বণিকসভ্যতার সমুদ্রমন্থনে সঞ্জাত যে হলাহল, তার ছোঁবল থেকে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ইন্ডিয়া তথা ভারত এবং আবহমান ভারতভূমিও মুক্ত নয়। আমাদের দেশের দারিদ্র্য, অশিক্ষা আর জনবিস্ফোরণ এই সংকটকে গভীরতর করেছে। পরিবর্তিত মূল্যবোধ, এমনকী মূল্যবোধহীনতা, তলানিতে ঠেকে যাওয়া নৈতিকতা, বিজ্ঞানপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে তার প্রয়োগ আজ দুনিয়া জুড়েই মানুষকে স্নেহ-সম্প্রীতি -দয়া-ভক্তির জগৎ থেকে বিচ্যুত করে চূড়ান্ত ভোগবাদী জীবনে ঠেলে দিয়েছে। মানুষে মানুষে সম্পর্কের অবমূল্যায়ন ঘটে গেছে। সেখানেও আসছে পণ্যায়ন। কারুর কাছে পাওনা বলতে আজ আর স্নেহপ্রেমদয়াভক্তির কোমলতা নয়, টাকা-আনা-পাইয়ের নগদানগদি। জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে দণ্ডে দণ্ডে ক্ষয়।
মানুষকে আমরা যতই মানবিক ভাবি, ধর্ষণ ব্যাপারটা কিন্তু পশুসমাজে নেই। অনতি-অতীতে বেশ কিছু বলাৎকারের ঘটনা আমাদের কাঁপিয়ে দিয়েছে।
ডিসেম্বর, ২০১২ র রাতে ঘটে কুখ্যাত নির্ভয়া কেস। রাজধানী দিল্লির চলন্ত খালি বাসে ২৩ বছরের এক মেয়ে পৈশাচিকভাবে গ্যাং রেপড ও খুন হয়। ওই বাসের কর্মীদের দ্বারা। সারা ভারত প্রতিবাদে আলোড়িত হয় এ ঘটনায়।
২০০৮ জানুয়ারিতে জম্মুর কাঠুয়ায় আট বছরের কচি মেয়ে সরিফাকে আটকে রেখে শারীরিক অত্যাচারের পরে খুন করে বনের ধারে ফেলে আসা হয়। ভাজপা-র দুজন মন্ত্রীও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলে। দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।বেশির ভাগ অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
২০১৫-য় রানাঘাট সাক্ষী হয় ৭১ বছর বয়স্ক এক নানের গ্যাং রেপের। এই নারকীয় ঘটনায় স্তম্ভিত গোটা রাজ্য।
২০১৯-এ উত্তরপ্রদেশের উন্নাও। রাজ্যের ভাজপা এমএলএ কুলদীপ সিং সেঙ্গার একটি মেয়েকে রেপ করে। নালিশ নথিবদ্ধ হওয়ার পর কুলদীপ, তার ভাই, পুলিশ মিলে মেয়েটির বাবার ঘাড়ে দোষ চাপায়। মেয়েটির বাবা গ্রেফতার হন এবং পুলিশ কাস্টডিতে প্রহারে মারা যান। মেয়েটি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তারপর মেয়েটিকে ট্রাকের নীচে পিষে ফেলার চেষ্টা হয়। তার দুই আত্মীয়া মারা যান, সে নিজে গুরুতর আহত হয়। আদালতের পথে বারবার তাকে খুন করবার চেষ্টা চলে।
কদিন আগে ঘটে গেছে ভয়ংকরতম আর এক ঘটনা। হায়দরাবাদের পশুচিকিৎসক প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি স্কুটারে বাড়ি ফিরছিলেন। একটি ট্রাকের কিছু খালাসি ও ড্রাইভার টোল প্লাজায় মদ খেতে খেতে স্কুটারের চাকার হাওয়া খুলে তাঁর ফেরার অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকে।নিজের শ্রেণির চেয়ে ওপরের শ্রেণির এক নারীর শরীরের দখলদারি পেতে থাকা এই নরপশুদের দ্বারা গণধর্ষিত ও খুন হন প্রিয়াঙ্কা । পুলিশ এনকাউন্টারে দুষ্কৃতীদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চাপানউতোর আজও জারি।
মেয়েদের পক্ষে এ দেশ আফগানিস্তান, সিরিয়া বা সৌদি আরবের মতো বিপজ্জনক হতে বাকি নেই। এ বছরের শেষ নাগাদ ১২৭৮০০ কেস বিচারাধীন। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট করেও এ সংখ্যাটি কমানো যায়নি।
দেশজুড়ে মেয়েদের এই অবমাননা আদতে সামাজিক, রাজনৈতিক, বিচারবিভাগীয়, প্রশাসনিক ব্যর্থতারই নজির। অর্থনীতির বিপন্নতার প্রসঙ্গও এর সঙ্গে জড়িত। মেয়েরা কাজে যোগ দিলে জাতীয় আয় বাড়ে, অথচ কাজের জায়গায় মেয়েদের সুরক্ষা সংকটে। কিমাশ্চর্যমতঃপরম, নিগৃহীত মেয়েটিকেই আবার সমাজ দোষারোপ করে।
বিশ্বজুড়ে মন্দার মতো পরিস্থিতি ভারতের অর্থনীতিতেও ছাপ ফেলেছে। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। পেঁয়াজের কেজি একশো ছাড়াল। ব্যাংকগুলোয় পাহাড়প্রমাণ অনাদায়ী ঋণের বোঝা। লাভজনক সরকারি সংস্থাগুলোকেও বেচে দেওয়ার আত্মঘাতী প্রবণতা শুধু দেশের অর্থনীতি নয়, আভ্যন্তরীণ সুরক্ষাকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করতে চলেছে।
মানুষের নৈমিত্তিক সংসার খরচের রসদ আর পারিবারিক আর্থিক নিশ্চয়তা জোগাতে লবেজান। অথচ গরিব মানুষের হাতে টাকা না এলে বাজারের চাকা ঘোরবার নয়।
বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। প্রাণদায়ী বায়ুই নিঃশব্দে শ্বাসরোধী হয়ে উঠছে আজ। ভারতে প্রতি তিন মিনিটে একটি শিশুমৃত্যু এই দূষণের ফল। আমরা বাতাসের বিশুদ্ধতা ধ্বংস করেছি আমাদের আগ্রাসনে। অস্থিতিশীল এই উন্নয়ন বস্তুত বর্তমানকে দয়া দেখাতে গিয়ে ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি। আগে মানুষের ধারণা ছিল, প্রকৃতিকে জয় করতে হবে, বন্দি এবং পদানত করতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই যে উন্নয়ন ঘটাতে হবে, বিশ্বজুড়ে এ ধারণা গড়ে উঠতে থাকে মাত্রই গত শতকের সাতের দশকের পর থেকে।
জলের আর এক নাম জীবন। দেখতে দেখতে চোখের সামনে সেই জলও নীল সোনা হয়ে উঠছে। একদিকে অপচয়, অন্যদিকে দূষণ এই সুজলা দেশকেও মরুভূমি করতে চলেছে। নগরায়নের প্রয়োজনে নির্বিচারে গাছকাটা, নদীর পাশের পললসমৃদ্ধ মাটি পুড়িয়ে ইঁটভাঁটা গড়া এবং নদী থেকে বেআইনিভাবে বালু তুলে বন্যার প্রকোপ বাড়ানো এসব মানুষেরই অপকীর্তি।
ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে একটু মানবিক মুখ, গভীরভাবে চিন্তা, টিভি সিরিয়াল আর ব্রেকিং নিউজ ছেড়ে খানিকটা পড়াশোনা, স্রোতের বিরুদ্ধে ভাবনার হিম্মৎ কি আমরা এখনো দেখাব না?
ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আমরা তাহলে কিন্তু উপলব্ধি করতে পারব সেই স্বদেশস্বপ্নকে, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির / জ্ঞান যেথা মুক্ত..