এবাড়িতে ফ্রিজ খোলা মানা। আমি বাসন ভাল মাজতে পারিনা বলে
এরা আমাকে ঘটির মেয়ে, পটের বিবি বলে। আমি খিদের ডালপালায়
ঢাকা পড়ে যেতে যেতে অ্যাডজাস্টমেন্ট নামের বিষয়টি বুঝি। এখন
আমার পায়ের পাতায় ব্যথা করে খুব। ব্যথা করে বমি করে করে ক্লান্ত গলায়ও।
এসবে কেউ বিচলিত হয় না অথচ আমার ভারি ইচ্ছে করে, একজন অন্তত বিচলিত হোক। মাথায় হাত বুলিয়ে পীযূষকান্তির সিডি চালিয়ে দিক–জিজ্ঞেস করুক–বউ, তোর কী খেতে ইচ্ছে করে, বউ?
ইচ্ছেগুলো আর অন্তস্থ শিশুটি একসঙ্গে বাড়তে থাকে। ভেতরের প্রাণটিকে নিয়ে আমার আকুলিবিকুলি–চোখ এড়িয়ে যায় এদের। কেউ আকাশকুসুম বানায় না আমাদের নিয়ে। শুধু চিন্তা করে–চিন্তা করে বউ কতদিন ঠিক করে বাসন মাজতে পারবে না!
গর্ভধারণের শুরু থেকে, ঘর মুছতে বলেছেন শাশুড়ি। হাতে বেঁধে দিয়েছেন ছেলের মানত করা তাগা। কবচ পুড়িয়ে ছাই মানিয়েছেন নাভিতে। সেই নাভি-যাকে আগুনও পোড়াতে পারে না। ভস্মের প্রসাদে সে নাকি পুত্র আনবে বংশে। সাধও নাকি দিতে হয় ঘটা করে! তবে বড্ড খরচান্ত ব্যাপার। আমার সকালের দুধ বন্ধ হয়ে যায় এবং রোজের ডিমও। সাধে সোনার পাটিহার, গোলাপি কাঞ্জিভরম দেখে–বন্ধুদের চোখের ঈর্ষা। আত্মীয়দের মুখে প্রশস্থির বন্যা।
আমি বসার ঘর মুছে বারান্দায় যেতে যেতে দেখি দিনের
রং বদলে যাচ্ছে। সামনে আসন্ন শীত। আমার ভয় করে না আর মা!
আমি সোয়েটার বুনতে শিখিনি বলে–কফির কাপ নামাই তাক থেকে।
এবাড়িতে সবাই শীতকালে কফি খায়। প্রচুর দুধ–চিনি দেওয়া কফির ট্রে নামিয়ে রাখি টেবিলে– আর আমার বেড়ে ওঠা পেট দেখে–এরা ফিসফাস করে–আমার ত্বকের সোনা রঙে নাকি নিশ্চিত মেয়ের মা হওয়ার
স্বাক্ষর। কি যে আনন্দ হয় আমার!
মেয়ের কথায় আমার বারেবারে তোমাকে মনে পড়ে, জানো, মা?
আমাকে ছেলেবেলায় তুমি প্রজাপতি বলে ডাকতে।
আমার মেয়েকে আমি গুটিপোকা নাম দেবো। জানো, মা, এদের বড্ড ভয় মেয়েদের। মেয়ের কপালে এরা সিঁদূর ছাড়া কিছুই দেখতে শেখেনি–তাই
আমার কপালে শাঁখ দেখে আতঙ্কে দিশেহারা দিক-বিদিক। তুমি ভেবো না তা বলে! সে চিহ্ন আমি সামনে আনি না সচরাচর। ভেজা চুলে ঢেকে রাখি ললাট-উপত্যকা। শ্বশুড়বাড়ির দুশ্চিন্তা কমে না– ‘ঘরের বউয়ের এতখানি খাওয়া’–
এ আসলে অশনি সংকেত! এ আসলে আজীবনের বন্দি–শিবিরের উপার্জন। আমার হাসি-ই পায়, ইদানীং।
ইদানীং, এই হলুদ মোছা আঁচলে, আমি আবীর রঙের ওড়না জুড়েছি। ওড়নার আড়ালে এখন আমার খিদে ছাড়া আর কোনও জন্মদাগ নেই। মাটির দিকে নেমে আসা গর্ভফুলটির হাসিতে যে জীবন ফুটে উঠছে–তাকে গ্রহণের জন্য পূর্বনারীরা স্বপ্নে আশির্বাদ দেন রোজ।
ওর ডানায় কেউ যাতে কোনওদিন ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ বানান লেখার সাহস
না পায়, তাই আমি বাসন মেজে–রান্না সেরে–সেই রান্নার সামগ্রিক ত্রুটিসমূহ
জেনে–রাত জেগে পরীক্ষা দিয়ে–চাকরি পেয়ে গেছি গতমাসে।
যে খয়েরী খামে আমার অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার এসেছে, তার ওপরে
হেমন্তের ফসলের ছাপ। তার ভেতরে আমার নতুন ঠিকানা। সেই ঠিকানায়