গল্পে অনির্বাণ বসু
শশীর ঘরকন্না বনাম পুতুলের বিষয়আশয়
খালের ধারে বজ্রাহত প্রকাণ্ড বটগাছটার পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে হাসপাতালটাকে দেখছিল শশী। পুবমুখো হাসপাতালের ঠিক পিছনে, সেইখানে তখন সূর্যদেবতা দিবাবসানের ইশারা করলেন।
তালবনে শশী আর যায় না। তার ওপাশে যে-টিলাটি আছে, সেই মাটির টিলাটির উপর দাঁড়িয়ে আর সে সূর্যাস্ত দেখে না। কুসুম চলে যাওয়ার পর অনেকদিন পর্যন্ত সে সূর্যাস্ত দেখত না। ইচ্ছেটাই মরে এসেছিল। একেবারে মরে যায়নি যে বোঝা যায় যখন একদিন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল, হাসপাতালের ছাদে জলের ট্যাঙ্ক মেরামতির তদারকি করতে গিয়ে নিভন্ত সূর্যটার দিকে তার চোখ চলে গেলে। সে বুঝেছিল : ইচ্ছেটা এখনও দিব্য রয়ে গেছে। সেই আগের মতোই। এই সত্যিটা বুঝে ফেলেই তার মন-কেমন করে ওঠে কুসুমের জন্য। সেইসব মানুষদের কথা মনে পড়ে যায় তার, যারা এই গাওদিয়ায় ছিল একদিন। যামিনী কবিরাজের বাড়িটা আড়ে-বহরে বেড়েছে অনেকটাই। হামানদিস্তার ধাতব শব্দ অবিকল শোনা না-গেলেও অমনই এক শব্দের অনুরণন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সচল রাখে গোটা গাওদিয়াকে। কবিরাজের বাড়ি ভেঙে কারখানা হয়েছে। বড়ো-বড়ো মেশিনে রান্নার মশলা পেষাই হয়। আস্তে-আস্তে আবার সে শুরু করে সূর্যাস্তের সময় পশ্চিম কোণে তাকিয়ে রংঝুরির নির্মাণ ও বিনির্মাণকে অবলোকন।
গাওদিয়া এখন আর গ্রাম নেই। হাসপাতাল কারখানা স্কুল কলেজ রাইসমিল তো আছেই, তার উপর বিডিও অফিস হয়ে তাকে এখন আর গ্রাম বলা যায় না। পাড়া-কালচার থাকার কারণে সে এখনও পুরোপুরি শহুরে হয়ে উঠতে না-পারলেও, হাবেভাবে তাকে মফস্বল বলাই যায়। গাওদিয়ার ঘাটে এখন জেটি বসেছে। বাজিতপুর আর গাওদিয়ার মাঝে ভটভটি চলে। জেটিঘাটের টিকিট কাউন্টারে বসে তখন হাঁপায় গোবর্ধনের নুয়ে-যাওয়া শরীরটা।
হাসপাতালের দিকে চেয়ে শশী ভাবে অতীত দিনের কথা। যাদবের যে এত সম্পদ ছিল, ঘুণাক্ষরেও কেউ কখনও টের পায়নি; এত অর্থ যে সিদ্ধান্ত হসপিটালের মতো একটা হাসপাতাল গড়ে ফেলা গেল। সূর্যসিদ্ধান্ত পড়েনি শশী কিন্তু যাদবের অনুষঙ্গটুকু বাঁচিয়ে রাখতে সূর্যটাকে আড়াল করে সিদ্ধান্তটুকু নিয়ে হাসপাতালের নামে জুড়ে দিয়েছে সে। হাসপাতালের গায়ে বড়ো করে খোদাই করা আছে নামটা। ইংরেজিতে নামের শেষে ‘এ’ থাকলেও বাইরে থেকে-আসা অনেক ডাক্তারই উচ্চারণ করেন ‘সিদ্ধান্ত্’। একটা হসন্ত লাগিয়ে। যাদবের বাড়ি এবং সংলগ্ন জমিতে এখন হাসপাতালের নিজস্ব কোয়ার্টার। সিদ্ধান্ত জেনারেল হসপিটাল স্টাফ কোয়ার্টার।
তখন হাসপাতাল তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে, গোপাল চলে গেছে কাশীযাত্রায়, তখন একদিন সুদূর ওরান থেকে একটি চিঠি এসেছিল শশীর নামে। সেই চিঠিতে তার ডাক্তার-বন্ধু ডক্টর বের্নার্ড রিউ একজন প্রকৃত ডাক্তারের ভাবনা কী বা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে আলোচনার সূত্রে লিখে পাঠিয়েছিল হিপোক্রিটাসের এই লাইনগুলো। মনে ধরেছিল শশীর। হাসপাতাল সম্পূর্ণ হয়ে গেলে পরই সে অর্ডার দিয়ে একটা বোর্ডে এই পুরো বক্তব্যটাকে লেখায় এবং ঝুলিয়ে দেয় হাসপাতালের দেওয়ালে। তার ঠিক পাশটাতেই রিসেপশন। মতি ফিরে-আসার পর শশীই ওকে একপ্রকার এনে বসিয়েছে এখানে। কুমুদের সঙ্গে বিভিন্ন বিচিত্র দেশ ঘুরে এখন সেও বেশ চটপটে হয়ে উঠেছে। কুমুদেরই কোনও বদল হয়নি। সে যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। যেহেতু সন্তানের কারণে তাদেরও একদিন নীড়-বাঁধার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, তারা ফিরে এসেছিল গাওদিয়ায়। হারু ঘোষের পরিত্যক্ত বাড়িটাকে বাসযোগ্য করে থিতু হয়েছিল।
বকুলতলার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে এখনও মাঝেসাঝে শশী খোঁজে সেই ন্যাকড়া-জড়ানো পুতুলখানাকে; তারপর নিজের মনেই বিষণ্ণ হাসি হেসে নঞর্থক মাথা নাড়ায়। কুমুদ-মতির মেয়েটাকে একটা পুতুল কিনে দেবে বলে শ্রীনাথের দোকানে গেছিল সে। সেখানের রকমারি পসরা দেখে তার ধাঁধা লাগে। পুতুল বলতে এতদিন যেমনটা সে বুঝত, কোনও পুতুলই আর তেমন নয়। কাপড়, মাটির জায়গা নিয়েছে পুরু প্ল্যাস্টিকের আস্তর। মাথায় ইউরোপীয়দের ধাঁচে ফুরফুরে সোনালি চুল। কোনওটার চোখ বাদামি, কোনওটা-বা নীল; কালো প্রায় নেই। কোনও-কোনওটার তো আবার হাত-পাও নড়ে-চড়ে। মানুষ নয়; কিন্তু অনেকটা ঠিক মানুষের মতোই। গেঁয়ো অপরিচ্ছন্ন মানুষদের মতো নয়; শৌখিন, কেতাদুরস্ত। পুতুল চাইতেই শো-কেস থেকে তিন-চারটে বাক্স নামিয়ে শ্রীনাথ বলেছিল : ‘কার জন্য, ছোটোবাবু? মতির মেয়েটার জন্য বুঝি!’ বাক্সগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে-দেখতেই শশী মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছিল। তারপর শ্রীনাথ যখন আরও-কয়েকটা পুতুল ─ বাক্সের বাইরে বেরিয়ে এসে হয়তো-বা মালিকের কথামতো যেগুলো সার দিয়ে দাঁড়িয়েছিল শো-কেসের কাচের আড়ালে ─ নামিয়ে আনছিল তার সামনে, সে জিজ্ঞাসা করেছিল : ‘আচ্ছা শ্রীনাথ, আমরা যে সেই কাপড়-জড়ানো পুতুল দেখতাম, সেগুলো আর পাওয়া যায় না?’
‘ওসব আর পাওয়া যায় না, ছোটোবাবু। আজকাল এগুলোরই বাজার। বাজিতপুরে বড়ো গোডাউন আছে। সেখান থেকেই আমার দোকানে সাপ্লাই হয়।’
‘ঝুলনের সময়ও পাও না?’
‘ঝুলন আর কে মনে রাখে এখন! তবু ওই যে-ক’জন করে, ওই ─ ওই পুতুলগুলো দিয়েই সাজায়।’ পিছনের দেওয়াল-আলমারিতে সাজানো হাত-পা নড়াতে সক্ষম ছোটো পুতুলগুলোর দিকে দেখিয়ে বলে শ্রীনাথ।
মোটামুটি পছন্দসই দুটো বার্বি পুতুল কিনে ঘরে ফেরার সময় শশীর মনে পড়েছিল, ছেলেবেলায় বিন্দুর সঙ্গে বাজিতপুরে গিয়ে-দেখা পুতুলনাচের স্মৃতি। কী সুন্দর গল্পে-গানে নেচে বেড়াত গোটা মঞ্চ জুড়ে! তার মনে পড়েছিল, তাদের গ্রামে যাত্রার আসর বসার কথা। মনে পড়েছিল, রাজপুত্র প্রবীরের বেশে আসর জমিয়ে দিয়েছিল কুমুদ। সেদিন কী দুর্দান্ত অভিনয়টাই-না করেছিল সে। তার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠেছিল দেশজ শিল্পের অপমৃত্যুতে। হাতে বহুজাতিক পণ্য আঁকড়ে ধরেও মনে-মনে গাল পেড়েছিল পুঁজি নামক শব্দটির অদৃশ্য বেয়াড়াপনাকে।
|| দুই ||
সেদিন হাসপাতালে ঢুকতে গিয়ে থতমত খেয়ে যায় শশী। রিসেপশনের পাশের প্রতিটি চেয়ারে ধোপদুরস্ত শার্ট-প্যান্ট-টাইয়েরা বসে খোশগল্প করছে নিজেদের মধ্যে। ইশারায় মতিকে বিষয়টা জানতে চায় সে। যেন এমন-কিছুই-নয় গোছের জবাব আসে মতির তরফে : ‘ওরা! ওরা তো এমআর! মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ!’
‘রিপ্রেজেন্টেটিভ! ডাক্তারের আবার নিজেকে প্রেজেন্ট করবার কী আছে!’ নিজের মনে বিড়বিড় করতে-করতে ডিরেক্টরের কেবিনে ঢুকে যায় শশী।
নিজস্ব কেবিনে ঢুকে ঘর-লাগোয়া ওয়াশরুমে যায় সে। চশমাটা খুলে পাঞ্জাবির বুকপকেটে চশমাটা রেখে বেসিনের সামনে দাঁড়ায়। মুখে-চোখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দেয়। পাশের ঝোলানো হাত-তোয়ালেটা নিয়ে মুখ মোছে। মুখ মুছতে গিয়ে তার চোখ বেসিনের উপরের আয়নায় পড়লে সে দেখে, তার মুখে দিনকয়েকের না-কামানো কাঁচা-পাকা খোঁচা দাড়ি। এমনিতে সপ্তাহে দু’বার নিয়ম করে দাড়ি কামায়; কিন্তু এবার আর তার খেয়াল হয়নি। গত ক’দিন তার মাথা জুড়ে কিছু মানুষের উচ্ছেদের ছবি ঘুরে বেড়িয়েছে প্রতিমুহূর্তে। যতক্ষণ জেগে থেকেছে, ততক্ষণ তাদের চিন্তায় বুঁদ থাকলেও তা তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করেনি; কিন্তু ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে প্রায়ই তারা তাড়া করেছে তাকে। একটা সময় ঘুম ভেঙে গেছে তার। বাকি রাত তারপর সে উঠে গেছে ছাদে। অক্লান্ত পায়চারি করেছে শুধু। ফের ঘুমোনোর চেষ্টা যে করেনি, তা নয়; কিন্তু চোখ বুজলেই তার মনে হয়েছে, রক্তহীন কয়েকটা কাটা আঙুল তার চোখে ঢুকে যাচ্ছে। আবারও উঠে পড়েছে সে। আঙুলগুলোর কথা ভেবেছে ভোর পর্যন্ত। সে স্পষ্ট দেখেছে, ওই আঙুলগুলোয় বিক্ষিপ্ত কাটা দাগ; অনেকটা আঁচড়ের মতো। ওই আঁচড়ের মানে তখন বুঝতে পারেনি শশী।
বুঝেছিল সেদিন রাতে, ঘুমের মধ্যে। ঘুমঘোরে সে দেখেছিল এক মহাযুদ্ধ। অধিকার বুঝে নিতে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
শ্রীনাথের দোকানে-দেখা পুতুলগুলো আচমকা জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল। নেমে এসেছিল বাঁধানো বকুলগাছটার কাছে। প্রত্যেকের হাতেই উদ্যত অস্ত্র। তাদের সামনে তখন অসহায় ঠুঁটো জগন্নাথের মতো দাঁড়িয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল পুতুলনাচের পুতুলগুলো। জিআইজো-র দল তাদের প্রাপ্ত প্রশিক্ষণ মোতাবেক বিন্দুমাত্রও আর অপেক্ষা করে না প্রতিপক্ষের আক্রমণের। ঝটিতি কাজ সারে তারা। খানিক পরে বাঁধানো বকুলতলা জুড়ে পড়ে থাকে নিষ্প্রাণ কতগুলো মৃতশরীর; ধুতি-পাঞ্জাবি-পাজামা-লুঙ্গি-গামছা ভরে ওঠে রক্তে। প্রশিক্ষিত কম্যান্ডোর দল তখন মেতে ওঠে সমবেত উল্লাসে। এর কিছু পরে আরও-কিছু চাষাভুষোর আকস্মিক আগমনে নিজেদের শরীর কোন-এক জাদুমন্ত্রে বিশালাকায় করে ফেলে তারা এবং আক্রমণ শানায়। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের সামনে নত হয়ে আসে কাস্তে-গাঁইতি-বল্লম-কোদাল-তির-ধনুক; কেউ-বা পালিয়ে বাঁচে শরীরের সর্বত্র আঁচড়ানোর, খাবলানোর অভিশাপ নিয়ে। জিআইজো-দের অস্ত্র থেকে চুইয়ে পড়া মাত্রই সেই রক্ত শুষে যোগ্যতমের উদ্ববর্তনকে স্বীকৃতি দেয় মাটি। একটা সময় সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যায় রক্তের সবটুকু দাগ। এরপর শুধুই আপাতত শান্তিকল্যাণ।
ধড়ফড় করে উঠে বসেছিল শশী। ঘামে ভিজে গিয়ে গায়ের সঙ্গে লেপটে গেছিল ভিতরে-পরার হাফহাতা গেঞ্জিখানা। অন্ধকারে হাতড়ে-হাতড়ে জলের জগ খুঁজেছিল সে এবং না-পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢের মতো বসে থেকেছিল মশারির ভিতর; আর তখনই তার মনে পড়েছিল বাবার কথা, বিন্দুর কথা, যাদবের কথা; আরও বেশি করে কুসুমের কথা। অনেকদিন পর সে-রাতে হাউহাউ কেঁদেছিল শশী।
বেসিনের উপরে আয়নায় মুখ মুছতে গিয়ে এসবই মনে পড়ে যায় তার। ব্যস্ত হাতে আবারও চোখে জলের ঝাপটা দেয় সে। তারপর কোনওরকমে মুখ মুছে এসে বসে চেয়ারে। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে টেবিলের উপর-রাখা জল-ভর্তি ঢাকা-দেওয়া কাচের গ্লাসটার দিকে। এভাবেই কেটে যায় বেশ কিছুটা সময়।
টেবিলের উপর-রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠতেই গ্লাসের জল নিমেষে শেষ করে ফোনটা ধরেছিল সে। হুবিনাল উরবিনো; তার আর-এক ডাক্তার-বন্ধু। গত কয়েক বছর ধরে সে খুঁজে চলেছে এইডসের প্রতিষেধক। সেই নিয়ে এবং আরও বহুবিধ বিষয় নিয়েই শশীর সঙ্গে আলোচনা চলে তার। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গ্যানাইজেশনের একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে জেনিভা গেছিল শশী। সেখানেই রিউ আর উরবিনোর সঙ্গে পরিচয়। তারপর চিঠির আদানপ্রদান; ফোনালাপ।
কথা বলে বেশ ভালোই লাগল শশীর। এতরকম বিষয় নিয়ে আড্ডা দিতে পারে উরবিনো, সাময়িক হলেও মন থেকে ভারটা সরে গেছিল তার। সে ভাবল, পরে কখনও বহুজাতিকের সঙ্গে দেশীয় ঐতিহ্যের সাপে-নেউলে সম্পর্কের ব্যাপারটা ওর থেকে জানবে। একটু সময় দিলে উরবিনো ঠিক নিজেকে তৈরি করে নেয়।
হসপিটাল ক্যান্টিনের দিকে যেতে গিয়ে শশী দেখল, রিসেপশনে মতি বসে আছে। হঠাৎ কিছু-মনে-পড়ার মতো ভাব নিয়ে সে টেবিলের সামনে এল : ‘মতি, আজ একজন নতুন ডাক্তারবাবু আসছেন। নাম শুনলে বিদেশি মনে হবে। কিন্তু অ্যাকচুয়ালি উনি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। অভিজিৎ ডলসওয়ার্দি।’
‘ডলসওয়ার্দি! কেমন-একটা ডলপুতুল-ডলপুতুল ব্যাপার!’
|| তিন ||
চারপাশ থেকে যূথবদ্ধ হাতের ভিড় ঘিরে ধরে শশীকে। সাদা গোলাপি রূপালি হলুদ আকাশি বেগুনি রঙের ওষুধের স্ট্রিপ সেইসব হাতের মুঠোয়। ঘুরে বেড়ায় তার মুখের চারপাশে। তার মাথার চারপাশে। একবার আকাশি এগিয়ে আসে, পরক্ষণে তাকে সরিয়ে বেগুনি চলে আসে। পারস্পরিক এই ধাক্কাধাক্কির মাঝে হঠাৎ সব কেমন যেন থেমে যায়। ওষুধ-স্ট্রিপগুলো হাঁপায়। দম নেয়। বেশিক্ষণ থেমে থাকে না। ঘুরে চলে। কারখানার ভোঁ বেজে উঠতেই মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো শশীর মাথার চারপাশে তারা ঘুরতে থাকে। তার মাথার চারপাশ জুড়ে প্রবল হয়ে ওঠে উপসাগরীয় ঘূর্ণিবাত। শুধুই মাথা ঘোরে সেই ঘূর্ণনে, সঙ্গে কি গোটা শরীরই ঘোরে, নাকি মাথা স্থির থাকে আর গলার নীচ থেকে বাকি শরীর বনবন ঘোরে—বোঝে না শশী; কিন্তু এটুকু অন্তত সে বুঝতে পারে, সে পড়ে গেছে কোনও-এক বিনাশী কালচক্রে, যা প্রতিমুহূর্তে তাকে আছাড় দিয়ে ফেলছে এবং পতনের সঙ্গে-সঙ্গেই পুনরায় উঠে যাচ্ছে শূন্যে এবং আবারও সেই বাঁইবাঁই ঘুরপাক। এবং পতন এবং উত্থান এবং পতন। তার মনে হয়, বুঝি-বা এক্ষুনি সে মারা যাবে; আর তাই প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য সে ছুটতে শুরু করে। দৌড়, দৌড়, আর দৌড়। সামনের যে-রাস্তা বরাবর তার চোখ যায়, সেদিকেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে সে। ভয়ে পিছনে তাকাতে সাহস পায় না। এভাবে বেশ কিছুটা দৌড়ানোর ফলে তার হাঁপ ধরে। দম নেওয়ার জন্য পা দুটোকে সে শান্ত করে, অথচ তার পা-জোড়া তার কথা শোনে না; সিধে-থাকা অবস্থাতেও তারা কেঁপে চলে। সেই কাঁপুনি শিরদাঁড়া বেয়ে উপরের দিকে উঠে এলে ভীতি ছড়াতে থাকে তার সর্বাঙ্গে। ভয় ফিরে এলে সে চকিতে পিছন ঘোরে। ওষুধের স্ট্রিপ-ধরা হাতগুলো এগিয়ে আসে তার দিকে। সঙ্গে পরিচিত দু’টি অক্ষর; বর্ণ। ইংরেজি অ্যালফাবেট। ‘আর’ এবং ‘এক্স’। তারাও কখন এসে জুটে গেছে সেই আগ্রাসী মিছিলে। অক্ষর দু’টিকে দেখে তার মনে হয়, এতদিন ধরে রুগিদের জন্য যত-যত প্রেসক্রিপশন সে লিখেছে, সেখান থেকে প্রতিটি ‘আর’ এবং ‘এক্স’ নেমে এসেছে রাস্তায়। সবাই একজোট হয়ে তাড়া করছে তাকে। হতভম্ব হয়ে থমকে গেছিল; ‘আর’ এবং ‘এক্স’-এর ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরলে সে আবারও দৌড়তে শুরু করে। দৌড়, দৌড়, শুধু দৌড়। ছুটতে-ছুটতে সে শুনতে পায় দূরগামী কোনও-এক তীব্র আওয়াজ। যত সে দৌড়য় সামনের দিকে, শব্দের প্রাবল্য ততই বাড়তে থাকে। এদিকে পিছনে ‘আর’ ও ‘এক্স’-এর নেতৃত্বে তাড়া করে আসছে ওষুধের স্ট্রিপ-ধরা উন্মাদ হাতের দল। কাটা হাতেরা এখনও তাড়া করছে কিনা দেখবার জন্য ছুটতে-ছুটতেই সে ঘাড় ঘোরালে দেখে, হাতের আক্রোশী পাঞ্জারা সব বেমালুম উধাও। বরং ওষুধ-স্ট্রিপগুলো থেকে হাত-পা বেরিয়ে এসেছে তারা আরা এগিয়ে আসছে দ্বিগুণ আক্রোশে। ‘আর’ এবং ‘এক্স’-এর ঠিক পিছনে ওষুধ-স্ট্রিপের সামনে ব্যূহ রচনা করে নিপুণ যোদ্ধার মতো হুংকার তুলছে ক্যাপসুল ট্যাবলেট সিরাপের বোতল ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ। ওই ঘাড়-ঘোরানো অবস্থাতেই সে পড়িমড়ি ছুটতে থাকে। জোরে, আরও জোরে। আরও-কিছুটা এইভাবে ছোটার পর এক বিকট আওয়াজ শুনতে পায় সে। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ নৈর্ঋত ঈশান অগ্নি বায়ু ঊর্ধ্ব অধঃ ─ আওয়াজটা কোনদিক থেকে আসছে, তীব্র হচ্ছে ক্রমে ─ বুঝতে পারে না সে। সে ভয় পায়। আরও আরও ভয়। সে দৌড়য়। দৌড়, দৌড়, উদ্ভ্রান্ত দৌড়। তার প্রতিটি দুদ্দাড় ছুটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সেই আওয়াজ। বাড়তে-বাড়তে একসময় তা গর্জন হয়ে যায়। আর দৌড়তে পারে না সে। যেন এক ধমকে কেউ থেমে যাওয়ার নির্দেশ দেয় তাকে আর পুতুলনাচের পুতুলের মতো সে সেই জীমূতমন্দ্র গর্জনের সামনে নতজানু হয়ে বসে। ওষুধ-স্ট্রিপেরা তাকে ঘিরে ফেলে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে নাচতে থাকে। নাচ, নাচ, আরও নাচ। কোনওরকমে সে মাথা তুললে বোঝে যে, এই নাচ আর তার ছোটোবেলায়-দেখা পুতুলনাচে কোনও ফারাক নেই। বর্তমানের সঙ্গে অতীতকে যেইমাত্র সে মিলিয়ে ফেলে, ভবিষ্যৎ থেকে ‘আর’ এবং ‘এক্স’ দু’জনে দু’দিক থেকে টেনে ধরে তার হাত। হাতে টান পড়ার ফলে হাঁটু-গেঁড়ে-বসা-অবস্থায় তার মাথা সোজা সামনের দিকে তাকায়। সে দেখে, হাসপাতালে নতুন-আনা ইসিজি মেশিনটা বীরবিক্রমে ধেয়ে আসছে তার দিকে। এতক্ষণে গর্জনের কারণ বুঝতে পারে সে। চকিতে পিছন ঘুরলে সে দেখে, তেড়ে আসছে এক্স-রে মেশিন। তার লক্ষ্যও সে। হঠাৎ মাথার উপর দলবদ্ধ ভীমরুলের ওড়বার শব্দে সে উপরে তাকালে, দেখে, একটা ওয়েট-মেশিন চক্কর কাটছে তার মাথার উপর। অর্থাৎ তার এই চলাচলের সবটুকু নজরবন্দির ঘেরাটোপেই হচ্ছিল, শুধু সে-ই এতক্ষণ বোঝেনি। এবার সেই ওয়েট-মেশিন থেকে একটি রক্তচাপ মাপার যন্ত্র এবং একটি স্টেথোস্কোপ নেমে আসে। ‘আর’ এবং ‘এক্স’-এর হাতে বসে যায় দেবায়ুধ দু’টি। পরমুহূর্তে দু’জন তার গলায় পেঁচিয়ে দেয় সেই আপাত সরল রবার-নল। তারপর দু’দিক থেকে টান, টান, আরও টান। শ্বাসনালীতে চাপ পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়; অন্তিম শ্বাসে দেখা যায়, তার চোখের মণি দু’টি পলকে দু’টি অ্যালজোলাম হয়ে গেছে। নিবিড় ঘুম। নদীতীর। পলিমাটি। সারি-সারি চিতাকাঠ। পাটকাঠি। মুখাগ্নি। ধূমকুণ্ডল। ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম।
|| চার ||
সেদিন ভোররাতে কুমুদের বুকে ব্যথা শুরু হলে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুরু থেকেই শশী চোখে-চোখে রেখেছিল। কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের ডক্টর অভিজিৎ ডলসওয়ার্দি প্রাথমিক ভাবে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, তিনটে আর্টারি প্রায় এইট্টি পারসেন্ট ব্লক। পরদিন সকালে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্ট করার কথা।
শশী একবার বাইপাস অপারেশনের কথা বলেছিল। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টের থেকে বাইপাসে খরচ তুলনায় অনেকটাই কম। অনেক চেষ্টা করেও সবক্ষেত্রে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা চালু করেনি উঠতে পারেনি সে। মতি-কুমুদের ঘরে ছোটো ছেলে, তার উপর কুমুদের কোনও রোজগার নেই, পুরো সংসারটাই চলে হাসপাতালের চাকরি থেকে মতি যা-সামান্য পায়, তাতে। মাঝেমধ্যে বাচ্চাটার জন্য শশী এটা-ওটা নিয়ে যায়; কখনও পাঠিয়ে দেয় কারও হাত দিয়ে।
শশী ভেবেছিল, কুমুদের চিকিৎসায় যা খরচখরচা হবে, তা হাসপাতালের ফান্ড থেকেই দিয়ে দেবে সে। কিন্তু সে-ফান্ডও এমন কিছু আহামরি নয়। সবদিক ভেবেই সে বাইপাসের কথা তুলেছিল। পত্রপাঠ তা নাকচ করে দেন ডলসওয়ার্দি : ‘শশীবাবু, ওনার যা কন্ডিশন, তাতে বাইপাস করা যাবে না। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টেও কিছুটা রিস্ক আছে ওঁর। ক্রিয়েটিনিন লেভেলটা, ওনার, একটু হাইয়ের দিকে। ওষুধ দিয়েছি। আশা করছি কাল ওয়ান পয়েন্ট এইটের নীচে লেভেল নেমে যাবে।’
তখন সূর্য উঠছিল। হাসপাতাল চত্বরের লাইটগুলো সব একে-একে নিভছিল। হাসপাতালের উপর এসে পড়ছিল জীবনদায়ী সূর্যালোক। গোটা গাওদিয়া গ্রাম জেগে উঠছিল বিলম্বিত লয়ে। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখছিল শশী। ভিতরটা মুচড়ে উঠছিল থেকে-থেকে। যখন সে সম্পূর্ণ নির্বান্ধব বলে ভাবতে শুরু করেছিল নিজেকে, তখনই মতিকে নিয়ে গাওদিয়ায় ফিরে এসেছিল কুমুদ, তার এতদিনকার বন্ধু। সদা চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল সেই কুমুদ এখন শুয়ে আছে হাসপাতালের আইসিসিইউ-তে। অনেকদিন পর দিনের এই কুমারী আলোয় কারও জন্য কষ্ট হয় শশীর। পায়ের শব্দে পিছন ঘুরে দেখে, পায়ে-পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে মতি। রাতারাতি মেয়েটার চোখের তলায় কালি। শশী তাকে পেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলে : ‘কুমুদ কি ইকোস্প্রিন বা ওই কম্পোজিশনের কোনও ওষুধ খেত?’
‘আপনি তো এতদিন ধরে দেখছেন আপনার বন্ধুকে, আমারও আগে থেকে! কখনও কি একটাও ওষুধ খেতে দেখেছেন? ও খাবে ওষুধ! তাহলেই হয়েছে!’
ডাক্তারি পড়ার দিনগুলো মনে পড়ে শশীর। সে মনে করার চেষ্টা করে, কুমদকে কি সে কখনওই দেখেনি ওষুধ খেতে? অনেক হাতড়েও কুমুদের ওষুধ খাওয়ার কোনও ছবিই মনে আসে না তার; আর এভাবেই সে নিশ্চিত হয়ে যায়, ডক্টর অভিজিৎ ডলসওয়ার্দি কিছু-একটা লুকোচ্ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আঙুলে আঁচলের খুঁট জড়াতে-জড়াতে মতি তখন বলে : ‘ছোটোবাবু, আপনার বন্ধু ঠিক হয়ে যাবে তো?’
‘ঠিক হবে না কেন? এই তো আর-খানিক পরেই অ্যাঞ্জিওপ্লাস্ট হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ যেমন তাকিয়েছিল শশী, মতির দিকে না-ফিরে সেভাবেই জবাব দেয় সে।
‘আসলে কী জানেন তো, কখনও তো কোনও নিয়ম মানেনি, নিজের খেয়ালখুশি মতো চলেছে, যা-ইচ্ছে-তাই করেছে ─ তাই বড়ো ভয় হয় ছোটোবাবু!’
‘ভয়ের কিছু নেই, মতি! আজই তো ডাক্তারবাবু অপারেশন করবেন! তবে হ্যাঁ, অপারেশনের পর ডাক্তারবাবু যেমন-যেমন বলবেন, সেই ইনস্ট্রাকশন মতো চলতে হবে। ব্যস্, তাহলেই হবে! ক্যান্টিন তো খুলে যাবার কথা! এক কাপ চা নিয়ে আসবি?’ শেষ কথাটা মতির দিকে ফিরে, বড়ো দাদার অধিকারবোধে বলে শশী।
মতি চা আনতে ক্যান্টিনের দিকে চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস পড়ে শশীর। আনমনে সে ভাবে, বাইপাস না-করে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্ট করার নেপথ্য কারণ। রক্ত চলাচলে সাহায্যকারী ওষুধ খায় না যে-রুগি, তার বাইপাস অপারেশনে কীই-বা সমস্যা থাকতে পারে! তখন তার সন্দেহ গিয়ে পড়ে ক্রিয়েটিনিন রিপোর্টের উপর। সে দ্রুত পায়ে ল্যাবে এসে পৌঁছায়। রুগিদের সব রিপোর্ট-হিস্ট্রি মজুত রাখা থাকে যে-কম্পিউটারে, সেটি চালু করে। অপটিক্যাল মাউস তার তিরচিহ্ন নিয়ে থেমে যায় কুমুদের নামের উপর। সিটি স্ক্যান, হল্টার, ব্লাড টেস্টের রিপোর্টে চটজলদি চোখ বুলিয়ে সে ক্রিয়েটিনিন টেস্টের রিপোর্ট খোলে। ওয়ান পয়েন্ট সিক্স! ক্রিয়েটিনিন লেভেল ওয়ান পয়েন্ট সিক্স!
শশী চমকে ওঠে। ক্রিয়েটিনিন লেভেল নর্মাল হওয়া সত্ত্বেও ডলসওয়ার্দি বাইপাসে রাজি না-হয়ে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্ট করবেন!
|| পাঁচ ||
কুমুদ ধীরে-ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। অপারেশনের পর কার্ডিওলজিস্টের কথায় হাসপাতালের নেফ্রোলজিস্টও তাকে পরীক্ষা করেছেন। দুটো স্টেইন্ট আর তিনটে বেলুন বসার কারণে কুমুদের দুটো কিডনিই বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নেফ্রোলজিস্ট সব দেখে-শুনে একটা ডায়েট চার্ট করে দিয়েছেন। শশী জানে, কুমুদ যদি খাওয়াদাওয়ায় সংযম না-আনে, ঠিকমতো ওষুধ না-খায়, তবে বড়ো সমস্যা দেখা দেবে। হার্ট তো বটেই, কিডনিও ফেল করতে পারে। সেক্ষেত্রে ডায়ালিসিস ছাড়া গতি থাকবে না।
গত ক’দিন কুমুদকে নিয়ে যা দৌড়ঝাঁপ গেছে শশীর, তাতে ওই ক’টা দিন ভালো ভাবে সূর্যাস্তটুকুও দেখা হয়নি তার। আজ অনেক দিন পর আবার আগের নিয়মে ফিরেছে সে। হাসপাতালের পিছনে সূর্যের ডুবে-যাওয়া দেখতে-দেখতে তার মন অনেক দিন পর আবারও স্ফূর্তি খুঁজে পাচ্ছিল। সূর্যাস্ত দেখার কী-এক পাগল নেশা তার!
সূর্য ডুবে গেলে চারপাশ মনখারাপ করে থাকে। রং হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে যায় সব। সূর্যাস্তের ঠিক পরেই একটা মনকেমন ঘিরে ধরে শশীকে। অন্যান্য দিন সে ওই বিমিশ্র অনুভূতির সঙ্গে বেশ অনেকটা সময় একলা কাটায়। অথচ আজ মনকেমন হতেই তার মনে পড়ে কুমুদের কথা। তখনই সে ঠিক করে, সে ডাক্তারদের কোয়ার্টারে যাবে। মেন গেট দিয়ে ঢুকেই ডানদিকের তিন নম্বর বাংলোটায় থাকেন ডক্টর অভিজিৎ ডলসওয়ার্দি। আজ সরাসরিই সে জানতে চাইবে, সব কিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও কী কারণে মিথ্যে বলতে হল ডলসওয়ার্দিকে? বাইপাস না-করে কেনই-বা তিনি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টের সিদ্ধান্ত নিলেন?
|| ছয় ||
কোয়ার্টারের মেন গেট থেকে ডলসওয়ার্দির বাংলোর একটা দিক স্পষ্ট দেখা যায়। গেট দিয়ে ঢুকতে-ঢুকতে শশী দেখে, নিচতলায় আলো জ্বলছে। নিচতলার জানলা খোলা, অর্থাৎ ঘরে এসি চলছে না। ভারি পর্দার ফাঁক গলে আলো এসে শার্সিতে পড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। গোটা বাড়িটাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক মায়াবী আস্তর। পায়ে-পায়ে শশী এগিয়ে আসে। যেদিক দিয়ে সে আসে, সেদিক থেকে দুটো বড়ো জানলা, ড্রয়িংরুমের, পার হয়ে আসতে হয় দরজার সামনে। প্রথম জানলা পার হয়ে দ্বিতীয় জানলার দিকে এগোতে যাওয়া মাত্র ভারি পর্দার ওপার থেকে হাসির দমক গমগমিয়ে তোলে বাংলো-লাগোয়া বাগানের গাছগুলিকে। শশী, কেন কে জানে, পর্দা খানিক সরায়।
পর্দা সরিয়ে ঘরের ভিতর তাকানো মাত্র সে দেখে, ডলসওয়ার্দির সঙ্গে নেফ্রোলজিস্ট রজনীশ পুত্তলীবাঈ এবং জেনারেল ফিজিশিয়ান মৃন্ময়ী দাশগুপ্ত হাসি-ঠাট্টা করছেন। রজনীশ এবং ডলসওয়ার্দির হাতে মদের গ্লাস, মৃন্ময়ীর হাত ফাঁকা। এরপর তার নজর পড়ে তাদের সামনে রাখা সেন্টার টেবিলে। ঈষৎ হলুদাভ পানীয়ের একটি গ্লাস। মৃন্ময়ী দাশগুপ্ত হাত বাড়িয়ে গ্লাসটিকে তুলে মুখের কাছে আনেন। তারপর আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে বলেন : ‘অভিজিৎ, আপনি শিওর ছিলেন যে আমাদের ডিরেক্টর স্যার ওই ক্রিয়েটিনিন রিপোর্টটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না?’
টেবিলে-রাখা প্লেট থেকে কাবাবের একটা টুকরো কাসুন্দিতে ডুবিয়ে মুখে পুরে অভিজিৎ বলেন : ‘আপনিও না মৃন্ময়ী! কোনওদিন দেখেছেন শশী দাস কোনও ডাক্তারের ব্যাপারে নাক গলিয়েছে! তবু একটা রিস্ক ছিলই! আফটার অল্, এই পার্টিটা তো আবার ওই রিসেপশনিস্টটার হাজব্যান্ড! কিন্তু আমি একবার বললাম আর শশী দাস কেমন মেনে নিল, দেখলে ─ !’
মাথার উপর দুটো ফ্যান। ঘুরছে। ফাঁকা গ্লাসটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ান রজনীশ। এগিয়ে আসেন জানলার কাছে। ফ্যানের হাওয়া এদিকে সেভাবে পৌঁছায় না। দেশলাই দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ফিরে যান নিজের জায়গায়। নিভে-যাওয়া দেশলাইকাঠিটা অ্যাশট্রেতে ফেলে তিনি বলেন : ‘তবে আপনি যদি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্ট না-করতেন, তবে তো শালার কিডনি বিগড়োবার কোনও চান্সই ছিল না! মালটার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্ট হল, কিডনিতে প্রেশার পড়ল, ব্যস্, আমার রিপ্রেজেন্টেটিভরাও খুশ্!’
দেওয়াল-আলমারি থেকে বোতল বের করে নিজের এবং রজনীশের গ্লাস দুটো ভরে নিয়ে এলেন ডলসওয়ার্দি। রজনীশের গ্লাসটা রজনীশের হাতে দিয়ে নিজের গ্লাসটা নিয়ে বেতের চেয়ারটায় বসলেন তিনি। গোলানোর ভঙ্গিতে গ্লাস-ধরা হাতখানা কয়েকবার নাড়িয়ে একটা চুমুক দিলেন। তারপর চেয়ারের হাতলে-রাখা ছোটো তোয়ালেটায় মুখ মুছে নিজের বাঁহাত তুলে ধরেন তাদের সামনে। হাতে একটা রূপোলি চেনের ঘড়ি। সেটা দেখিয়ে বলেন : ‘ওই স্টেইন্ট নেওয়ার জন্য এটা পেয়েছি, বুঝলেন! অরিজিনাল জিওর্দানো! আপনাদেরটা রাখা আছে। যাবার সময় নিয়ে যাবেন। বাই দ্য বাই, মৃন্ময়ী, কতদিন হয়ে গেল আপনি আমাদের কোনও গিফট দিচ্ছেন না! কোম্পানিগুলো কি আপনাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে?’
‘তা নয় ডক্টর ডলসওয়ার্দি! অ্যাকচুয়ালি প্রাইভেটে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে এত খরচা হয়ে গেছে যে এখন মেডিসিন কোম্পানিগুলোর থেকে আর গিফট নিচ্ছি না, কমিশন নিচ্ছি! একটু গুছিয়ে-টুছিয়ে নিই, তারপর তো রইলামই!’
‘সেই! তবে এই হসপিটালটাকে ধরে রাখতে হবে। এখানে শশী দাসের যা ইমেজ, পুলিশ-টুলিশ খুব-একটা বাওয়াল করে না! এটাই আইডিয়াল! আসুন, চিয়ার্স!’
‘চিয়ার্স!’
জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে-থাকা শশীর মাথা ঝিমঝিম করে। পায়ে খোঁচা লাগে। সে নিচের দিকে তাকালে দেখে, একটি গোলাপচারা। তার চোখে ভাসে বহুদিন আগে গোলাপচারা মাড়িয়ে-দেওয়া মেয়েটির মুখ। ঘরের ভিতর তখন দম-দেওয়া পুতুলের যান্ত্রিক নাচ। নতুন পুতুলনাচ।