মুরুগান দেখছিল বিদ্যাকে। কী যেন ভাবনায় ডুবে আছে আজ ও। অথচ সত্যি বলতে কী, এখন তাদের জীবনে টেনশনের কিছু নেই আর। দুশ্চিন্তা বা অশান্তি—কোনটারই সম্ভাবনা নেই। তাহলে কী এত ভাবছে বিদ্যা? ওর নিজের নাহয় এতাল বেতাল ভাবা স্বভাব, কিন্তু বিদ্যাকে এত আনমনা খুব কম দেখেছে ও। মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করেই ফেলল আর থাকতে না পেরে। ‘কী রে? কী এত ভাবছিস আজ? এত চুপচাপ যে? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?’ বিদ্যা চমকে তাকাল, ওর ম্লান মুখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভাব। স্মিত হেসে, একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল, ‘তেমন কিছু না। বয়স হচ্ছে তো। তায় এখন কাজ নেই। বসে বসে পুরনো কথার জাবর কাটছি আর কী!’ ‘ও, তাই বল! আমি ভাবলাম, না জানি কী হল আবার তোর’। মুরুগান কাঠের পা’টা পরে ঘরের বাইরে গেল, বারান্দায় দাঁড়াল কিছুক্ষণ। বৃষ্টি এবার একঘেয়ে লাগছে কিছুটা। কোনকিছুই একটানা সহ্য করা তার স্বভাবে নেই। কিছুটা অসহায় মুখে ফিরে এলো আবার ঘরে। অস্থির লাগছে ওর। মুরুগানের হাল দেখে বিদ্যা বলল, ‘কী আর করবে? বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত বাইরে গিয়ে শুধুশুধু ভিজে জ্বরজারি বাঁধানো ছাড়া কিছুই লাভ নেই। তারচেয়ে ঘুমিয়ে নাও কিছুক্ষণ। নয়ত সিনেমা দেখ বসে বসে’। বিদ্যার এই কথাটা মনে ধরল মুরুগানের। খুঁজে খুঁজে দু’তিনটে পুরনো ফিল্ম বের করল। বিদ্যা কাজে লাগল গা ঝারা দিয়ে।
সিনেমার দিকে চোখ রেখেছে মুরুগান। কিন্তু বারেবারে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতাল থেকে এক পা নিয়ে ফিরেছিল মুরুগান। শরীরে ধকল গেছিল খুব, তাছাড়া অনেক রক্তপাতের ফলে খুবই দুর্বল ছিল। এই সব ছাপিয়ে পা হারানোর শোক আর হতাশা মুরুগানকে প্রায় মেরে ফেলেছিল। বাড়ি এসে বিছানায় শুয়েছিল তিনমাস। অ্যাম্পুট করার পর ছ’মাস খুব সতর্ক থাকতে বলেছিল ডাক্তার। যে কোন মুহূর্তে ইনফেকশনের ভয় থাকে নাকি। তাই একমাত্র বিদ্যা ছাড়া তার ঘরে আর কেউ আসত না। একেক সময়ে ওর আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হত। একটা দুর্দান্ত, ছটফটে মানুষ, যে কিনা সারা জঙ্গল চষে বেড়ায় একা একা, সে এখন খোঁড়া হয়ে কী করে জীবন কাটাবে, এই ভাবনা মুরুগানকে কুড়ে কুড়ে খেত তখন। চারদিকের অন্ধকার তাকে তখন গিলে খাচ্ছে। কাটা জায়গার যন্ত্রণা, শরীরের দুর্বলতা, তীব্র অবসাদ, সব মিলিয়ে সেই তেজি, টগবগে মুরুগানকে প্রায় বৃদ্ধ করে তুলেছিল। একমাত্র সঙ্গী তখন বিদ্যা। নিঃশব্দে সে যেমন সেবা করে যেত, তেমনি খানিক অবসর পেলে, মুরুগানের কাছে বসে গল্পগাছা করত, ওর মনের জোর বাড়ানোর জন্য নানারকম ভাবে উৎসাহ দিত। কিন্তু সেগুলোর কোনটাই কোনরকম ভাবে যে কাজে লাগছে না, সেও বুঝত বিদ্যা। ওর মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিত। প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল বিদ্যা। গুমরে গুমরে নিজের মনের মধ্যে তারও অকালমৃত্যু ঘটছিল নিঃশব্দে। কুগানও দিশেহারা তখন। তার মদ খাওয়া বেড়ে গেছিল ওইসময়ে আরও। এইভাবে কেটে গেল অন্ধকারাচ্ছন্ন ছ’টা মাস। ছ’মাস তো নয়, যেন ছয় জীবন কাটিয়ে ফেলেছিল মুরুগান। ক্রাচে ভর দিয়ে চলত ঘরের মধ্যে। একদিন ক্রাচ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল বিদ্যার অনুপস্থিতিতে। বিদ্যা সম্ভবত তখন স্নানে গেছিল। বাগানে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ও। যতটা না শরীরের যন্ত্রণায়, তারও বেশি মনের আঘাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল মুরুগান। হিঁচড়ে হিঁচড়ে শরীরটাকে ক্রাচের কাছে নিয়ে গিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল ক্রাচটাকে। ‘লাগবে না, আমার এই ক্রাচ লাগবে না। আমি মাটিতে হিঁচড়ে হিঁচড়েই চলব। মুরুগান মরে গেছে আজ থেকে। চুলোয় যাক কফি খেত, চুলোয় যাক মুরুগান…’। তার সেই জান্তব চিৎকারে কোনরকমে স্নানঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল বিদ্যা। মুরুগানকে ওই অবস্থায় দেখে নিজেকেও সামলাতে পারেনি বিদ্যা। ওকে দুহাতে জড়িয়ে কেঁদে উঠেছিল সেও হুহু করে। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। খোলা আকাশের নিচে দুইজন বয়স্ক মানুষ একে অপরকে ধরে ছেলেমানুষের মতো কাঁদছে—এই দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছিল সেদিন কয়েকজন কাজের লোক আর আকাশ, বাতাস, সূর্য।
পুলিশ কেস হয়েছিল আগেই। হাসপাতালেই ওরা মুরুগানের থেকে বয়ান নিয়েছিল। শ্রীনির নাম, ঠিকানা সবই জানিয়ে দিয়েছিল মুরুগান ওদের। শ্রীনির বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী আইন, খুনের চেষ্টা আর বনসংরক্ষণ আইনের বেশ কয়েক গুচ্ছ ধারায় মামলা করেছিল পুলিশ। শ্রীনির জামিন হয়নি। কেস চলেছিল তিনমাস মাত্র। যাবজ্জীবন জেল ও বেশ কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে শ্রীনিকে দিতে হয়েছিল। রায় শুনে মুরুগানের শান্তি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পা হারানোর জন্য পুরনো বন্ধুকে ও কখনই মন থেকে ক্ষমা করতে পারেনি। মুরুগান জানত, শ্রীনির সাজা শেষ হয়ে গেলেও, পুলিশ ওকে শান্তি দেবে না। বন্যপ্রাণী আইনের আওতায় কেউ পড়লে, অপরাধী এবং তার পুরো পরিবারকেই সারা জীবন তটস্থ থাকতে হয়। অপরাধী মরে গেলেও তার উত্তরসূরিদের পুলিশের কাছে নিয়মিত হাজিরা দিতে হয়। মুরুগানের ক্ষতে এই সব শুনেও প্রলেপ পড়েনি তেমন। এই এখনও সিনেমা দেখার নামে নিজের সঙ্গে ও লড়াই করছে। নিজের অসহায় ক্রোধকে বাগে এনে কব্জা করে ওই ক্রাচের ভেতরে এনে ফেলতে পারলেই যেন তার শান্তি হবে! বিদ্যা কখন যে টিভির মনিটর বন্ধ করে দিয়েছে, ও টেরই পায়নি, এতটাই আনমনা ছিল। খেয়াল হল, খুট করে শব্দে। চলে যাচ্ছিল বিদ্যা, ওকে ডাকল ও। ‘বস্ একটু আমার কাছে। সারাদিন কী এত কাজ করিস শুনি? তোকে বারণ করেছি না! এত কাজ করার দরকার নেই তোর! আমার পয়সাগুলো কে খাবে? নাহয় দুটো কাজের লোকই কিছু খেত। তোরও তো বয়স বাড়ছে। এবার একটু রেস্ট-এ থাক। সারাজীবন অনেক খেটেছিস। এবার একটু আরাম কর’। বিদ্যা বসল খাটের এক কোণায়। কাজের ব্যাপারে মুখে কিছু বলল না অবশ্য। মুরুগানও জানে, হাজার বার বললেও বিদ্যা শুনবে না। সব কাজ ওর নিজের হাতে না করলে শান্তি নেই। যাক, যার যাতে শান্তি, তাই করুক।