বাংলা তথা ভারতের নাট্যজগতে নাট্যকার চন্দন সেন একটি পরিচিত নাম। সম্প্রতি পঁচাত্তর বছর পার করে ছিয়াত্তরে পা দিলেন তিনি। সেই ১৯৬৭ সালে “নিহত সংলাপ” নাটকের মধ্য দিয়ে তাঁর এই জগতে প্রবেশ। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে নাটক লিখে চলেছেন তিনি। “দায়বদ্ধ”, ” সোনার মাথাওয়ালা মানুষ”, “দুই হুজুরের গপ্পো” – এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকের স্রষ্টা তিনি। তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন রাজদীপ ভট্টাচার্য্য। কথায় কথায় উঠে এল বাংলা নাটক এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়।
★রাজদীপ – ব্যক্তিগত জীবনে মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টির দিকে না গিয়ে নাট্য রচনা দিকে আকৃষ্ট হলেন কেন?
★চন্দন সেন # আমার কাছে মৌলিক সাহিত্য রচনার সাথে নাট্য রচনার কোন পার্থক্য নেই। আমার কাছে নাটক একরকম কবিতার মতোই। কারণ তার মধ্যে এমন কিছু ব্যঞ্জনা থাকে, ইঙ্গিত থাকে যা পাঠক বা দর্শককে বুঝে নিতে হয়। সাহিত্যের অন্যান্য রূপ যেমন পাঠককে কল্পনার জগতে নিয়ে যায়, ঘিরে ধরে; তেমনি নাটকের ক্ষেত্রে মজাটা হচ্ছে সেই গল্পটা তখন দর্শকের কাছে বাস্তব হয়ে আসে। সাহিত্যের সাথে নাটকের এইটুকু পার্থক্য যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কল্পনার কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। কিন্তু যখন তা নাটক হয়ে যায় তখন সেই কল্পনার একটি বাস্তবায়িত রূপ দেখি। তাই নাটক মানে মুক্ত কল্পনাকে নির্বাসন দিয়ে অন্যতর এক কল্পনার আশ্রয় নেওয়া। এক্ষেত্রে সিনেমা ও নাটকের মধ্যে আর একটা পার্থক্য আছে। নাটক আমাদের স্থান-কাল-পাত্র ভুলিয়ে দেয়। ধরো আমি রানাঘাটে একটি হলে বসে আছি। মঞ্চের উপর আমার পাড়ার পটল যখন সেজেগুজে শাজাহান হয়ে ঢুকল, তখন তার সুখের কথায় আমরা হাসতে শুরু করি, দুঃখে চোখে জল আসে। এভাবে নাটক বা থিয়েটার যে জাদুবাস্তব মানে ম্যাজিক রিয়েলিটি সৃষ্টি করে, আমি মনে করি তার মধ্যে যথেষ্ট সাহিত্যগুণ আছে।
★রাজদীপ – বেশ তার মানে আপনি মৌলিক সাহিত্য এবং নাটককে একেবারেই আলাদা করে দেখতে চান না, বরং মনে করেন যে সাহিত্যের তুলনায় নাটকের প্রসাদগুণ খানিক বেশি। এতে মানুষকে আরো বেশী করে প্রভাবিত করা যায়।
★চন্দন সেন # ঠিক তাই। শুধু তাই না, ওই ‘মৌলিক’ শব্দটি নিয়ে আমার কিছু বলার আছে। বলা হয় যে, একমাত্র মাকড়সার জাল ছাড়া বিশ্বে সবকিছুই অমৌলিক। মৌলিক নাটক বলেও কিছু হয় না। শুধু রামায়ণ-মহাভারতের উপর নির্ভর করে ভারতবর্ষে কমবেশি সাড়ে তিনশো পরিচিত নাটক হয়েছে। আমরা তাদের অনুবাদ বা রূপান্তরিত নাটক বলি না। ওই পরিচিত ঘটনাকে নাট্যকার কোন দৃষ্টিতে দেখলেন, চরিত্রগুলিকে কিভাবে উপস্থাপিত করলেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই পৃথিবীর কোন ঘটনাই মৌলিক নয়। ‘মৌলিক’ শব্দটার মধ্যেই অনেক ফ্যালাসি থেকে যায়।
★রাজদীপ – আপনার নাটকগুলি সাধারণত মানুষের কথা, সময়ের কথা বলে। নাটক লেখার সময় আপনার চিন্তায় ঠিক কি থাকে? কেন নাটক লেখেন?
★চন্দন সেন # যে কোনো সৃষ্টির মূল কথাই স্বতন্ত্র করে কথা বলা। পৃথিবীর সব মহান সাহিত্য যেমন রামায়ণ- মহাভারত কিংবা ইলিয়াড-ওডিসি এসবই চিরকালীন সাহিত্য, আর তার মানে তারা সমকালীন সাহিত্য। যা চিরকালীন তাই সমকালীন। তাই ইতিহাসের যে গল্প থেকে আমি বর্তমান সময়কে মেলাতে পারব, আমি নাটকের ক্ষেত্রে সেই গল্পগুলোকে বাছার চেষ্টা করি। যে চরিত্রগুলো এমন কিছু সংকটের কথা বলবে যা এখন প্রাসঙ্গিক, সেই চরিত্রদের পুনরুজ্জীবিত করে আমি চেষ্টা করি এই সময়ের একটা স্বরলিপি তৈরি করতে। তাই নাটক লেখার সময় নাটককারের দায়িত্ব কিছু স্থানিক, সাময়িক বিষয়ে আটকে না থেকে এমন কিছু কথা বলা যা সমকালীন কিন্তু চিরন্তন বার্তা রাখে। নাটকের সমস্যা সাময়িক হতে পারে, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে নাট্যকার চিরন্তন বার্তা দেন।
★রাজদীপ – পরের প্রশ্নে যাই আপনি সারা পৃথিবীর নাট্যচর্চার সাথে অনেকটাই পরিচিত। তাই জানতে চাই, আমাদের বাংলা ভাষার নাট্যচর্চা পৃথিবীর নিরিখে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বলে আপনি মনে করেন?
★চন্দন সেন # বাংলা নাট্য চর্চা নিয়ে আমি হতাশ নই। দীর্ঘদিন ধরে যারা নাটক লিখছেন তারা ছাড়াও, সংখ্যায় কম হলেও নতুন অনেকে ভালো নাটক লিখছেন বা অভিনয় করছেন। তারা তাদের মত করে চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখানে কিছু সমস্যা আছে। বাজার সবকিছুর উপর একটা প্রভাব ফেলছে। লোকসংগীত, যাত্রা, পালাগানের চরিত্র যেভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার সাথে ভারসাম্যহীন সংমিশ্রণে; সেভাবেই নাটকের ক্ষেত্রেও একদল ছেলেমেয়ে চেষ্টা করছে বাজারি নাটক তৈরি করতে। তারা চাইছে অসম্ভব আলো, শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে স্তম্ভিত করে দেবে। কিছু মানুষ এতে প্রাথমিক ভাবে চমৎকৃত হচ্ছে। কিন্তু এই নাটক তারা দ্রুত ভুলে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় দুর্বলতা হচ্ছে, গ্রুপ বা দলের কনসেপ্ট বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা দিয়ে অভিনয় করানো। তারা দলকে বোঝাচ্ছে যে দেবশংকর বা গৌতম হালদারকে না আনলে উপায় নেই। এইসব নাম ব্যবহার করে তারা হয়তো কিছু শো পাচ্ছে। কিন্তু দলের আদি চরিত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গ্রুপের বিশুদ্ধতা থাকছে না।
★রাজদীপ – স্যার, কয়েকটি ছোট প্রশ্ন দিয়ে এই কথোপকথন শেষ করি। আপনার প্রিয় বিদেশি নাট্যকার কে?
★চন্দন সেন # আমি ইংরেজি ছাত্র হিসেবে একসময় প্রিয় ছিল বার্নার্ড শ, টি এস এলিয়ট, শেক্সপিয়ার এনারা। এখন আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করছেন স্যামুয়েল বেকেট এবং ইউজিন ও’নীল।
★রাজদীপ – আর বাংলার নাটকের মধ্যে? সেক্ষেত্রে কার কথা বলবেন?
★চন্দন সেন # মোহিত চট্টোপাধ্যায় এবং মনোজ মিত্র আমার প্রিয় নাট্যকার। আগে ছিলেন উৎপল দত্ত।
★রাজদীপ – আর সাম্প্রতিক মানুষদের মধ্যে কার নাম বলবেন?
★চন্দন সেন # যেমন ব্রাত্যর কিছু নাটক আমায় আকর্ষণ করে। নবেন্দু সেনের নাটক আমার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল। উজ্জ্বল, তীর্থঙ্কর এরাও ভালো লিখছেন।
★রাজদীপ – সাম্প্রতিক বাংলা নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রীদের কথা যদি বলি?
★চন্দন সেন # অন্য রকম কাজ করছে, যেমন সৌরভ পালধী, তূর্ণা, বিন্দিয়া এরা আমার পছন্দের। তবে একটু ভাবলে আরো নাম বাড়বে। যেমন কিছু ক্ষেত্রে কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, বাবলু চৌধুরি, দেবাশিস সরকার – এদের অভিনয় আমার খুব ভালো লাগে। কিছু ক্ষেত্রে অভিনয় আমার ভালো লেগেছে জলপাইগুড়ি কলাকুশলীর নাটকে। যে নামগুলি তাৎক্ষণিকভাবে বললাম এর বাইরেও পছন্দের অনেক নাটকের মানুষ আছেন। আমি আস্থাশীল এইসব মানুষের ওপর।
★রাজদীপ – অনেক ধন্যবাদ জানবেন। ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।