছু যদি বলেন।
প্রগতি: রবীন্দ্রনাথের মতো বনফুলও অণুগল্প লেখার জন্য অণুগল্প লেখেননি। কিন্তু তাঁকে আধুনিক অণুগল্পের জনক বলতে আমার আপত্তি নেই। বনফুলও অনেক অণুগল্প লিখেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এই গল্পের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, এগুলো পোস্টকার্ড সাইজ গল্প। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে একটা পোস্টকার্ডে যত শব্দ ধরে, অণুগল্পের শব্দ সংখ্যা তেমনই হওয়া উচিত। আধুনিক অণুগল্প লিখিয়েদের অবশ্যই বনফুলের অণুগল্প পড়া দরকার।
তুষার: ধন্যবাদ আপনাকে। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও আলোচনা করা যেতে পারে। ভালো থাকুন সবসময় ।
প্রগতি: তোমাকে শুভেচ্ছা জানাই। তোমার প্রশ্নগুলোও খুব ভালো লেগেছে। হ্যাঁ, আমি সব সময় অণুগল্পের ওপর আলোচনা করতে প্রস্তুত।