• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৬৬)

পর্ব – ৬

অতনু এবার মাকে শাসালো, “মা, খেতে কি দেবে না? না কি, জল খেয়ে শুয়ে পড়তে বলছ?”
বাসন্তীবালা ছটফট করে ওঠেন। ডাকেন, “ও সবিতা?”
ওপরের ঘরে গোলমাল শুনে নিচ থেকে উঠে এসেছিল সবিতা। হাই তুলে বলল, “চিৎকার করতে হবে না, বাঁদী হাজির।”
বাসন্তীবালা বললেন, “ছেলে দুটোকে খেতে দে।”
আড়মোড়া ভেঙে সবিতা বলল, “দিই গে যাই। কিন্তু তোমরাও দেরি কোরো না। কাল ষষ্ঠী। রাতের মধ‍্যে আমায় ছিষ্টি পোসকার করতে হবে।”
বাসন্তীবালা বলেন, “আগে ওদের খাবার দিগে যা। তারপর আমরা যাচ্ছি।”
সে কথায় কান না দিয়ে, সবিতা শ‍্যামলীকে ডাকে।  “ওঠ্ সোনা, ওঠ্ ওঠ্।  খেয়ে নিবি চ।” শ‍্যামলী তখনও বাবার বিছানায় মুখ গু‍ঁজে  পড়েছিল। মেয়েটা যে বাবা মায়ের সামনে একটু আগেই সহোদর দাদার হাতে মার খেয়েছে, সে কথা সবিতার কাছে কেন যেন লুকোতে চেষ্টা করেন বাসন্তীবালা।
বাবার বিছানা থেকে মুখ তুলে শ‍্যামলী বলে, “আমি আজ কিছু খাব না পিসি। আমার আজ যথেষ্ট জুটে গেছে। আর লাগবে না।” বলেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে আবার।
সবিতা সন্দিগ্ধ চোখে শশাঙ্কের দিকে তাকায়। বলে, “দাদা, মেয়েটাকে বকাবকি করেছ না কি? “
শশাঙ্ক পাল অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। বাসন্তীবালা সবিতার উপর রেগে ওঠেন। বলেন, “তোকে যেটা বলেছি, সেটা যদি না করিস তো আমিই নিচে যাচ্ছি। ছেলেদুটোর খিদে পেয়েছে!”
সবিতা তখন চলে যায়।
মেয়ের কাছে এসে তাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বাসন্তী বলেন, “তুই জানিস, তোর ভাই বোনেরা সবাই গুরুদেবকে ভালবাসে। তোর ওঁকে ভাল না লাগতে পারে। কিন্তু, সে কথা মুখ ফুটে বলার কি দরকার? ভক্তি যার যার নিজের। তুই ও নিয়ে কিছু না বললে তো ওরা আগে কিছু বলতে আসে নি। কারো ভক্তিতে আঘাত করা ভাল?”
শ‍্যামলী চোখ মুছে বাবার দিকে চেয়ে বলল, “অর্থাৎ সব দোষ আমার। তোমাদের তাহলে এই বিচার?”
শশাঙ্ক পাল বলেন, “তা তুই গোবিন্দকেই বা জেরা করতে গেলি কেন? ওদের পারিবারিক ব‍্যাপার। ওরা যা যেটুকু ভাল বুঝতে পেরেছে, তা করেছে।”
মা বললেন, “গোবিন্দ চাইলেও মেয়েটার বাপ মা হয়তো চায়নি। থানা পুলিশ করতে কাঁহাতক ভাল লাগে? মেয়েটা মরেছে, শোক করবে, না থানা পুলিশ করবে?”
শ‍্যামলী বলল, “আশ্চর্য তো? ওরা মূর্খ হতে পারে। শোকে কাতর হয়ে বেভুল হয়ে যেতে পারে। তা বলে তোমরাও সেই চুপ করে থাকাটাকেই সমর্থন করবে? কন‍্যাসন্তানের কোনো দাম নেই বাপ মায়ের কাছে?”
বাসন্তীবালা মেয়েকে বলেন, “দ‍্যাখ মা, একটা জিনিস বোঝার চেষ্টা কর্। বিয়ে যার সাথে দেওয়া হয়, তার সাথে তো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়? জামাইকে বিয়ের পিঁড়িতে নেবার সময় বরণ করতে হয়, তাই তো? তারপর বছর বছর জামাই ষষ্ঠী হয়। তার অক্ষয় জীবন প্রার্থনা করতে হয়, তাই তো? এইভাবে সেও একেবারে নিজের সন্তানের সমান হয়ে যায়। তখন তার বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করা কি ভাল দেখায় রে?”
পিছনে সবিতা কখন এসে দাঁড়িয়েছে, বাসন্তী বালা খেয়াল করেন নি। তাঁর কথার রেশ ধরে সবিতা বলে বসে, “বিয়ে হল জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক।”
বাসন্তীবালা বলেন, “মেয়েদের পতিই পরমগুরু। তিনিই একটা মেয়ের জীবনসর্বস্ব। চাঁদ দেখবি সব সময় একটাই মুখ, পৃথিবীর মুখের পানে চেয়ে আছে। পৃথিবী যেমনটি ভাবে তাকে রেখেছে, সে তেমনভাবেই আছে।”
“তো অমাবস্যা হলে?” ফুট কাটতে ছাড়ে না শ‍্যামলী।
সবিতাকে দেখে ছেলেদের কথা মনে পড়ে যায় বাসন্তীবালার। শশব‍্যস্ত হয়ে বলেন, “ওরে, ওদের খেতে দিলি?”
“হ‍্যাঁ বৌমণি। দিইচি। যা হুড়ো লাগালে তুমি। দেরি তো স‌ই ছিল না। বৌমণি, এবার তোমরা খেয়ে নেবে চলো।”
বাসন্তীবালা সবিতার কাছে জানতে চাইলেন,  “তো কি দিলি ওদের?”
“কেন, মাছভাজা রাখা ছিল দু পিস। ওই চট্ করে ঝাল বানিয়ে দিলাম। আর কাঁচকলার কোপ্তা তো ছিলই।”
বাসন্তীবালা জিভ কেটে বললেন, “সে কিরে? মাছদুটো মেয়েটার জন‍্যে রেখেছিলাম। ও যে সকালে খায়নি মোটে।”
সবিতা বলে, “তা কি করব বলো বৌমণি, অতনু খেতে বসার আগেই রান্নাঘরে ঢুকে এটা হাঁটকায়, ওটা হাঁটকায়। যতো বলি, তোরা খাবার টেবিলে বস গে, কে শোনে কার কথা?”
বাসন্তীবালা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলেন, “তা একবার জিজ্ঞেসা করতে পারলি নি আমাকে?”
সবিতা ঝঙ্কার দিয়ে বলে, “হ‍্যাঁ, জিজ্ঞেস করবে! বলে ছিনে জোঁকের মতো লেগে রয়েছে পিছনে। অতনু নিজেই বাটি চাপা মাছ হাঁটকে বের করে বলল, এই তো মাছ আছে, ভেজে দে পিসি। আমি তখন আর আটকাতে পারি? যে গুণ্ডো দুটো ছেলে তোমার? হরদম বোনকে পিটিয়ে পিটিয়ে সাহস বেড়ে গেছে। আমি ভয়ে ভয়ে থাকি। কিছু বলি নি বাবা। যা বলছ, সবতাতে যো হুজুর। এমনি করে তোমাদের বাড়ি টিঁকে আছি।”
শ‍্যামলী কথা ঘোরাতে চেয়ে বলল, “পিসি, কি সেই জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক বলছিলে?”
সবিতা কপাল চাপড়ে বলে, ” হায় দ‍্যাখো, স্বামীর সাথে মেয়েমানুষের জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক নয় আবার? আকাশে চেয়ে দ‍্যাখো না, বশিষ্ঠ অরুন্ধতী, রাম সীতা, লক্ষ্মী নারায়ণ সব বসে আছেন। ওই অনেক উঁচুতে বসে আছেন হরগৌরী।”
শ‍্যামলী মজা করে বলে, “তুমি সব দেখতে পাচ্ছ না পিসি?”
সবিতা বলে, “হিন্দুঘরের মেয়ের বুকের এত পাটা ভাল নয় শ‍্যামলী। একটু ভক্তিভাব রাখ!”
“না পিসি, আমার ভক্তি খুব আছে। সে শুধু কৃষ্ণঠাকুরকে নিয়ে। রাধা কৃষ্ণ আকাশের কোন্ খানে আছে পিসি?”
সবিতা রাগ করে বলে,  “কৃষ্ণকে নিয়ে হেলাফেলা করবি না বলে দিচ্ছি শ‍্যামলিমা। কৃষ্ণ একেবারে পরম ব্রহ্ম। গীতায় নিজের মুখে তিনি অর্জুনকে সব বলেছেন। রাধারাণীর সাথে তার নিত‍্যলীলা।”
“যাঃ পিসি, অর্জুনের কাছে তিনি রাধারাণীর ব‍্যাপারটা পুরো চেপে গিয়েছেন। ওইজন‍্যে গীতায় রাধারাণী নিয়ে কিচ্ছুটি বলা নেই।”
“শোনো পিসি, বিয়ে মানে যদি জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক বলতে চাও, তো কৃষ্ণের সাথে ওই সম্পর্ক পাঁচ পাঁচটি মেয়ের।”
“বটে রে? শ‍্যামলীকে চড় দেখান সবিতা।
শ‍্যামলী হো হো করে হেসে বলে, “না না, ঠাট্টা করছি না পিসি। সত‍্যি সত‍্যি বলছি। এই দ‍্যাখো, কেষ্টঠাকুরের ব‌উদের নামগুলো বলছি, গুণে নাও, রুক্মিণী, সত‍্যভামা, জাম্ববতী, লক্ষ্মণা আর সুশীলা। ঠিক পাঁচটি। আর গোপিনী অঢেল। কেউ বলে ষোলো শো, কেউ বলে ষোলো হাজার। “
বাসন্তী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, “রামায়ণ মহাভারত গীতা তুই এত জানিস, একটু ভক্তি যদি তোকে দিত ভগবান!”
সবিতা বলল, “ওই তো ভগবানের লীলেখেলা। যাকে তিনি অনেক দেন, তার‌ও একটা না একটা ছিদ্দির রেখে দেন তিনি। ওই ফুটো দিয়ে জাহাজডুবি। অতো বড় পাহাড়ের চূড়ার মত চেহারা রাবণের। দশটা মাথা, বিশটা হাত। তার কি হল? না, যেই সে সীতার গায়ে হাত দিল, অমনি ব‍্যস্।”
শ‍্যামলী মজা করে বলে, “রাবণ না কি ব্রহ্মার নাতির ছেলে ছিল? আর শিবঠাকুরের বর পেয়েছিল।”
সবিতা গোঁ ভরে বলে, “অত কথা জানি নি বাপু। সীতা, তিনি সতীলক্ষ্মী, তাঁকে অপমান স‌ইবে কেন? ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। “
শ‍্যামলী বলল, “তা কেন পিসি। রাবণ তো সীতাকে ধর্ষণ করেন নি। আগে অবশ‍্য অনেক মেয়ের ক্ষতি করেছেন রাবণ। বেদবতী, অলম্বুষা। অনেক মেয়ের। করে করে অভ‍্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, সীতার অঙ্গস্পর্শ করলে রাবণের মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যেত। অভিশাপ ছিল না কি।”
সবিতা রেগে বলে, “কি করেছে না করেছে, আমি কি দেখতে গেছি। ধরে নিয়ে যাওয়া মানেই তাই।”
শ‍্যামলী হেসে বলে, “না। তাই নয়। আই পি সি তে আলাদা আলাদা সেকশন। মহিলার প্রতি খারাপ খারাপ কথা বললে এক রকম, কাপড় টেনে খুলে দিলে আর এক রকম। আর ধর্ষণ মানে স্ত্রী অঙ্গে কোনো কিছু একটা প্রবেশ করানো।”
“ছি ছি শ‍্যামলিমা, বাপ বসে আছে চোখের সামনে। আর এই সব নোংরা কথা মনে ঘাঁটাঘাঁটি করছিস তুই?”
শ‍্যামলী বলল, “ভুল বুঝছো পিসি। আমি আইনের কথাটা সোজা সরল করে বলছি। তোমাদের গুরুদেবের এগেনস্টে ওই স্ত্রী অঙ্গে কিছু একটা ঢোকানোর অভিযোগ।”
সবিতা তিক্ত স্বরে বলে, “ভায়েদের হাতে এজন্যে এত মার খাস, জামাইটা পর্যন্ত সেদিন কত নিন্দে মন্দ করে গেল, তবু তোর শিক্ষা হয় না শ‍্যামলী? মুখের একটা আগল পজ্জন্ত নেই গো?”
শ‍্যামলী হেসে বলে, “নিজের বাড়িতে বসেও মনের কথা বলতে পারব না পিসি? তাহলে আমার দেশে বাকস্বাধীনতা একটা সাজানো জিনিস বলো?”
সবিতা ক্ষেপে উঠে বলে, “তোকে বলে দিচ্ছি শ‍্যামলী, অতি দর্পে হতা লঙ্কা… তোর হয়েছে তাই… দুটো পাশ দিয়েছিস, দুটো নম্বরের জন‍্যে লোকে দু চারটে প্রাইজ দিয়েছে। ফটফট করে কথা বলে হাততালি পেয়ে তোর মাথা ঘুরে গেছে। নিজেই নিজেকে ইন্দিরা গান্ধী ভেবে বসে আছিস। সে ভুল করিস না। ইন্দিরা গান্ধী অনেক বড়লোকের বেটি রে। তার ঠাকুরদা অনেক বড়লোক ছিল। পিসি ছিল বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। সারা দুনিয়া জুড়ে কি তাদের বোল বোলাও! আমাদের মত ঘোমটা দিতে গিয়ে পোঁদের কাপড় উঠে যেত না তাদের।”
শ‍্যামলী সবিতা পিসির মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে, “ভাল ভাবে কথা বলতে পারো না, তো কথা বলতে আসো কেন?”
সবিতা রেগে বলে, “কি হয়েছে তাতে শুনি? কথাটা শুনতে খারাপ। কিন্তু ওসব বড় বড় ফ‍্যামিলির যা সয়, আমাদের তা সয় কি? বটগাছ যে ঝড় অবলীলায় সহ‍্য করে, ছোটো ছোটো গাছ তা পারে? তাকে নিচু হয়ে মাথা বাঁচাতে হয়।”
শশাঙ্ক পাল আর সহ‍্য করতে পারেন না। বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন, “থামবি তোরা? হ‍্যাঁ রে শ‍্যামলী, সাত রকম কথায় আসল কথাটাই ভুলতে বসেছি।”
শ‍্যামলী চট করে গাউনের আড়াল থেকে টাকার ব‍্যাগটা বের করে বাবার পায়ের কাছে রাখে। বলে, “এই নাও তোমার আসল কথা। দেব বলেই দাঁড়িয়ে আছি। এ সংসারে এখন এই আমার সম্পর্ক।”
সবিতা বলে, “হ‍্যাঁ রে শ‍্যামলিমা, রোগা মানুষটাকে অমন বিঁধে বিঁধে কথা বললি? বাবা হয় যে রে!”
বাসন্তীবালা সবিতাকে বলেন, “এই তুই এবার খাবার গোছা গিয়ে। আমরা যাচ্ছি।”
সবিতা ঝঙ্কার দিয়ে বলে, “হ‍্যাঁ গো বৌমণি, তুমি সোজাসুজি বলতে পারো না? বলো না, এখন টাকা পয়সা গোণা গাঁথা হবে, তুই এখন যা! আমার হয়েছে জ্বালা। তোমাদের কথায় না ঢুকেও উপায় থাকে না। ঢুকলেও হাজার জ্বালা। ভগবান আমায় নেয় না কেন?”
শ‍্যামলী তার দিকে ফিরে বড় বড় চোখ করে বলে, “ছিঃ পিসি, ভগবান তোমাকে নিতে এলে একলা কেটে পোড়ো না যেন। আমাকেও ডেকে নিও। আজ কাকভোরে বলছিলে না, তুমি আমার আরেকটা মা।”
সবিতা সঙ্গে সঙ্গে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে বলেন, “বালাই ষাট! আমার মাথায় যত চুল তত বচ্ছর পরমাই হোক তোর। আমি শোকাতাপা বেওয়া মানুষ। আমার কথা মনে কিছু নিস না।”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *