দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১০)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১০
১০৩
অনেকক্ষণ ধারাস্নানের পর শরীর মন একটু স্নিগ্ধ হলে স্নানঘরের আয়নার দিকে তাকালো শ্যামলী । আয়নাটা বাবা বাছাই করে এনেছিল। কলকাতার কোথায় যেন পুরোনো আসবাব বিক্রি হয় । সেখান থেকে নিজে হাতে বাছাই করে কিনে এনেছিলেন তিনি। আয়নার ভেতর নিজেকে খোঁজে মেয়ে । চুল থেকে টুপ টুপিয়ে জল ঝরছে । জল ঝরছে কানের লতি থেকে।
দর্পণের ভিতর থেকে এক শ্যামলী জিজ্ঞাসা করে “ও মেয়ে রাগ কমলো?”
দর্পণের পাশে তল কাটা কাচ থেকে আরেক শ্যামলী উঁকি মারে । “ এত রাগ কেন গো মেয়ে?”
মাথাটা নাড়লে দর্পণের দুই তলের দুই ছায়া শ্যামলীও মাথা নাড়ে। চোখ টিপলে ওরাও চোখ টেপে।
“ জানো , কার ওপর রাগ করতে হয়?
“ আমার যে রাগ হয় ! আমি যে কি করি ! বলো তো কি বিচ্ছিরি ভাবে ওদের উকিল আমাদের লজে থাকা নিয়ে কথা তুললো ? কুৎসিত ইঙ্গিত করলো কোর্টের ভেতরে! আমি রাগবো না?”
“ আর কার ওপর রাগ তোর?”
“ প্রিন্সিপ্যালের উপর । উড়ো চিঠিকে কেউ পাত্তা দেয়? কোনো সভ্য ভদ্র লোকে উড়ো চিঠি দেয়? সেই নিয়ে উনি আমায় কি রকম করে বললেন ! আশ্চর্য ভদ্রমহিলা!”
“ হ্যাঁ রে, তুই রোজা লুক্সেমবার্গ এর নাম মনে করতে পারিস ?”
দু চোখ বুজিয়ে শ্যামলী বলে “ হুঁ , পারি তো “
“সে মেয়ের কি হয়েছিল মনে আছে তোর?”
“বেশ মনে আছে। জার্মানির শ্রমিক আন্দোলনের মেয়ে তিনি। কমিউনিস্ট । গণতন্ত্র হত্যাকারীরা ওঁকে নগ্ন করে প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল । প্রাণটাই চলে যেত । কোনো মতে রক্ষা পায়।“
বাঃ , বেশ মনে আছে তো তোর! তার পর?
“ তার পর এক সাংবাদিক একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিল রোজা লুক্সেমবার্গকে।
“ কি জিজ্ঞাসা করেছিল?”
“বলেছিল – ওরা আপনাকে ওভাবে নিয়ে যাচ্ছিল, আপনার লজ্জা করছিল না?”
তার পর?
“তার পর আর কি? রোজা লুক্সেমবার্গ বলেছিলেন – কেন লজ্জা করবে কেন?”
“সাংবাদিক বলেছিল – না, মানে, আপনি একটা মেয়ে কি না, আপনাকে ও রকম একেবারে বেপরদা করে নিয়ে যাচ্ছিল ওরা ।“
“ তাতে কি? সাংবাদিককে পালটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন শ্রমিক নেত্রী ।“
“ মানে ওভাবে এলো গায়ে যেতে হলো … লজ্জার ব্যাপার ।
“ জ্বালা ভরা কণ্ঠে কমিউনিস্ট মেয়েটি সাংবাদিককে বলে দিল – শুনুন মশাই , মানুষের লজ্জা করে মানুষের কাছে। কুকুরের কাছে তার কিসের লজ্জা ! “
নিজের শরীরের উচ্চাবচতা দর্পণে দেখতে দেখতে নিজের সাথে নিজে কথা বলে চলে শ্যামলী ।
এক সময় গায়ে ঘরোয়া পোশাক জড়িয়ে নিজের ঘরের দরজা খোলে সে। দেখতে পায় আলো আঁধারির মধ্যে মেঝেতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সবিতা পিসি। পিসিকে ঠেলে তোলে সে।
“ ওঠো ওঠো , ভেতরে এসে শোও ।“
দু চোখ ভরে জল পিসির । “অনাথা বেওয়া মানুষ আমি । সকলের অবছেদ্দার পাত্র । তা বলে দোর দিয়ে আর খুললি না? ছেলেটা কি মন নিয়ে ফিরে গেল বলতো । তোর বাবা মা কতো বার ডাকলো । সাড়াটি দিলি না। তোদের আশ্রিত বলে আমি কি দুটো একটা রহস্যও তোর সাথে করতে পারবো না? “ অভিমানে এক নাগাড়ে বকে যেতে থাকে পিসি ।
“ নাও, আমার রাগ কমেছে। এবার ঘরে এসে শোও দেখি । এই আমার বিছানাতেই শুয়ে পড়ো ।“
“ না বাবা, আর আমার তোমার বিছানায় শুয়ে কাজ নেই । গরিবের এই মাটির বিছানাই ভালো ।“
লাল রঙের মেঝেতে আঁচল পেতে শুয়ে পড়ে পিসি । আধো ঘুমে বলে যেতে থাকে “ ছোটোটি থেকে তোকে নাড়ছি চাড়ছি । আমার তো আর কেউ নেই। এই তোরাই । এসে পড়লাম তোদের বাড়ি । পিসি পিসি করতিস, পিসি এটা কি, সেটা কেন… আমি মুখ্যু মেয়ে … শউর বাড়ি থেকে তাইড়ে দিয়েছে … তোরাই আমার সব। নিজের বে’র কথা মনে নেই । কি যে হয়েছিল। খুব ঘুম পাচ্ছিল এইটুকু মনে আছে। কড়ে রাঁড়ি বলে কেউ বিয়ের আসরে ঘেঁষতে দেয় নি কোনোদিন। আমারও তো শখ যায়, সাধ যায় একটু আহ্লাদ করি। না হয় তোকে পেটেই ধরি নি । বাকি সব তো করেছি । তাই যদি নতুন মানুষকে নিয়ে দুটো রহস্য করে থাকি , তা বলে দোর আটকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা … কি রাক্ষুসে রাগ তোমার মা !”
শ্যামলী লজ্জা পায় । কিছু কথা না বলে বিছানা ছেড়ে পিসির পাশে মেঝেয় শুয়ে পড়ে । পিসির আদুড় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে । জানালার ফাঁকে দূরের আকাশে কোথায় একটা লাল তারা চোখ মটকে তাকায় ।
১০৪
কলেজ থেকে ফেরার পথে গ্যারেজে ঢুকল শ্যামলী । চুপচাপ সকলে নিজের কাজ করে যাচ্ছে । অফিস ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখল তার টেবিলের কাচ ভাঙা । ভাঙা কাচ দেখে খুব বিরক্ত হল শ্যামলী । জিজ্ঞাসা করতে যাবে কে কাচ ভেঙেছে, এমন সময় শ্যামলী দেখলো ঘরের বাইরে হেড মিস্ত্রী যন্ত্রণায় কোকাচ্ছে ।
“কি হয়েছে?”
“কিছু হয় নি।“ বলে সে আবার গাল চেপে বসে পড়ে।
“আগে বলুন কি হয়েছে ?”
অন্য একটি মিস্ত্রী এসে বললো, রাম নারায়ণ মিশ্রের লোকে এসে হেড মিস্ত্রীকে গালে থাপ্পড় মেরে গেছে ।
“কে রাম নারায়ণ মিশ্র ? কি হয়েছিল ?”
শ্যামলী জানতে পারলো রাম নারায়ণ মিশ্র এলাকার ছাঁট লোহার বড় ব্যবসায়ী। রেলের লোহায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য । সেই রাম নারায়ণ মিশ্র তার একটা গাড়ি পাঠিয়েছিল মেরামত করতে। হেড মিস্ত্রী বলেছিল কিছু টাকা অ্যাডভান্স না করলে কাজে হাত দেবে না। তাই তাকে পিটিয়েছে লোহা মাফিয়ার লোকে ।
“তোরা কিছু বলিস নি?”
ছোড়দি, কিছু না বলতেই তোমার টেবিলের কাচ ভেঙে, মিস্ত্রী মশায়ের গালে থাপ্পড় মেরে গিয়েছে । বললে হয়তো কারখানাই উড়িয়ে দিত।
শ্যামলী নির্দেশ দিল “যাও, থানায় এফ আই আর করে এসো । বলবে রাম নারায়ণ মিশ্রের লোকে এসে জোর খাটিয়েছে, ভাঙচুর করেছে । মারধোর করেছে। যাও এফ আই আর করে এসো ।“
হেড মিস্ত্রী বেঁকে বসলো। “দিদি পুলিশে গিয়ে কাজ নেই। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা । পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। আমি এফ আই আর করতে গেলে তো পুলিশ নেবেই না। উপরন্তু রাতের বেলা এসে বিছানা থেকে টেনে তুলে নিয়ে যাবে । তুমি ছেড়ে দাও ছোড়দি । পুলিশে গিয়ে কাজ নেই ।“
“তোমরা এভাবে পিছিয়ে থাকবে? চলো আমিই যাবো ।“ ককাতে ককাতে উঠে দাঁড়িয়ে মিস্ত্রী বললো – “দয়া করো, আর ঝামেলা পাকিও না। থানায় তুমি গেলে পুলিশ হয়তো ডায়েরি নেবে। কিন্তু কিছু করবে না। বউ বাচ্চা নিয়ে কিন্তু আমার জীবন অতিষ্ঠ করে দেবে। পুলিশ ওদের কাছে মাসোহারা পায়।“
শ্যামলী নিজেও ভরসা পাচ্ছিল না। বেশ মনে পড়ে যাচ্ছিল থানার দারোগার কীর্তি । রাত্রিবেলা এসে একটা মেয়েকে তুই তোকারি করে কথা বলতে বাধে না এদেশের পুলিশের। গরিব গুরবো বস্তিতে থাকা মানুষজন পুলিশের সামনে দাঁড়াবে কি করে?
তবু সে সাহস দেখিয়ে বললো – “তাহলে আমায় কিছু করতে হয়। তুমি ভয় পাচ্ছ যখন, তোমায় কিছু করতে হবে না। কিন্তু আমার কারখানার কাচ ভেঙেছে, আমি তো চুপ করে থাকবো না । আমার ক্ষতিপুরণ চাই ।“
হেড মিস্ত্রী বললো “দোহাই আপনার, আমার মজুরী থেকে কাচের দাম কেটে নেবেন। আমায় আর এই ঝামেলার মধ্যে ঠেলে দেবেন না। গরিব বেচারী । আমি বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘর করি। হয় তো আমার অজান্তে আমার মেয়েটাকেই তুলে নিয়ে যাবে ওরা।”
শ্যামলীর চোখের সামনে থেকে যেন একটা পরদা সরে যায়। দেখে পুলিশকে কি অসম্ভব ঘৃণা করে মানুষ, স্বাধীন দেশে না কি এমন হয় ? পুলিশ যাকে খুশি, যা খুশি কেস দিয়ে নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে!
১০৫
মনস্থির করে শ্যামলী নিজেই গেল থানায়। দুটি কিশোর শ্রমিক ইতস্ততঃ করে তার সঙ্গে গিয়েছিল। থানায় ঢুকতে তাদের পা কাঁপছিল বলে তারা গেটের বাইরে রয়ে গিয়েছিল। থানায় ডিউটি অফিসারের কাছে শ্যামলী জানতে চাইলো ওসি কোথায় ?
ডিউটি অফিসার বললো “আপনার যা দরকার এখানেই বলবেন। সাহেব ব্যস্ত আছেন ।“
শ্যামলী বললো “ আমি এফ আই আর করবো।“
“ কেন, কি হয়েছে ?”
“ আমি বলে যাচ্ছি, আপনি লিখে নিন। “
ডিউটি অফিসার বললো “ আপনি লিখে আনুন ।“
শ্যামলী স্থির করলো যে সে ওসি’র সাথেই কথা বলবে । ঘণ্টা দুয়েক বসার পর ওসি’র ঘরে ঢুকতে পেল সে।
“ আবার আপনি শ্যামলী পাল? কি হয়েছে এবার?”
“ আমি এফ আই আর করবো । আপনি লিখে নিন।“
“কেন, কি হয়েছে?” অতিরিক্ত শান্ত ভাব দেখিয়ে ওসি বললেন।
শ্যামলীও শান্তভাবে বললো “আমার অফিসে ঢুকে রাম নারায়ণ মিশ্রের লোক ভাঙচুর করেছে। আমার লোককে পিটিয়ে জখম করেছে।“
“আপনি লিখে এনেছেন?”
“না, আপনি আমার কথা শুনে শুনে লিখে নিন।“
“ম্যাডাম, আমার তো অতো সময় হবে না। আপনি আমার ডিউটি অফিসারের কাছে একটা লেখা জমা দিয়ে দিন।“
“কিন্তু নাগরিক অভিযোগ জানাতে এলে লিখে নেবার নিয়ম আছে । আমি জেনারেল ডায়েরি করতে আসি নি। নির্দিষ্ট লোকের বিরুদ্ধে আমার গ্যারাজে চড়াও হওয়া , আমার মিস্ত্রীকে মারধর করা, আমার জিনিস ভাঙচুর করার ব্যাপারে বলতে এসেছি । এ ধরণের অপরাধে এফ আই আর হয়।“
বেল বাজিয়ে আর্দালিকে ডাকান ওসি । একটা কাগজ আনতে বলেন। সাথে কারবন পেপার।
শ্যামলী লিখে ফেলল তার অভিযোগ । লিখলো যে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি তার গ্যারাজে এসে চড়াও হয়ে তার মিস্ত্রীকে মারধর করেছে আর ভাঙচুর করেছে।
শ্যামলী কারবন প্রতিলিপির ওপর রশিদ পেল।
“এ কি, জেনারেল ডায়েরি করতে তো বলি নি । বলেছি এফ আই আর করতে। এ তো কগনিজেবল অফেন্স ! আপনি জি ডি করালেন কেন?”
“ম্যাডাম, ঘটনা ঘটার সময় আপনি কলেজে পড়াশুনা করছিলেন। কে ঢুকেছিল আপনি চোখে দেখেন নি। যারা আপনাকে এসব বলেছে, তারা আপনার সাথে আসে নি । যাকে মেরেছে, সে আসে নি।“
“দাঁড়ান, দাঁড়ান , আমি কারবারের ম্যানেজার। আমি মালিকের তরফে বলছি। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলেছি যে আমার কর্মীকে ওরা পিটিয়েছে ।“
“ওরা কারা?” শান্ত গলায় ওসি জানতে চান।
জিভে চলে আসা লোহা মাফিয়ার নামটা নিল না শ্যামলী । সতর্ক গলায় বললো – “কারা সেটা আপনি খুঁজে দেখবেন।“
“হ্যাঁ দেখবো তো। এই তো আপনার লেখা জমা নিয়ে রশিদ দিলাম । আগে দেখি কোথায় কে কি করেছে। তার পর একটা ব্যবস্থা নেব। দুম করে কিছু করে ফেলি কি করে?”
হেডমিস্ত্রী আর অন্য মজুরগুলোর ওপর রাগ হচ্ছিল শ্যামলীর। এরা ভারি মেরুদণ্ডহীন । একটু আসতে পারলো না। ভেতরে ভেতরে আবার সমবেদনার একটা তিরতিরে স্রোতও বইছিল তার মনে। লেখাপড়া মানুষকে সাহস, ব্যক্তিত্ব আর আত্মবিশ্বাস যোগায়। সেই লেখাপড়ার সুযোগটা এরা পায় নি। এরা মাথা তুলে দাঁড়াবে কোন পুঁজিতে ?