অণুগল্প ১ বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়
by
·
Published
· Updated
ভাই
টাটা বর্ধমান গামী বাস প্রতীক্ষাতে ছাদে বাম্পারে ভিড়। ভেতরটায় তিল ফেলার জায়গা নেই। পিছন দিকটা মালে ঠাসা, বস্তা, পুঁটলি, ব্যাগ যেখানে-সেখানে ছড়ানো। কেউ কেউ সেগুলোর ওপর বসে , কেউবা পা দিয়ে দাঁড়িয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে আছে। আর বাস চলছে দ্রুত গতিতে – সময়ের ও নামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এই সময়টা বড্ড বেশি ভিড় হয়। পুজোর সময়, বেশিরভাগ যাত্রীরাই বর্ধমান থেকে ফিরছে নিজেদের গ্রামে। এরা বছরে তিনবার বর্ধমান খাটতে যায়, চাষের কাজ করে, ধান রোয়া থেকে তোলা পর্যন্ত। আবার আলুর সময় আলু, গমের সময় গম। খাওয়া-দাওয়া বাদে যা থাকে তা দেশে ফিরিয়ে আনে। বাচ্চা, বর -বউ সকলে মিলে কিছু রোজগার করে আনে যাতে সারা বছর মোটা কাপড় ও ভাত চলে যায়। কাজ -পাট চুকিয়ে এরা দেশে ফিরছে।
সামনের একটি সিটে বসে আছে একজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক সাঁওতাল বউ। আটপৌরে শাড়ি, কম দামি প্রসাধন, রঙচটা পুঁতির মালা, চার-পাঁচ টাকা দামের রংবেরঙের ফিতে দিয়ে খোঁপাটি বাঁধা। চোখে -মুখে- হাতে- পায়ে, শক্ত চিবুকে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির চিহ্ন স্পষ্ট। ডবল সিট, একটি সিটে মেয়েটি তার পাশের সিটে বছর পাঁচেকের একটি সাঁওতাল বালক তার ছেলে। উঁচু দাঁত কপাটি দুই ঠোঁট থেকে খানিকটা বেরিয়ে এসেছে। মিশকালো চেহারা। হাফ শার্ট ও কম দামি হাফ প্যান্ট পরা, দু এক জায়গায় বে-রং সুতোয় তালি মারা। আরেকটি ছেলে বসে আছে মেয়েটির কোলে। সে আরো ছোট। সদ্য কথা বলতে শেখার আনন্দে সে সবার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। সমস্ত রাস্তা বাসের মধ্যে সে একাই বকতে বকতে আসছে। মাঝে মাঝে দুই কশে লাল বেয়ে পড়ছে চিবুকে। নিজেই মুছে ফেলছে সস্তা হাটে কেনা জামাটি দিয়ে। দুই চোখে পিঁচুটি পড়ে আছে। নাকে খানিকক্ষণ বাদে বাদে তরল কফ গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটি ছাপা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিচ্ছে। ছেলেটির নিম্নাঙ্গ অনাবৃত। এই সবেমাত্র হিসি করে মায়ের কোলে প্যান্ট ভিজিয়ে দিয়েছে। পাশের বড় দাদার দিকে হুঁশ নেই। দাদাও বাসের জানলা থেকে পেরিয়ে যাওয়া দৃশ্য গুলি দেখছে।
এমন সময় মারাত্মক ভিড় ঠেলে এক ফর্সা মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি তাদের সিটের সামনে এসে দাঁড়ালো। কন্ডাক্টরের দিকে কর্কশ ভঙ্গিতে সে বলল’ একটা সিট হবে না’? কন্ডাক্টর কি একটা ইঙ্গিত করলেন।
লোকটি সেই মেয়েটির কাছে এসে বলল- ‘দিদি বাচ্চাটিকে কোলে নিন তো,’ মেয়েটি ঝাঁঝ দিয়ে বলে উঠলো “একটা বাচ্চাকে কোলে লিয়েছি, আর কটা কলে লিব।”
লোকটি গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল- ‘দুটো সিটের টিকিট কেটেছেন; “নাইবা কাটলম বাচ্চাটাকে কি দাঁড় করিয়ে রাখব”- মেয়েটি বলল। লোকটি বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল- ভাড়া দেন নি তো দাঁড় করিয়েই রাখতে হবে, চোদ্দটা ছেলে, চোদ্দটা বেটি বানাবে, আর ভাড়া একটা”। কন্ডাক্টরকে ডেকে লোকটি ছেলেটিকে সিট থেকে তুলে বসে পড়লো। পাঁচ বছরের ছেলে কিন্তু মনের জোর খুব। সে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলো- “আমার বসে বসে ফিচাটা জ্বলে গেল, লে তুই বস।” ছেলেটা ভীড় সহ্য করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। লোকটির পরনে সাদা বিমল মার্কা দামি ফুল শার্ট, নীল রঙের জিন্স। সুগন্ধি আতরের গন্ধে গোটা বাস ম্ ম্ করে উঠছে।।
বাসটা হঠাৎ করে জোরসে ব্রেক মেরে আবার চলতে লাগলো। কোলের ছেলেটি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে জেগে দেখলো তার দাদা নেই। সেই সীটে একটা লোক বসে আছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখল তার দাদা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার দিকে আদুরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল “আদা আয়” । দাদা স্বতস্ফুর্ত হীন ভাবে বলল, “তুই বস আমি ভালো আছি”। ভাই হয়ত দাদার কথা বুঝল না, কিন্তু বেশ বুঝল যে লোকটি তার দাদাকে সিট থেকে তুলে দিয়েছে। লোকটার দিকে সে রাগত ভঙ্গীতে তাকিয়ে বুকে এক লাথি মারল। সঙ্গে সঙ্গে তার জামার খানিকটা অংশে ময়লা পায়ের ছাপ পড়ে গেল। ছেলেটি ফোকলা এক গাল হেসে উঠল। লোকটি চিৎকার করে বললে — “বাচ্চাটিকে সরাও জামাটির কি অবস্থা করল দেখেছ?” মেয়েটি বাচ্চাটিকে একটু সরিয়ে নিয়ে বসল। লোকটি রুমাল বের করে ময়লা দাগ ওঠানোর চেষ্টা করতে লাগল। বাস আরও জোরে ছুটে চলেছে। আবার ঝাঁকুনি। বাচ্চাটার মাথা ভদ্রলোকের গায়ের কাছে ঠেকল। মাথাটি সরাতেই দেখা গেল বাচ্চাটি তার ঠোঁট পর্যন্ত নেমে আসা কফটি ভদ্রলোকের জামায় সাফ করে ফেলেছে। ভদ্রলোকটি আর সহ্য করতে না পেরে, বাচ্চাটির পিঠে রেগে গিয়ে সটান এক চড় বসাল। বাচ্চাটিও ছাড়ার পাত্র নয়। সেও রেগে গিয়ে মুখ থেকে থুতু বের করে লোকটার মুখে ছুঁড়ে মারলো। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে লোকটি গজ গজ করে উঠে পড়ল। সে উঠে যেতেই বাচ্চাটা আনন্দে এক গাল হেসে ওপাশে মাথা ঘুরিয়ে দাদাকে ডাকল — “আদা আয়”। দাদা ঝুপ করে সিটে বসে পড়ল।