• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ২ ।। খন্ড – ১)

কফি পাহাড়ের রাজা

দ্বিতীয় পর্ব:

১)

দোদ্দা বীরারাজেন্দ্র তাঁর নালকনাড়ু প্রাসাদের নিজের শয়ন কক্ষের প্রশস্ত পালঙ্কে শুয়ে আছেন। রাত এখন দুই প্রহর ছাড়িয়েছে। চোখে ঘুম নেই রাজার। এই প্রাসাদ যেমন তাঁর অতি প্রিয়, ঘন জঙ্গলের ভেতরে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তাঁকে এই প্রাসাদ তৈরি করতে হয়েছিল, তেমনি তাঁর পাশে ঘুমন্ত রানী মহাদেবাম্মাও তাঁর অতি প্রিয় রানী। মুদ্দুকেরির প্রাসাদ তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল ওই মুসলমান শাসকরা। সারা জীবন প্রাণপাত করে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে গিয়ে কোরাগুর অনেক অংশই তিনি পুনর্দখল করতে পেরেছেন, এমনকি অনেক চেষ্টায় ফিরিয়ে এনেছেন ওই মুদ্দুকেরির প্রাসাদকে। টিপু! এই নাম তাঁর জীবনকে যেন নিয়ন্ত্রণ করছে জন্ম থেকে। এই টিপুর জন্যই তিনি ছোটবেলা বন্দির জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। শৈশব কী তাঁর জানা হয়নি। মায়ের ভালবাসা, আদর, বাবার স্নেহের ছায়া কাকে বলে তিনি জানেন না। ভালবাসা বঞ্চিত এক মানুষ, এক বিদ্রোহীর জীবন কাটাতে তিনি একপ্রকার বাধ্য হয়েছেন টিপু তাঁর শৈশব কেড়ে নিয়েছেন যেমন, তেমনই তাঁর রাজত্ব, প্রাসাদ, মান, সম্মান, সব—সবকিছু ধুলোয় লুটিয়ে ছেড়েছেন। নির্ঘুম চোখ তাঁর জ্বলে উঠল আবারও রাগে। উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, অমাবস্যার রাতে কালো ছায়ার মতো কিছু নড়াচড়া করছে এখনও। তাঁর অতি বিশ্বস্ত পাহারাদার ওরা। কর্ত্তব্যে গাফিলতি ওরা করে না। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিলেন কিছুক্ষণ রাজা বীরা রাজেন্দ্র। ক্রমশ যেন একটু একটু করে চোখ সক্রিয় হল তাঁর। দূরের ঘন জঙ্গল আরও কালো ছায়া হয়ে ধরা দিল তাঁর কাছে। এই নালকনাড়ু প্রাসাদে তিনি পুরোপুরি নিরাপদ। চারিদিকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চিনে কোন স্থানীয় মানুষজন ছাড়া এখানে আসা প্রায় অসম্ভব। তাই টিপুর মতো বহিরাগত শাসকের পক্ষে লোকলস্কর নিয়ে এখানে আসা বা তাদের আক্রমণ করা কোনমতেই সম্ভব নয়।
পালঙ্কে মহাদেবাম্মার পাশ ফেরার শব্দ হল। ঘুমের ঘোরে তিনি যেন কিছু বলে উঠলেন সুখস্বপ্নে বিভোর তিনি এখন। ঘরের কোণের মৃদু প্রদীপের আলোয় রেশে মহাদেবাম্মার মুখ থেকে চুলের গুছি সরিয়ে দিলেন রাজা। মায়ায় ভরে উঠেছে তাঁর বুক। বড় বেশি ভালবাসা আর নির্ভরতা তাঁর এই রানীর ওপর। মহাদেবাম্মা তাঁর জীবনে না এলে বোধহয় তিনি আজ টিপুর বিরুদ্ধে এভাবে গর্জে উঠতে সাহস পেতেন না। গত বছর, অর্থাৎ ১৭৯৬ সালে এই প্রাসাদেই রানী মহাদেবাম্মাকে বিয়ে করে এনে তুলেছেন তিনি। দীর্ঘ একমাস ধরে সেই বিয়ের উৎসব চলেছে, রাজা আর রানী এই প্রাসাদের ঘরে নিজেদের মধুচন্দ্রিমা কাটিয়েছেন। ঘন জঙ্গল তার সাক্ষী থেকেছে, আর সাক্ষী স্থানীয় মানুষরা, আশেপাশের গ্রামের মানুষরা। তারা দুহাত তুলে রাজারানীকে আশীর্বাদ করেছে, একমাস কারুর ঘরে চুলা জ্বলেনি। একযোগে মহাভোজে মেতেছে তারা এই প্রাসাদে এসে। ওঃ! সেই সব দিনগুলির কথা মনে এলেই রাজার রোমাঞ্চ হয়। খানিক আগের ক্রোধ সংযত হয়ে এলো সেই দিনগুলির কথা ভেবে। রানীর শরীরের দিকে দৃষ্টি গেল তাঁর। আলুলায়িত শাড়ি, বক্ষবন্ধনী শিথিল হয়ে আছে তাঁর। ভারী বুকের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মহাদেবাম্মার প্রতি আকর্ষণ বুঝি কিছুতেই কাটবে না তাঁর। পেটের স্ফীত অংশে চোখ গেলে আরও মায়ায় আচ্ছন্ন হলেন রাজা। একজন বংশধর চাই তাঁদের। সুযোগ্য পুরুষ সন্তানের দাবী জানিয়ে রেখেছে ওই মুসলমান শাসকরা। কোন পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকলে নাকি তাঁর প্রিয় মুদ্দুকেরি শহর ও প্রাসাদ তাঁরা ফিরিয়ে দেবে না। এবং আবারও কোরাগু দখল করবে। যদিও আজ, তাঁর নিজের পুরুষ ও মহিলার পার্থক্য নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই কার্যত। মহাদেবাম্মা এসে বীরা রাজারাজেন্দ্রর চোখ খুলে দিয়েছেন। রাজা আগেও একটি বিবাহ করেছেন, সন্তানাদি হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মে। কন্যা সন্তান প্রথম পক্ষের। উপায়ান্তর না দেখে মহাদেবাম্মাকে বিবাহ করেছেন আবার। হ্যাঁ, কেবল পুত্র সন্তান লাভের আশায়। তখনও ভাবেননি একজন নারী তাঁর জীবনকে এভাবে ওলোটপালোট করে দেবে।
এই নালকনাড়ু প্রাসাদে অবশ্য তিনি আর মহাদেবাম্মাই থাকেন অনুচর, রক্ষী পরিবৃত হয়ে। এই প্রাসাদে তাঁর প্রথমা রানীকে সঙ্গে নিয়ে আসতে রাজার মন চায়নি। বড় রানী মেজাজী, দাসী পরিবৃত হয়ে তাঁর কন্যাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাঁদের জন্যও পৃথক এলাহি ব্যবস্থ আছে মুদ্দুকেরির প্রাসাদে, আছে নিয়মিত যোগাযোগও। তাঁরা সুখেই আছেন সম্ভবত। সতীন কাঁটায় জ্বলার মতো মানসিকতা বড় রানী বিয়ের দিনই বিসর্জন করেছিলেন, যখন দেখেছিলেন তাঁর রাজা তাঁকে নিয়ে খুব বেশি উৎফুল্ল নন। পরবর্তী কালেও খুব বেশি সময় তাঁকে দেননি রাজারাজেন্দ্র। টিপুর বিরোধিতা করতে তিনি বেশি উৎসাহী ছিলেন। তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে রানীকে প্রায় ভুলতেই বসেছেন রাজা। এই এক নিয়তি রানীদের। তবু যদি পুত্র সন্তান উপহার দিতে পারতেন রাজাকে, তবে নাহয় কদর থাকত তাঁর। ফলে খেদ নেই দুপক্ষেরই। কেউই নিজেকে নিপীড়িত, অবহেলিত বা নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর ভাবেননি। রাজেন্দ্র দেশীয় প্রথায় দুতলা প্রাসাদটি তৈরি করেছেন। পাথরের ঘোরানো সিঁড়ি, সাদা পাথরের মেঝে, লাল টালির দুতলা চাল, কাঠের থামওলা টানা বারান্দা দেওয়া এই প্রাসাদ গ্রীষ্মের দাবদাহের দিনে থাকে শীতল আর শীতের দিনে থাকে উষ্ণ। এই প্রাসাদ তৈরি হওয়ার সময়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে আসতেন রাজা। এই প্রাসাদ প্রাথমিক ভাবে তিনি গড়েছিলেন আত্মগোপনের জন্যই। প্রথম রানীকে ছেড়ে এই প্রাসাদে তিনি চলে আসেন ১৭৯৩ সালে। আর এখানে এসেই যেন তাঁর নতুন জীবন শুরু হয়ে যায়।
এই প্রাসাদে তিনি এসেছিলেন একপ্রকার যোদ্ধার জীবন কাটাবেন বলেই। নারী বর্জিত, সংসার বর্জিত হয়ে নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। যে করেই হোক, কোরাগুদের হৃত সম্মান তাঁকে ফিরিয়ে আনতেই হবে, এই ছিল তাঁর পণ। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। আর সেই বছরই দাক্ষিণাত্য কব্জা করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল বৃটিশরা। আর তাদের পথের কাঁটা ছিল ওই টিপু! টিপুর তাণ্ডবে বৃটিশরাও ছিল তটস্থ। তারাও স্থানীয় রাজাদের পাশে পেতে চাইছিলেন টিপুকে কোণঠাসা করার জন্য। চর ছিল তাদের চারিদিকে। স্থানীয়রা ছাড়া চরের ভূমিকায় কে আর কবে সফল হয়েছে! সেরকমই এক চর ছিল তাঁর মুদ্দুকেরিতে। এক রক্ষী মারফৎ ছেলেটি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায় একদিন। যদিও রক্ষীরা তাকে সন্দেহের চোখেই দেখেছিল। কিন্তু সেও ছিল অনড়। রাজার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতই তার কাম্য ছিল, নইলে সে সাক্ষাতে রাজী নয়। রাজদর্শনে তার লোভ নেই বিন্দুমাত্র। সে এসেছে এক গোপন খবর নিয়ে। যে খবর জানলে রাজারই আখেরে লাভ হবে নাকি, এমন খবরই তাঁর কাছে পৌঁছেছিল সেদিন। প্রথমে রাজারাজেন্দ্র ভেবেছিলেন তাড়িয়ে দেবেন ছেলেটিকে। তারপর ভাবলেন দেখাই যাক না কী বলে ছেলেটি। তিনিও দোদ্দা বীরারাজা। ভয়ডর তাঁর বরাবরই কম। নইলে টিপুর প্রাসাদের নজর এড়িয়ে তিনি পালিয়ে আসতে পারতেন না একা একা! আর ছেলেটি নিরস্ত্র কিনা সে তো পরীক্ষা করে নেবেই রক্ষীরা। এইসব ভেবে ছেলেটিকে আসতে অনুমতি দিলেন রাজা। আর সেই অনুমতি না দিলে তাঁর জীবনে এক মাহেন্দ্রক্ষণ হারিয়ে যেত।
এক রুদ্ধদ্বার কক্ষে রাজা ছেলেটির মুখোমুখি হলেন। অভয় দিয়ে তাকে বললেন, ‘বল, কী জানাতে চাও আমাকে’। ছেলেটি প্রথমেই অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘রাজা আজ আমি এই কোরাগুদের জন্য এক সুখবর এনেছি। মহান বৃটিশরা আমাদের সঙ্গপ্রার্থী হয়েছেন। স্বয়ং স্যার রবার্ট অ্যাবারক্রম্বে কুন্নুড় থেকে আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার কাছে। তিনি আপনার সাক্ষাতে আগ্রহী। তিনি আমাদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে ইচ্ছুক। পরিবর্তে টিপুর বিরুদ্ধে আপনাকে এবং সমস্ত কোরাগুদের বৃটিশদের সপক্ষে থাকতে হবে, এই তাঁর অভিলাষ’। রাজা ছেলেটিকে বখশিশ দিয়ে শীঘ্রই তাকে ডেকে পাঠাবেন জানিয়ে বিদায় দিলেন তৎক্ষণাৎ। তাঁর কপালে তখন গভীর চিন্তার কুঞ্চনরেখা, নাকের পাটার মৃদু শিহরণ, মুষ্টিবদ্ধ হাত ক্রমাগত খুলছে আর বদ্ধ হচ্ছে। ভাবছেন রাজা। একজনের আওতা থেকে বেরিয়ে আরেকজনের নিয়ন্ত্রণ মানতে হবে? নাকি এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না—চিন্তায় তাঁর মস্তিষ্ক সেদিন অসাড় হয়ে এসেছিল, আজও রাজার মনে পড়ে সেই দিনের কথা!

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *