প্রবন্ধে মৃদুল শ্রীমানী

গভীর রাতে তোমার অভিসার, পরাণসখা
১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারির গভীর রাতে একটা বাদামি রঙের লম্বা ঝুল কোট গায়ে, পায়জামা পরে, ফেজ টুপি মাথায়, নিজেদের এলগিন রডের বাসভবন থেকে অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। বেরোতে বেরোতে রাত দেড়টা প্রায়। একটা গাড়ি ছিল। সেই গাড়িতেই চাপলেন। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর বি এল এ ৭১৬৯ ।
১৯৩৭ সালে তাঁর দাদা কংগ্রেস নেতা শরৎ বসুর কেনা। সেডান গোত্রের গাড়িটি জার্মানিতে তৈরি । গাড়ি চালালেন তাঁর ভাইপো শিশির কুমার বসু। আজ সেই গাড়িটি কলকাতার এলগিন রোডের বসু বাড়িতে প্রদর্শিত রয়েছে।
গাড়ি করে গেলেন গোমো স্টেশনে । তারপর ট্রেনে করে পেশোয়ার। দেশ তো তখন ভাগ হয় নি। ট্রেনে করে পেশোয়ার যাওয়া যেত।
পেশোয়ারে আলাপ হল ভগতরাম তলোয়ারের সাথে। তলোয়ার বুদ্ধি দিলেন বোবা কালা সাজতে। আর গজালেন বড়সড় দাড়ি । কে আর জানত তলোয়ার ছিলেন রাশিয়ার চর !
কার কথা বলছি?
সুভাষচন্দ্র বসুর মহানিষ্ক্রমণের দিন উপলক্ষে আজ আমার রবীন্দ্রনাথের “তাসের দেশ’ নাটকটি খুব মনে পড়ছে। তাসের দেশ তিনি উৎসর্গ করেছিলেন জাতীয় বীর সুভাষচন্দ্র বসুকে। এই নাটকের বিষয়বস্তুতে ইচ্ছাশক্তির উদ্বোধনের কথা রয়েছে। স্বাধীনতা অর্জন করতে গেলে মর্যাদাবোধ অর্জন করা চাই আগে। নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার স্পর্ধা, ব্যক্তিত্বের বিকাশ সেই মর্যাদাবোধ এর অঙ্গ। বয়সে সুভাষ রবীন্দ্রনাথের থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের ছোটো। তাই সুভাষ বয়সে কবির পুত্রতুল্য বললে অসংগত হবে না। সুভাষের সব কাজ যে তিনি সর্বদা সমর্থন করেছেন, তা কিন্তু নয়। তবে সুভাষের প্রবল চারিত্রিক দৃঢ়তা, আর প্রগাঢ় অগ্নিসম্ভব দেশপ্রেমকে কবি মনে মনে অকুণ্ঠ সমর্থন করতেন। কালান্তরে তিনি সুভাষকে “দেশনায়ক” বলে সম্ভাষণ করেছেন। যে কবি “নায়কিয়ানা” বরদাস্ত করতেন না, তিনি যাঁকে দেশনায়ক আখ্যা দেন, তখন বুঝে নিতে হয়, কতদূর সদর্থক ও গঠনমূলক প্রভাব সুভাষ অন্তরে বহন করতেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজের পুত্রতুল্য এই দেশনেতাকে তাঁর স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুভাষের পক্ষে সেখানে আটকে যাওয়া সম্ভব ছিল না। নিজের ভিতরে আসমুদ্র হিমাচল কাঁপানো একটা শক্তি ও স্পর্ধার অস্তিত্ব সুভাষ জানতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই আত্মসচেতনতাকে সম্মান জানিয়েই তাঁকে ‘তাসের দেশ’ উৎসর্গ করেন। প্রাণের ধাক্কায় দেশের যৌবনকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন সুভাষ। সুভাষকে ‘তাসের দেশ’ উৎসর্গ তারই স্বীকৃতি।