• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। খন্ড – ১৩)

কফি পাহাড়ের রাজা

প্রথম পর্ব:

১৩)

কুপিল্লা সেদিন ফিরে এসেছিল সেই গ্রাম থেকে। হঠকারিতা একরকম, আর তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ আরেক হঠকারিতা, তার মোক্ষম শিক্ষা পেয়েছিল ও। বিদ্যার কাছ থেকে জল নিয়ে মুখচোখ ধুয়ে খানিক স্বস্তি এলে ও বুঝেছিল, এভাবে এখানে আসা তার সত্যিই উচিত হয়নি। যাদের যা নিয়মনীতি, তাদেরকে সেটাই মানায়। তার মানে এই নয় যে, বিদ্যাকে সে ভুলে গেছিল তৎক্ষণাৎ। ফিরে আসার সময়ে বিদ্যাও এসেছিল ওর সঙ্গে গ্রামের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। নাম জেনে নিতে ওর ভুল হয়নি। সামনেই আসছে আরেক উৎসব। দেখা সাক্ষাৎ ভাগ্যে থাকলে আবার হবে—এমন কথা দিয়ে কুপিল্লা সেদিন ফিরে এসেছিল বাড়িতে। রাতে খাবার পরে মায়ের মুখে শুনছিল সেই মেয়েটির কথা। যার সঙ্গে ওর বাবা বিয়ের ঠিক করেছে। আসলে শুনছিল বলা ভুল, মা নিজেই যেচে এসে ছেলেকে শোনাচ্ছিলেন হবু বউমার কথা। ছেলের মন পড়তে চাইছিলেন তিনি। মেয়েটিকে নাকি রাজকন্যার মতো দেখতে, এক ঢাল কালো চুল, গায়ের রঙ গৌরী, মুখের আদল পানপাতার মতো, আর বংশগৌরবের কথা তো আলাদা করে না বলাই ভাল। বিরাট বংশের মেয়ে সে নাকি। ওর বাপের বংশও যেমন রাজপুরোহিত ছিল, এরাও নাকি তেমনি। মা ছেলের বিয়ে নিয়ে খুব উত্তেজিত, কথা আর তাঁর ফুরোয় না। কুপিল্লা ডান হাতখানা চোখে আর কপালের ওপর চাপা দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে ছিল এতক্ষণ। এবারে বিরক্তিতে পাশ ফিরে শুলো। মা কী বুঝল কে জানে। খাটে এসে ওর পিঠে হাত রাখল। ‘কী রে কোপি! তোর ভাল্লাগছে না শুনতে? তোরই তো বিয়ের তোড়জোড় চলছে। লজ্জা পাচ্ছিস নাকি? খুলে বল আমাকে। তোর কি মেয়ে পছন্দ নয়?’
এবার উঠে বসল কুপিল্লা। খাট থেকে নেমে সোজা গিয়ে দাঁড়াল জানলার কাছে। মুখটা থমথম করছে ওর। মায়ের দিকে জ্বলন্ত চোখ রেখে প্রশ্ন করল ও, ‘আচ্ছা মা! এত যে রাজকন্যের রূপ আর গুণের প্রশংসা করছ, তাকে তুমি নিজে দেখেছ একবারও? ওদের বংশ গৌরব ধুয়ে কি আমি জল খাব? নাকি তোমার রাজকন্যেকে নিয়ে রাজত্ব করতে যাব?’ মা তো হতবাক ওকে দেখে। ‘কী হয়েছে তোর? এমন করে কথা বলছিস কেন? তোর বাপ যাকে পছন্দ করে এসেছেন, সেই মেয়ে কি খারাপ হতে পারে কখনও? তুই নিজেই বল!’ কুপিল্লা চুপ করে গেল এবার। একথা না মেনেও যে উপায় নেই ওর বা ওদের। বাবা কখনই পরিবারের অমর্যাদা বা অসহিষ্ণুতার কারণ হবেন না, এই স্থির বিশ্বাস ওদের সকলেরই আছে। তাহলে কেন রাগ হচ্ছে ওর? ভীষণ রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে…সবকিছু ভাংচুর করতে মন চাইছে? মা আবার কাছে এলেন কুপিল্লার। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘কাউকে মনে ধরেছে বুঝি? কিন্তু জানিসই তো, কোন উপায় নেই আমাদের। তোর বাবার কথাই শেষ কথা। মন থেকে ওসব ঝেরে ফেল। এ বিয়ে তোকে করতেই হবে। যা, আর রাত করিস না, ঘুমিয়ে পড়’।
  সেদিন সারারাত কুপিল্লা ছটফট করেছে। কিসের অশান্তি সে নিজেও বোঝেনি ভাল করে। শুধু বিদ্যার মুখটা মনে পড়ছে। মা বলে গেল সব ঝেরে ফেলতে। ঝেরে ফেলে দেবে? সেটাই তো ফেলা উচিত ওর। একে জাত আলাদা, তায় বাবার অমর্যাদা করা—দুটো বাধা টপকাতে সে পারবে না। ধুয়ে মুছে ফেলতে হবে ওই মুখ। রাজকন্যা কেমন দেখতে হয় মা? কুপিল্লার দুচোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল…মাগো! একবার তুমি রাজকন্যের মুখটা ওই মেয়েটার মুখের বদলে আমার মনে বসিয়ে দিয়ে যাও…প্রলাপে ভেসে গেল তার রাত। নির্ঘুম এক বিরহী সূর্য ওঠা দেখতে দেখতে শপথ করল—রাজকন্যাকেই সে মেনে নেবে পরিবারের স্বার্থে। অবেলার স্বপ্নে ভেসে উঠল এক কচি বালিকা মুখের ছবি। মাথায় তার তিনকোণা পাগ, কপালে তিলক, আয়ত আর ভাসা ভাসা দুই চোখে বুদ্ধির দীপ্তি ও সরলতা মাখামাখি হয়ে আছে। ছবির ফ্রেম থেকে সে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন! দুটো ছোট হাত বাড়িয়ে সে যেন ডাকছে কুপিল্লাকে—আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, এই ফ্রেম বন্দি জীবন আমার আর ভাল লাগছে না। পারবে না তুমি? পারবে না এখান থেকে আমাকে নিয়ে ওই সবুজ খেতের ধারে রেখে আসতে? ওই আলপথ দিয়ে ছুটে বেড়াব আমি। পারবে না তুমি? চোখ খুলে গেল কুপিল্লার। ঘরের ভেতরে রোদ এসে পড়েছে ত্যারছা হয়ে। ধড়মড় করে উঠে পড়ল কুপিল্লা। না জানি কত বেলা হয়ে গেল আজ! বাবার মুখটা মনে পড়তেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল ওর। আজ কপালে দুঃখ আছে ওর। তাড়াতাড়ি মুখচোখ ধুয়ে খাবার ঘরের দিকে এগোল ও।
   এমনিতেই অনেক বেলায় ঘুম থেকে উঠে কুপিল্লা অপরাধবোধে ভুগছিল। বাবার ভ্রুকুটি দেখে সে আরও কুঁকড়ে গেল ভয়ে। মা এসে কোনরকমে সামাল দিল পরিস্থিতি। বাবাকে বলল, ‘কোপির শরীরটা ঠিক নেই কাল থেকে। পেটে বায়ুর প্রকোপ বেড়েছে’। গম্ভীর মুখে বাবা সিদ্ধ ঝোলভাত খাওয়ার নিদান দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। দুপুরে অহেতুক সেই অখাদ্য সিদ্ধ ঝোলভাত খেতে খেতে মাকে প্রশ্ন করল কুপিল্লা। ‘আচ্ছা, তুমি আমাদের, মানে এই কোরাগু রাজাদের গল্প জান? গল্প না ঠিক, ইতিহাস জান?’ মা হেসে বলল, ‘কিছু তো জানিই। তোর বাপের মুখেই শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে’। ‘বেশ, তবে কী জান, শোনাও দেখি আমাকে। তারপর নাহয় তোমার রাজকন্যের কথা ভাবা যাবে’। মাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিশ্চিন্ত হলেন। হাতের কাজ সেরে বলবেন, এমনই কথা হল। তবে তর সইল না কুপিল্লার। এইসব তালেগোলে স্বপ্নে দেখা সেই বাচ্চা মেয়েটার মুখ প্রায় ভুলেই গেছিল। এখন মনে পড়ায় মাকে ডেকে সবটা বলল ও। ওর মা কিছুক্ষণ বাদে ঘর থেকে একটা পুরনো বই ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে নিয়ে এলো। তারপর পাতা উল্টে একটা ছবি দেখাল কুপিল্লাকে। ‘দ্যাখ তো! এই মেয়েটা এসেছিল নাকি তোর স্বপ্নে?’ কুপিল্লা সব দেখেশুনে হাঁ হয়ে গেছে। কোনরকমে ঘাড় নেড়ে সায় দিল। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই মেয়েটাই তো! কী আশ্চর্য! এই বইয়ের ভেতর এই মেয়ের ছবি এলো কিভাবে? আর তুমিই বা জানলে কী করে যে, এই মেয়ের কথাই আমি বলছি, এই মেয়েকেই আমি স্বপ্নে দেখেছি?’ মা তো হেসে বাঁচে না কুপিল্লার কাণ্ড দেখে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বললেন, ‘এই মেয়ে হল আমাদের দোদ্দা বীরা রাজেন্দ্র ও তাঁর প্রিয় রানী মহাদেবাম্মা’র মেয়ে দেবাম্মাজী। দেবাম্মাজী খুব অল্প বয়সে রানী হয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন। যেহেতু ওঁর বাবা-মায়ের আর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। বুঝলি এবার?’ কুপিল্লা কী বুঝল কে জানে। এইসব বোঝার বাইরে ওকে যা নাড়া দিচ্ছিল, তা আর কিছু নয়—ওর স্বপ্নে কেন এলেন দেবামজী! ভাবতে গেলেই গুলিয়ে যাচ্ছিল সব। মা চুপচাপ পাতা উল্টোচ্ছিলেন বইটার। আরেক পাতায় এসে অন্য এক মেয়ের ছবি দেখালেন। ‘এই মেয়ের নাম—গৌরাম্মা। ইনি হলেন শেষ কোরাগু রাজা, চিক্কা বীরারাজেন্দ্র’র প্রিয় মেয়ে। যাকে লন্ডনে পড়াশুনো শেখাতে নিয়ে গেছিলেন বীরা রাজা। তবে খৃষ্টান হতে হয়েছিল তাঁদের। স্বয়ং রানী ভিক্টোরিয়া ছিলেন গৌরাম্মার গড মাদার। ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মাকে এক বৃটিশ আর্মি অফিসারের সঙ্গে বিয়ে দেন। কিন্তু কপালের এমন ফের, গৌরাম্মা মারা যান অল্প বয়সেই। আর অদ্ভুত ভাবে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে সেই অফিসার ও তাঁদের ছেলেমেয়েদের আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি’। কুপিল্লা ভাবছিল, কী কুক্ষণে রাজকন্যার কথা মুখে এনেছিল ও। আর বাস্তবের রাজকন্যাদের খবর পড়ে সে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। ভবিষ্যতে কী লেখা আছে ওর কপালে কে জানে! তবে যাই হোক না কেন, কুপিল্লার কুর্গের ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে হবে বিস্তারিত ভাবে। ওর মাও জানে কত কিছু, আর ও! একজন শিক্ষিত যুবক, যে কিনা নিজেদের ইতিহাস জানেনি এতদিন। লজ্জা, লজ্জা! আজ থেকেই কুপিল্লা কোরাগুর ইতিহাস পড়তে বসবে।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *