দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৯)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১৯
১১৮
ডি এস পি’র ঘরে বসতে বলা হল শ্যামলীকে । ভাল কাপে চা দিয়ে গেল একজন অধস্তন কর্মী । চা খাবে কি না ভাবল সে। একটু রাগ হল । ফাঁকা ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। চেয়ারে নরম গদি রয়েছে। আর বইয়ের সুদৃশ্য আলমারিতে ঠাসা ভাল ভাল বই। সেখানে রম্যা রলার লেখা একটা বই দেখে সে অবাক হয়ে গেল। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করায় তার শিক্ষিকারা তাকে ওই বইটি উপহার দিয়েছিলেন । একটু যেন মন ভাল হয়ে গেল শ্যামলীর। এমন সময়েই ডি এস পি ঢুকলেন।
“চা পেয়েছেন?” সুশ্রী সুদর্শন ডি এস পির গলায় বেশ একটা আন্তরিক ভাব।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে শ্যামলী বলো “হ্যাঁ , পেয়েছি। কিন্তু খাইনি।“
সহজ গলায় ডি এস পি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন “কেন?”
একটু অভিমানের সুরে শ্যামলী বললো “ধরে এনেছেন কেন?”
“আপনাকে ওসি বলে নি কেন ধরে এনেছে?”
“হ্যাঁ, বলেছেন। বললেন আমি নাকি এলাকায় শান্তি ভঙ্গ করেছি আর সরকারী কর্মচারীর কাজে বাধা দিয়েছি ।“
ডি এস পি বলেন “ হ্যাঁ, সেই অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল।“
অস্থির হয়ে শ্যামলী বলে “তাহলে আমায় কোর্টে চালান করুন। এখানে বসিয়ে রেখেছেন কেন?”
“আমার আলমারির বইগুলো কেমন?”
শ্যামলী সংক্ষেপে উত্তর দিল “ ভাল। কিন্তু আমায় আটকে রেখেছেন কেন? আমায় ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে পাঠান । সেখানে আমি জামিন নেবো ।“
ডি এস পি বললেন “আমার আলমারির থেকে কোনো বই পড়তে ইচ্ছে হলে নিতে পারেন । তো আর একবার চা আনতে বলি। এটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।“
“আমি চা খাব না।“
“কেন? এখানকার চা বেশ ভাল। খেয়ে দেখুন।“
অনুযোগের সুরে শ্যামলী বললো “শুনুন , আমায় ধরে এনে বসিয়ে রেখে ভাল ভাল কথা বলছেন, এটা কিন্তু আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে।“
“কি সন্দেহ হচ্ছে?”
“কি আবার সন্দেহ হবে? আপনাদেরকে ভরসা কিছুই নেই।“
“কেন, পুলিশকে ভরসা নেই কেন?”
রাগ রাগ মুখে শ্যামলী বললো “কি করে থাকবে? আমার কারখানার শ্রমিককে মাফিয়ার লোক পেটালো, আমার টেবিলের কাচ ভেঙ্গে দিয়ে গেল, আমি থানায় গেলাম, পুলিশ কিছু করে নি। আর এখন আপনারা বলছেন আমি নাকি এলাকায় শান্তি ভঙ্গ করেছি আর সরকারী কর্মচারীর কাজে বাধা দিয়েছি । আপনাদের আচার আচরণের কিছু ঠিক আছে?”
“পুলিশের ওপর খুব রাগ না আপনার?”
“রাগ হবে কেন? পুলিশ তো এই রকমই ।“
“কি রকম?”
“মানে, এই রকম। সাধারণ নাগরিকের অভিযোগ নিতে তার অনীহা। আর প্রভাবশালী লোকের সেবাতে তারা এক পায়ে খাড়া।“
“মানে এই আপনার অভিজ্ঞতা ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নিজের অভিজ্ঞতা । তবে আপনি একটু ভালো পুলিশ। মেয়েদের সাথে ভদ্রভাবে কথা বলতে শিখেছেন। কিন্তু আপনার ওসি মশায় একেবারে যাচ্ছেতাই । মেয়েদের তুই তোকারি করতে ওর বাধে না। ওর দেখে দেখে নিচের লোকগুলোও সেই রকম শিখেছে।“
“তা আপনি সকাল থেকে রাস্তায় গোলমাল পাকাচ্ছিলেন কেন?” ডি এস পির গলায় মজা করার স্বর।
“কে বললো গোলমাল পাকিয়েছি?”
“আমি দেখেছি। আমি গাড়ি নিয়ে সামনে দিয়ে গিয়েছিলাম। তার পর আমিই পুলিশ পাঠিয়ে আপনাকে ডেকে আনি।“
“কি গোলমাল করতে দেখেছেন?”
“লোকের বাড়ির সামনে ঘিরে রেখেছিলেন। তাদের চলার পথ আটকে দিয়েছিলেন।আইনতঃ এটা আপনি করতে পারেন না।“
“না, আমরা গরিব লোকেরা কিছুই করতে পারি না। শুধু রোদে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে বছরে বছরে ভোট দিতে পারি আর নুন থেকে শুরু করে হাজার রকম জিনিস কিনলে ট্যাক্স গুণতে পারি।“
“আপনি খুব চমৎকার করে বলতে পারেন। কিন্তু বেআইনি কাজ তো মোটেও করা উচিত হয় নি আপনার।“
“কিসে বেআইনি দেখলেন আপনারা?”
“ এই যে লোক জমায়েত করে একটা নাগরিকের চলার পথ আটকে দেওয়া। গণতন্ত্রে তো এটা হতে পারে না। অবাধে চলাচল করতে পারা লোকের অধিকার । আমরা পুলিশেরা তো লোকের অসুবিধা হতে দেখলে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।“
“কি রকম লোক তারা সে খবর জানেন আপনারা? জানেন, তার আমার কারখানায় গিয়ে আমার মিস্ত্রিকে পিটিয়েছে? জানেন আমার টেবিলের কাচ ভেঙ্গে দিয়েছে? আর গাড়ি সারিয়ে মেরামতি আর পার্টসের দাম দেয় নি। সেটা কি আপনার গণতন্ত্রে অ্যালাও আছে? না কি মাফিয়ার জন্যে পুলিশের নিয়ম কানুন আলাদা?”
“আপনি “হরে কৃষ্ণ হরে রাম” গান করছিলেন কেন?”
“মোটেও “হরে কৃষ্ণ হরে রাম” করছিলাম না। আমি রামধুন গাইছিলাম। ওটা মহাত্মাজির প্রিয় গান। আমি সত্যাগ্রহ করছিলাম। অনশন করে সত্যাগ্রহ ।“
“তাই? তা পুলিশকে জানিয়ে তো সত্যাগ্রহ করবেন।“
“পুলিশকে জানিয়ে যদি কাজ হতো তাহলে তো তাই করতাম। পুলিশের নিচের তলা থেকে ওপরতলা অবধি মাফিয়ার চাকর বাকর হয়ে গেলে সত্যাগ্রহ ছাড়া শান্তিপ্রিয় নাগরিকের আর কি করার থাকে? আমি সন্ত্রাসবাদী নই। আমার হাতে অস্ত্র ছিল না। আমি রাষ্ট্র বিরোধী কোনো স্লোগান দিই নি। তবু যদি বলে্ আমি এলাকায় শান্তি ভঙ্গ করেছি, আর সরকারী কর্মচারীর কাজে বাধা দিয়েছি, তাহলে বলতে হয় আপনার শান্তির ধারণা আর আমার শান্তির ধারণা আলাদা। আর সরকারী কাজ বলতে আপনি যা বোঝাতে চান, তা সাধারণের কাছে মাফিয়ার দাসত্ব করা।“
“বাঃ, আপনি তো দারুণ বলেন!
“না, আর আমায় বসিয়ে রাখবেন না। এবার আমায় কোর্টে পাঠান। সেখানে আমার কৃতকর্মের বিচার হোক ।“
“আপনার কৃতকর্মের বিচার আমিই করবো।“
“না, আপনি সেটা পারেন না। আপনি অভিযোগ করবেন, আর আপনিই বিচার করবেন, এটা সভ্য সমাজের দস্তুর নয়। বিচার করবেন আদালত। আপনি আমায় কোর্টে চালান করুন।“
বেল বাজিয়ে আর্দালি কে ডেকে ডি এস পি চা আনতে বললেন। তার পর ফোন তুলে কাকে যেন বললেন – “আজ আমার বার্থ ডে ।“
ওপার হতে জবাব এল – “কি করতে হবে স্যার, হুকুম করুন।“
“কিছু না, একটু ভাল ভাবে সেলিব্রেট করার ইচ্ছে হয়েছে।“
“কোনো হোটেলে বুক করে দেব স্যার? কজন থাকবেন সাথে? ড্রিঙ্কস কি নেবেন?”
“না, হোটেলে নয়, একটা গ্যারাজে আপনি গাড়ি সারিয়ে পয়সা দিতে ভুলে গিয়েছেন, আর কাচের একটা দাম আছে, আর মিস্ত্রীটা অসুস্থ, ওর একটা ডাক্তার খরচ।দু হাজার টাকা পাঠিয়ে দিন।“
“এটা জবরদস্তি হয়ে যাচ্ছে স্যার।“
“না, এটা আপনার কাছে সামান্য টাকা। হাতের ময়লা বলতে পারেন। পাঠিয়ে দিন। আমার জন্মদিনের গিফট মনে করে।“ বলে ডি এস পি সাহেব ঠক করে রিসিভারটা রেখে দিলেন।
শ্যামলী বলল – “এটা কি হল?”
“কিসের কি হল? আপনি আমার কৈফিয়ত চাইছেন? সাহস তো কম না?”
“আপনি আমার সত্যাগ্রহটাকে খেলো করে দিতে চান?”
“আপনি তো মহা ঝগরুটে ! আপনার কারবারের কথা ভেবে গিফট চাইলাম! বার্থ ডে গিফট ।“
“সত্যি আজ আপনার জন্মদিন?”
“আমার এখন রোজ জন্মদিন । আজ মা বেঁচে থাকলে পায়েস করে খাওয়াতেন ।“
ঘরের বাতাস ভারি হয়ে এল।