“বাসন্তী ইন কুত্তোকে সামনে মত্ নাচনা”… অতীব জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রের এক হিট সংলাপ | মানুষকে নিচ প্রতিপন্ন বা ভর্ৎসনা করতে এভাবেই পশুর উপমা অহর্নিশি টানা হয় | এই অভ্যেস আমাদের মজ্জাগত | যে কোনও কুকর্মে মানুষকে ‘জানোয়ার’, ‘জন্তু’, ‘কুত্তা’, ‘শূকর-সন্তান’ ইত্যাদি বলে উষ্মা প্রকাশ, চলতি কথায় যাকে বলে ‘গায়ের জ্বালা’ মিটিয়ে থাকেন ‘মানুষ’ |
একবারও ভেবে দেখা হয়না, মানুষের চাইতে হিংস্র, চতুর, নীতিহীন প্রাণী আর দ্বিতীয়টি নেই এই ধরণীতে ! ‘
ধর্ষকের প্রতি ঘৃণা উজাড় করতে প্রায়শই ‘জন্তু’ শব্দের প্রয়োগ ঘটে ! কেবল মুখের কথায় নয় ! গল্প উপন্যাসের পংক্তিতে যা হতাশ করে গভীরে ! অথচ শিক্ষিত মানুষের এ কথা অজানা নয় যে পরস্পরের সম্মতি ব্যতিরেকে কদাপি মিলনোদ্যত হয়না পশুরা !
ধর্ষকের মতো কদর্য, ক্ষমাহীন অপরাধীর বিশেষণ নির্ধারণে কোনও চারপেয়ে প্রাণীর উল্লেখ নিতান্তই অবান্তর এবং অযৌক্তিক !
সারমেয়কে পোষ্য করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে বা নেই তারা সকলেই অল্প বিস্তর জানেন কতটা বিশ্বাসী, কর্তব্যনিষ্ঠ ও মহৎ গুণবিশিষ্ট এই প্রাণীটি | জীবনের শেষ বিন্দু দিয়ে, কখনো-বা নিজের প্রাণ বিপন্ন করে প্রভুকে রক্ষা করার দায়বদ্ধতার নজির সে রেখেছে | অনেকের মতে, “the most loyal animal on earth”
ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ‘কুত্তা’ শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করার আগে মানুষ কী ভেবে দেখেন তা যথোপযোক্ত কিনা ?
এ প্রসঙ্গে মনে আসে সারমেয় নিয়ে কিছু সত্যঘটনা |
আমার এক পরিচিত’র পোষ্য কুকুর তাঁর গৃহে আগত কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রতি সর্বদা বিরাগ প্রদর্শন করত। সে’সময় কুকুরটির আচরণ তাঁকে খুবই বিব্রত করত, বন্ধুরাও অসন্তোষ প্রকাশ করতেন গৃহস্বামীর পোষ্যর এহেন আচরণে। কিন্তু পরবর্তী কালে প্রমাণিত হয় যাঁদের প্রতি কুকুরটি সন্তুষ্ট ছিল না তাঁরা প্রত্যেকেই সেই ব্যক্তির সাথে কৃতঘ্ন আচরণ করেছেন, গোদা বাংলায় যাকে বলে ‘বেইমানি’ | কুকুরের ঘ্রাণশক্তির কথা কে আর না জানেন, মানুষের ষষ্ঠেন্দ্রীয়র ক্ষমতা চিরদিন হার মেনেছে যার কাছে!
মানুষের সাথে মানুষ কতোই বিশ্বাসঘাতকতা, অকৃতজ্ঞতা ক’রে থাকেন কিন্তু সারমেয়র সততা ও বিশ্বস্ততা নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই নেই, মানুষের বরং অনেক কিছু শিক্ষণীয় এই প্রাণীটির কাছে !
কোনও এক রাতে দমদমের কাছে, এম সি গার্ডেন এলাকায় পাড়ার কুকুরের দল চেঁচামেচি শুরু করে।
প্রথমে আমল দেননি এলাকার লোকজন।
এরপর মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য সারমেয়র দল কিছু বাড়ির কাছে হল্লা শুরু করে।
সে’সব বাড়ির বাসিন্দারা বাধ্য হ’য়ে বেরিয়ে এসে দেখেন একটি কাপড়ের পুঁটুলিকে ঘিরে কুকুরের দলের এই উত্তেজনা। কাছে গিয়ে দেখা যায় দামি চাদরে মোড়া একটি সম্ভ্রান্ত ঘরের সদ্যজাত শিশু!
শিশুটিকে মানুষের হেফাজতে দেবার পর দলটি শান্ত হয়। বহুক্ষণ ঘিরে রেখে শিশুটিকে তারা পাহারা দিয়েছে, তবে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি, একটি আঁচড়ও কাটেনি শিশুটির দেহে |
“A dog is the only thing on earth that LOVES you more than he loves himself “
বলেছিলেন Josh Billings.
এক ব্যক্তি বিশেষ শখের কারণে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যের বিনিময়ে একটি কুকুর ক্রয় ক’রে আনেন।
যা তার বাড়ির অন্য সদস্যরা সমর্থন করেননি।
কুকুরটির ভাগ্যে জোটে সকলের অনাদর ও অবহেলা।
কেবল যিনি শখ করে তাকে এনেছেন তাঁর কাছেই সে পেতে থাকে যাবতীয় আদর, যত্ন, ভালোবাসা।
বাড়িতে তখন সকলের নয়নের মনি, ভদ্রলোকের সাত মাস বয়সী শিশুপুত্র |
একে তো তার আগমন ও অবস্থানে পরিবারে কেউ খুশি নয়, আহারের সময় এই চেঁচামেচিতে সকলেই যারপরনাই বিরক্ত হ’তে লাগলেন।
কিন্তু তার অস্বাভাবিক ডাকাডাকিতে ওপরের ঘরে
যেতে যা দেখা গেল তা বিস্ময়কর !
ভদ্রলোকের সাত মাসের শিশুপুত্রটি খাটের কিনারায় এসে বিপদজনক ভাবে ঝুলছে এবং কুকুরটি প্রাণপনে তার পিঠ দিয়ে শিশুটিকে প’ড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করছে।
শিশুটির মা স্বভাবতই এই দৃশ্য দেখে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
সজল নয়নে পুত্রকে কোলে তুলে নেবার সাথে কুকুরটিকে জড়িয়ে ধরেন আবেগে, কৃতজ্ঞতায়।
এ কারণেই বুঝি বলা হয়েছে,
“Not every person knows how to love a dog, but every dog knows how to love a person”.
হামেশাই শোনা যায় পথের ধরে পড়ে থাকা অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে দেখেও নির্বিকার চিত্তে হেঁটে চলে যান উদাসীন নাগরিক | এর বিপ্রতীপে যখন দেখি আহত পশু বা পক্ষীকে সহমর্মিতায় ঘিরে আছে তার স্বজাতির দল, মানুষ হিসেবে গ্লানিবোধ এড়াতে পারি কি !
‘পাশবিক’ শব্দটি যেমন সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলার কথা ভাবা প্রয়োজন, তার পাশাপাশি মানবিক’ শব্দটির চিরকালীন ব্যবহারও অক্ষুণ্ন থাকবে, যেহেতু প্রকৃত অর্থে মানবিকতা সম্পন্ন মানুষের অভাব ঘটেনি আজও!
অস্বীকার করা যায়না, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সাধারণ জনমানসে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে !
শিল্পের কারিগরেরা ‘অমানুষ’ বা নরপিশাচ চিত্রিত করার ক্ষেত্রে পশুর উপমা ব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন এ আশা রাখা কি নেহাতই দুরাশা ?/ বাতুলতা ?