• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৬০)

পর্ব – ৬০

৫৯

শ‍্যামলী ঘাড় কাত করে লাইব্রেরি ঘরে মাথার উপর দেওয়ালের ক‍্যাবিনেটে ব‌ই দেখতে থাকে। পরীক্ষায় ভাল ফল করতে পারা, আর এখানে ওখানে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে কিছু ভাল ব‌ই তার প্রাপ্তি হয়েছে। অনেক জায়গায় উপহার হিসেবে বাসনকোসন, ফুলদানি, ঘড়ি, দেওয়াল ঘড়ি, কফি সেট, টি সেট তুলে দিলেও, এখনো হাতে গোনা কয়েকটি শিক্ষিত মানুষ উপহার দিলে ব‌ই দিতে ভালবাসে। ছাত্র ছাত্রীদের ব‌ই উপহার দেওয়াই তো ভাল। শ‍্যামলীর মনে পড়ল উপহার হিসেবে রম‍্যাঁ রলাঁর লেখা ব‌ইটির কথা। ওটি তার অন‍্যতম আদরের। আর আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্চয়িতা, গীতবিতান। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা আর পঞ্চগ্রাম। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ‍্যক ব‌ইটা কে এসে মায়ের কাছে চেয়েছিল পড়বে বলে। মা বিশ্বাস করে দিয়েছিল। শ‍্যামলীকে বলার কথা মায়ের মনেও ছিল না। মা আর মনে করতেই পারেন না, কে যে ব‌ইটা নিয়ে সরে পড়ল।
এইসব ব‌ইগুলো অনেক শিক্ষিত লোকের বাড়িতে থাকে। কিন্তু অনসূয়ার বাড়িতে এমন বেশ  কিছু ব‌ই রয়েছে, যা সে কলেজের লাইব্রেরিতেও দেখে নি। ব‌ই মানুষের সেরা সঙ্গী। আবার সংগৃহীত ব‌ই দেখে মানুষের রুচির আন্দাজ পাওয়া যায়।
শ‍্যামলীর মনে পড়ল ফ্রানৎস কাফকার “মেটামরফোসিস” ব‌ইটার কথা। একটা তরুণ সেলস একজিকিউটিভ নিজের পৈতৃক বাড়িতে ঘর বন্ধ করে ঘুমাচ্ছিল। ঘুম ভেঙে দ‍্যাখে কি, সে একটা বিরাট মাপের পোকা হয়ে গিয়েছে।
কাফকা চল্লিশ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগের শিকার হয়ে মারা গিয়েছিলেন। জার্মান ভাষায় লিখেছেন তিনি। শ‍্যামলী বইটা পড়েছে ইংরেজি ভাষায়। আসল ব‌ইটার নাম ‘ডাই ভার‌ওয়ানডলুং’।
বলতে বলতে আলমারিতে বইটা দেখতে পেল শ‍্যামলী। কি আশ্চর্য, মূল জার্মান ভাষায়। অনেকবার পড়া হয়েছে ব‌ইটা। কালির কলমে ব‌ইয়ের ধারে নোট লেখা।
এই ব‌ইটা কার অনসূয়া দি?
ব‌ইটা একবার দেখেই অনসূয়া বললেন, কাকামণির ব‌ই।  ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কয়েক বছর জার্মানি থেকে তারপর একটা বড়ো ফার্মের কর্তা হয়েছিলেন। জার্মান পড়ার অভ‍্যাস ছাড়েননি তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা শিক্ষার ক্লাসে পড়াতে যেতেন।
ব‌ইটা হাতে নিয়ে অনসূয়া দেখালেন, শ‍্যামলী, এই দ‍্যাখ, এইখানে লেখা বইটা কোথায় ছাপা, সালটা কত।
শ‍্যামলী অবাক হয়ে দেখতে থাকে।
তারপর অনসূয়া বললেন, চল্ খাবি চল্।
আবার খাবো কি, এই তো অতোগুলো মিষ্টি খাওয়ালেন।
এই তো কি রে, তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে।
ইশশ্ । লজ্জা পেল শ‍্যামলী। তিন তিনটে ঘণ্টা ধরে সে হাঁ করে ব‍ই দেখছিল!
শশব‍্যস্ত হয়ে সে বলল, আমার খুব জরুরি কাজ আছে দিদি। শুধু একটা জিনিস জেনে নিয়ে বাড়ি যাব।
আগে খাবি আয়। আমি নিজের হাতে রুটি সেঁকে তোকে খাওয়াবো। সাথে ঘুগনি।
এখন রুটি খেতে হবে?
আয় না। বলে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসান অনসূয়া। তারপরে টোস্টারে পাঁউরুটি সেঁকে মাখন, নুন ও মরিচগুঁড়ো লাগিয়ে তাকে খেতে দেন। চমৎকারভাবে সেঁকা রুটি কড়মড় করে আওয়াজ করতে থাকে। তা শুনে হেসে ওঠে দুজনেই।
খেতে খেতে শ‍্যামলী বলে, জানেন তো দিদি, আমাদের কারখানায় একটা সমস্যা হয়েছে।
অনসূয়া বললেন, বল।
একটা মিস্ত্রি। অনেক দিন ধরে কাজ করছে। পুরোনো লোক। তাই হেডমিস্ত্রি বলি। সে কারখানার ক‍্যাশ সামলায়। আর পার্টসের স্টক সামলায়। সে করেছে কি, ক‍্যাশের হিসাবে গোলমাল করেছে। দু দুটো গাড়ি সারানোর পয়সা আদায় করে নি। সাথে পার্টস যুগিয়ে তার দাম‌ও চায় নি।
আচ্ছা বেশ।
দিদি, ওর অপরাধটা ইচ্ছাকৃত।
কেন এ রকম মনে হচ্ছে?
ও ক‍্যাশ বাক্স আর পার্টস এর দেরাজ খুলে রেখে চলে গিয়েছিল।
তার পর?
আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে কিছুতেই বলতে চায় নি।
আমায় কি করতে হবে?
কেসটা একটু দেখে দেবেন।
কত ফিজ় দিবি?
হাঁ হয়ে গেল শ‍্যামলী। যিনি ওই আগের মামলা করে জোর জবরদস্তি করা সত্ত্বেও এক পয়সা ফিজ় নিতে অস্বীকার করেছেন, এখনই যিনি আদর করে পাঁউরুটি সেঁকে মাখন মরিচ মাখিয়ে খাওয়ালেন, তিনি মামলা শুনবেন বলে ফিজ় চাইছেন!
আমতা আমতা করে শ‍্যামলী বলল, তা ফিজ় তো দিতেই হবে।
না, না, দিতেই হবে বললে, আর আমি সেই শুনে খুশি হয়ে গেলাম, সেটি হচ্ছে না।
শ‍্যামলী বেশ অবাক হয়ে গেল। বাড়িতে পুজোর খরচ বাবদে কিছু টাকা না দিলেই নয়। বাবা বলে রেখেছেন, ওরে, তোর মাকে কিছু দিস। তাই আজ কলেজ থেকে বেরিয়ে ব‍্যাঙ্কে ঢুকে কিছু টাকা তুলে এনেছে সে। আগামীকাল ষষ্ঠী। রবিবার না পড়লে ব‍্যাঙ্ক খুলত। সপ্তমী থেকে ব‍্যাঙ্কের ছুটি পড়ার কথা। এখন তো এ টাকা সে দিতে পারবে না।
চিন্তান্বিত শ‍্যামলীকে বসিয়ে রেখে একটা প‍্যাকেট ঘর থেকে বের করে এনে তাকে দিলেন অনসূয়া।
এইটা পরো। আমি দেখব।
কি আছে এতে?
ওই যে, কাপড়চোপড় বদলাবার ঘর। ওখানে গিয়ে প‍্যাকেট খুলে দ‍্যাখো।
বাধ‍্য মেয়ের মতো প‍্যাকেট হাতে নিয়ে উঠে অনসূয়ার তর্জনী দিয়ে দেখানো ঘরে যায় শ‍্যামলী।
ও দিদি, এ যে একটা শাড়ি।
পরে চটপট এসো।
এই শাড়িটা আমি পরব?
হ‍্যাঁ। শাড়ি হাতে নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে চটপট পরো।
চমৎকার একটি কচি কলাপাতা রঙের তাঁতের শাড়িতে শ‍্যামলী কে দারুণ মানিয়েছে। ব্লাউজ টাও চমৎকার ফিট করেছে।
ও দিদি, ব্লাউজটা যে চমৎকার ফিট করেছে। মাপটা কি করে পেলেন?
গম্ভীর হয়ে অনসূয়া বললেন,
সভ‍্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ এই মাপ জিনিসটার চর্চা করেছে। ক্ষেত্রফল, পরিমাণ, আয়তন, দূরত্ব, সময়, নানাবিধ পরিমাপের আগ্রহ তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
মুখ টিপে হেসে ফেলে শ‍্যামলী। দারুণ দরজি তো। কোথায় বসে এই দরজি?
বাঃ শ‍্যামলী বাঃ। পরিমাপ করল একজন, আর গুণকীর্তন হচ্ছে আরেক জনের। মানুষের শরীর মানে কি?
মানুষের শরীর? তার আবার মানে হয় না কি?
অয়, অয়, জ়ানতি পারো না।
হেসে ফেলল শ‍্যামলী।
হাসচো কেন খুকি, নাট‍্যশালা এটা কি?
আরো হাসে শ‍্যামলী। এবার মুখ টিপে। কাজের মহিলা শুনতে না পায়।
মানুষের শরীর মানে, বেলন বা লম্ব বৃত্তাকার চোঙ, অর্ধ গোলক, এই সব। আন্দাজ যদি উঁচু মানের হয়, তাহলে কাটিং ভাল হতে বাধ‍্য।
ঢিপ করে অনসূয়াকে প্রণাম করে শ‍্যামলী।
আজ পঞ্চমী। তাই তোকে নতুন কাপড় পরালাম। ভাল থাকিস তুই। চিবুক ছুঁয়ে আদর করেন অনসূয়া।
এবার শ‍্যামলী অনসূয়াকে জিজ্ঞাসা করে, দিদি, আপনার নিজের জন্য শাড়ি কিনেছেন তো?
আচ্ছা, দেখবি আয়। বলে তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন একটা ঘরে। সেখানে একটা সেকেলে পালঙ্কের উপর প্রচুর পরিমাণে শাড়ি। অনসূয়া দেখাতে থাকেন, এই শাড়িগুলো ধনেখালির, এইগুলো বেগমপুরি, আর এইগুলো ফুলিয়ার তাঁতের।
বাণ্ডিল বাণ্ডিল শাড়ি এঁর। অথচ কোর্টে যখন যান, কি রকম সাধারণ শাদা শাড়ি পরে যান! শ‍্যামলী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে, এত এত শাড়ি কিনে এনেছেন?
ওরে, আমি কি আর কিনে এনেছি, সেকালে ঠাকুরদার আমলে তাঁতিরা এ বাড়িতে শাড়ি দেখাতে আসত। গিন্নিরা পুরুষ তাঁতির সামনে বেরোতেন না। তাই তাঁতিদের সাথে থাকত তাঁতি ব‌উ। বাড়ির গিন্নিকে পায়ে তেল মালিশ করে মন যোগাতো তাঁতি ব‌উ। তিনিই ঠিক করতেন কোন বধূর বাপের বাড়ি কোন্ শাড়ি তত্ত্ব যাবে। মোট খালি, আর ট‍্যাঁক বোঝাই করে, ফিরত তাঁতির দল। তারা কেউ ধনেখালির, কেউ বেগমপুরের, কেউবা আসত ফুলিয়া থেকে। সেই ট্রাডিশন…
শ‍্যামলী জুড়ল, ….সমানে চলেছে।…
এবার হেসে উঠল দুজনেই।
দিদি, এবার আমার মামলাটা শুনুন।
আচ্ছা। বল।
আমার ক‍্যাশবাক্স খোলা ফেলে রেখে কাউকে কিচ্ছুটি না বলে হেডমিস্ত্রি চলে গিয়েছিল বলে আমার খুব রাগ হয়ে ছিল।
তার পর? রাগের মাথায় তুমি কি করলে?
আমি কৈফিয়ত চাইলাম। কোন্ একতিয়ারে আপনি আমার ক‍্যাশ আলগা রেখে চলে গিয়েছিলেন?
লোকটা উত্তর দিল না। তাই তো?
হুম।
তো মিস শ‍্যামলী পাল, তারপর তুমি কি করলে?
ওইদিন আমার মজুরদের বোনাস দেবার প্ল্যান ছিল। ওইজন‍্যে টাকাও রেডি করা ছিল। টাকা বিতরণ না করে দিলে বেহাত হয়ে যাবার আতঙ্ক ছিল।
বেহাত হবে কেন শ‍্যামলী?
হবার কথা তো নয় দিদি। কিন্তু অমন হয়।
আচ্ছা, তারপর?
ওর সামনে সবাই কে বোনাস দিলাম।
আর হেডমিস্ত্রিকে কিছু দিলি না। তাই তো?
না, ওর থেকে একটা মুচলেকা নিলাম যে, যে দুটো গাড়ি সারিয়ে সারানোর খরচ আর পার্টসের দাম কালেকশন হয়নি, ওইটাকা যোগাড় করে এনে দিলে বোনাসের হাফ টাকা পাবে।
হাফ টাকা কেন?
হাফ টাকা তখনই দিয়ে রসিদ নিলাম।
আচ্ছা বেশ। তারপর?
আজ সকালে একটা নোটিশ লিখে ওকে সার্ভ করলাম। বললাম, কেন কারখানার ক‍্যাশ সামলানোর জরুরি দায়িত্ব ফেলে রেখে ও চলে গিয়েছিল। কার কাছে গিয়েছিল। সাতদিনের মধ‍্যে এর লিখিত জবাব দেবে। এই সাতদিন অফিসে আসতে হবে না। বাড়ি বসে মজুরির বারো আনা হারে পয়সা পাবে। সাতদিনের মধ্যে উত্তর না দিতে পারলে মালিকপক্ষ আইনি ব‍্যবস্থা নিতে পারবে। ও নোটিশ নিয়ে স‌ই করে দিল।
বাঃ, বেশ তো আটঘাট বেঁধে নেমেছিস। ওর বিরুদ্ধে তোর অভিযোগটা কি প‍রিষ্কার করে জানানো হয়েছে। বোনাসের হাফ টাকা দিয়ে রাখা আছে। না খেয়ে মরছি, মিস্ত্রির এমনটা বলার রাস্তা বন্ধ। তারপ‍র নোটিশ দিয়ে কাজে আসতে বারণ করেছিস, আর বারো আনা রেটে বসিয়ে পয়সা দিচ্ছিস। মালিকপক্ষ হৃদয়হীন, এটা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু, কি যেন একটা তুই লুকিয়ে রাখছিস শ‍্যামলী। কি বল্ তো?
সেটা বলব দিদি। এই অবধি আমার মামলাটা কেমন?
অনেকগুলো উইক পয়েন্ট আছে।
উইক পয়েন্ট?
হ‍্যাঁ। উইক পয়েন্ট। শান্ত স্বরে বলেন অনসূয়া। তুই বাচ্চা মেয়ে। বুঝতে পারিস নি। কিন্তু উইক পয়েন্ট রয়েছে।
শ‍্যামলী টানটান হয়ে বসল। উইক পয়েন্ট রয়েছে!
বলল, একটু বুঝিয়ে দেবেন?
আমাদের আইনি ব‍্যবস্থায় যে অভিযোগ আনে, তাকেই প্রমাণ করে দিতে হয় যে অভিযোগ সঠিকভাবে আনা হয়েছে, আর অভিযুক্ত ব‍্যক্তি প্রকৃত‌ই অপরাধী।
আচ্ছা দিদি।
আর বিচারের খুব বড় নীতি হল, শত অপরাধী পালিয়ে যায় যাক, একটিও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়।
শ‍্যামলী জিজ্ঞাসু মুখে চেয়ে থাকে।
 অনসূয়া বললেন, একটা খেলা খেলবি?
শ‍্যামলী অবাক হয়ে তাকাল। খেলতে হবে? সঙ্গে সঙ্গে গ্র‍্যাণ্ড ফাদার ক্লক ঢং ঢং করে গম্ভীর স্বরে পাঁচটার ঘণ্টা বাজিয়ে দিল।
দিদি, আমায় বাড়ি যেতে হবে।
না না, খেলাটা করে নিই। একটা চেয়ারকে ঘুরিয়ে দেন অনসূয়া। শ‍্যামলীর হাতের নড়া ধরে তাকে দাঁড় করান চেয়ারের পিছনে। চেয়ারের কাঁধে রাখলেন তার হাত দুটি।
শ‍্যামলী তুমি এখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছ। আমি বিপক্ষের উকিল। তোমাকে আমি ক্রস একজামিন করব। প্রথমে তুমি হুজুরের কাছে অভিযোগকারিণী হিসেবে নিজের জবানবন্দি দাও।
অনসূয়ার হাত লক্ষ্য করে কাল্পনিক এজলাসে হুজুরের দিকে তাকাতে গিয়ে সে দেখল খদ্দরের কাপড় গায়ে গোল রিমের চশমা পরে গান্ধীজি তার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে আছেন।
খেলার শুরুতে তোমাকে এখন তুমি মামলাকারী, তোমাকে শপথবাক্য পাঠ করতে হবে। বলো, আমি ….
আমি শ‍্যামলী পাল, পিতা শশাঙ্ক পাল, বয়স একুশ বৎসর,
অনসূয়া বলেন, বলো ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি…
শ‍্যামলী বলল ভারতের সংবিধানের নামে শপথ করে বলছি, যাহা বলিব সত‍্য বলিব। সত‍্য ব‌ই মিথ্যা বলিব না…
কি বললি তুই? ভারতের সংবিধানের নামে শপথ? ওই মামলাটাতেও বলেছিলি বটে। তা বেশ।
শ‍্যামলী গাঢ় ঘন স্বরে বলল, আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ন‌ই দিদি।
আচ্ছা। এখন আমাদের মামলা শুরু হয়ে গেছে। তুমি বাদীপক্ষ, নিজের বক্তব্য ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে পেশ করছ।
হুজুর, আমি আমার বাবা শশাঙ্ক পাল, যিনি পাল অটোমোবাইল এর আইনি স্বত্বাধিকারী, তাঁর তরফে এই পাল অটোমোবাইল দেখাশুনা করি। আমাদের কারখানার হেডমিস্ত্রি অমুক তারিখে কারখানার গাড়ি সারানো পরিচালনা করছিল। গাড়ি সারানো বাবদ খরচ আদায়, তা খাতায় লেখা আর সারানোর সূত্রে কোনো পার্টস, তেল, মোবিল, বা আর কিছু লাগলে সে সকলের দাম আদায় করে খাতায় তোলার কাজ তার ছিল। সে এই কাজ অনেক দিন ধরে করে অভ‍্যস্ত। এর জন্য সে মজুরি পায়। অন‍্য কালিঝুলি মাখার কাজ তাকে করতে হয় না, সেই কাজ ফেলে অন‍্য কারো ডাকে সে চলে গিয়ে ছিল। যাবার আগে সে মালিক পক্ষের কোনো অনুমতি চায় নি। অনুপস্থিত থাকার সময়ে ক‍্যাশের দায়, পার্টস এর স্টকের দায় সে কারখানার আর কারো হাতে তুলে দিয়ে যায় নি। দুটি গাড়ি সারানো বাবদ কারবারের প্রাপ্য টাকা আদায় না করেই সে চলে যায়। আমি এই শ্রমিকের বিরুদ্ধে কর্তব‍্যে গাফিলতির অভিযোগ আনছি। তার সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ আনছি।
আচ্ছা। তোর এই জবানবন্দি ম‍্যাজিস্ট্রেট ইংরেজি ভাষায় ডিকটেশন দিয়ে টাইপ করিয়ে তোর হাতে দিলেন। তুই দেখে স‌ই করে দিলি। এবার আমি বিপক্ষের উকিল, তোকে ক্রস একজামিন করবো। তোকে খেপিয়ে দিতে চাইব। উল্টাপাল্টা বলে তোকে খেলো করতে চাইব।
তুই কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখবি। হাজার প্ররোচনাতেও রেগে যাবি না।
শ‍্যামলী গম্ভীর ভাবে বলল, আচ্ছা।
আমি বিপক্ষের উকিলের পার্ট করছি, কেমন?
শ‍্যামলী হেসে বলল, আচ্ছা।
অনসূয়া বলতে শুরু করলেন,
আচ্ছা শ‍্যামলী দেবী, এই কারবারের মালিক আপনার বাবা শশাঙ্ক পাল। তাই তো?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ, কারবারের স্বত্বাধিকারী আমার বাবা শশাঙ্ক পাল।
তো, আপনি স্থানীয় একটি মহিলা কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্স পড়েন। তাই তো?
হ‍্যাঁ। আমি গণিতের ছাত্রী।
শ‍্যামলী দেবী, আপনার বাবা খুব অসুস্থ, আর বাবা এই কারবার দেখাশুনা করতে অসমর্থ, তাই তো?
না, বাবা দেখাশুনা করেন না, এটা ঠিক নয়। তিনি আমার মাধ‍্যমে দেখাশুনা করেন।
আচ্ছা। তাহলে ঘটনার দিন আপনার বাবা, যাঁকে আপনি মালিক বলে উল্লেখ করেছেন, তিনি উপস্থিত ছিলেন না।
শ‍্যামলী বলে, তা কেন, আমি তো উপস্থিত ছিলাম। আমার উপস্থিত থাকা মানে তো বাবার উপস্থিত থাকা।
না, আপনি বলুন, গণিতের সিলেবাস খুব শক্ত কি না।
শ‍্যামলী বলল, সিলেবাস শক্ত কেন হবে? বিশ্ববিদ্যালয় অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদগণ এই সিলেবাস প্রণয়ন করেছেন।
আচ্ছা, আপনি তো নিয়মিত কলেজে যান, আর পড়াশুনায় আপনার খুব আগ্রহ।
শ‍্যামলী অস্বীকার করে না।
বিপক্ষের উকিল সেজে অনসূয়া বলেন, হুজুর, পাল অটোমোবাইল এর মালিক অসুস্থ অথর্ব অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। আর মেয়েটা কেরিয়ারের জন‍্য ব‌ই মুখে পড়ে থাকে। বাপ মেয়ে কেউ কারবারে সময় দেয় না।
খেলাটা কেমন লাগছে শ‍্যামলী?
শ‍্যামলী বলল, হুম। মন্দ না।  উকিলরা এমনভাবেই কথা বলে।
অ্যাই শ‍্যামলী! আমিও কি এভাবেই কথা বলি?
শ‍্যামলী হাসে। দিদি ব‍্যতিক্রম নিয়মকেই প্রমাণ করে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।