“শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম।
মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু,ঠাকুর হলেন রাধে-শ্যাম”…
বয়স আমার তখন পাঁচ হবে,আমার মাসিমণির গলায় প্রথম শুনি গানটা।শ্যামাপুজো ছিল সেদিন!তখন “কাঠবেড়ালি,কাঠবেড়ালি পেয়ারা তুমি খাও” বা “ভোর হল দোর খোলো,খুকুমণি ওঠো রে”, দিয়ে নজরুলকে জানার হাতেখড়ি হয়ে গেছে আমার।কারোও কাছে মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম,হিন্দু মুসলমান ও শুনে ফেলেছি বোধহয়। তাই আমার দাদু যে বলেন,নজরুলের কবিতা শুয়ে শুয়ে পড়া যায় না অলসভাবে,শিরদাঁড়া সোজা রেখে পড়তে হয়…এটাও বেশ রপ্ত করে ফেলেছি।এমন একটু আধটু পরিচয় আমার আর বিদ্রোহী কবির,তখন শুনি এই গান।শোনার সময় দাদু আমার কানে কানে বলেছিলেন,”এই গানটা কে লিখেছেন জানিস?কাজী নজরুল ইসলাম!”সেই প্রথম অবাক হওয়া…কাজী নজরুল ইসলাম,সেই চুরুলিয়া গ্রামে জন্মানো ছেলেটা!সে তো আমাদের মতো হিন্দু নয়,তাও কালীপুজো করতো নাকি?
তারপর থেকে বহুভাবে তাঁকে জেনেছি,বহুরূপে।
কতদিন বিরহ ক্লান্ত বিকেলে মনে মনে গেয়েছি…” আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন,খুঁজি তারে আমি আপনায়” আবার কতবার মনে মনে জেদের বশে বলেছি,”আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত…আমি সেইদিন হব শান্ত”…
তবে নজরুল আর তাঁর শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল বিস্তর।পরে ‘আমার কৈফিয়ত’ এ যখন পড়ি,” মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্লারা’ কন হাত নেড়ে/দেব-দেবী নাম মুখে আনে,সবে দাও পাজিটার জাত মেরে”…তখন বুঝি কত বিরোধ সইতে হয়েছিল তাঁকে,এই কালীপ্রেমের জন্যই কাফের অাখ্যা পেয়েছিলেন তিনি।একসময় পূর্ববঙ্গের রেডিওতে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত সম্প্রসারণ নিষিদ্ধ ছিল।
নজরুলের রচিত এবং সুরারোপিত প্রায় ৩০০০ গানের মধ্যে বহু ছিল শ্যামাসঙ্গীত।১৯৬৬ সালে তাঁর ১০০টি শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে প্রকাশিত হয় রাঙাজবা।
ধূমকেতুতে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক কবিতায় তিনি লিখেছেন,” আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।/দেব-শিশুদের মারছে চাবুক,বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,আসবি কখন সর্বনাশী?”এই কবিতার জন্য তাঁর সশ্রম কারাদন্ড হয়।
নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতে ভক্তিরসের আবেগ আছে,বাংলার শ্যামাসঙ্গীত ঘরানায় তাঁর অগ্রজদের লেখনীর মতোই।তিনি যখন স্নেহভরে লেখেন,”আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে,তারে কে দিয়েছে গালি?”-তখন সেই শ্যামা রামপ্রসাদের মেয়ের মতোই,যে তাঁর সাথে বেড়া বাঁধে।
আবার,”কেন আমায় দেখাস মা ভয়,খড়্গ হাতে মুন্ড নিয়ে/আমি কী তোর সেই সন্তান,ভোলাবি মা ভয় দেখিয়ে?”এখানে কালী মাতৃস্বরূপিনী,আর তিনি তার অবাধ্য,বিদ্রোহী ছেলে নজরুল।
কিন্তু নজরুলের শাক্তসঙ্গীত রামপ্রসাদ,কমলাকান্তের অহৈতুকী ভক্তিরসের ঘরানার নয় শুধু।বারবার তাঁর শ্যামাসঙ্গীত ভক্তিবাদের বেড়া ডিঙিয়ে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে।
নজরুল লিখেছেন-“সিন্ধুতে মা’র বিন্দুখানিক ঠিকরে পড়ে রূপের মাণিক/বিশ্বমায়ের রূপ ধরে না মা আমার তাই দিগবসনা।”নজরুলের কালীতে মিশে আছে দেশমাতৃকাকে শক্তিরূপে আরাধনার মন্ত্র।বস্তুত স্বদেশীয়ানাকে হাতিয়ার করে বঙ্কিমের আনন্দমঠের ‘মা যা হইয়াছেন’ -এর কালীকে আমরা বারবার পাই নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতে।
তিনি যখন লেখেন-“আজই না হয় কালই তোরে কালী কালী বলবে লোকে/(তুই) কালি দিয়ে লিখলি হিসাব কেতাব,পুঁথি,শিখলি পড়া/তোর মাঠে ফসল ফুল ফোটালো কালো মেঘের কালি ঝরা/তোর চোখে জ্বলে কালির কালো,তাই জগতে দেখিস আলো/(কালী)প্রসাদ গুণে সেই আলো,তুই হৃদ-পদ্মে দেখবি কবে?”এই গানে কালী আর দেশপ্রেম সমার্থক।এখানে যমক অলংকারেরও অসাধারণ ব্যবহার দেখি আমরা,কালি আর কালী শব্দদ্বয়ের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে।
নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতে আমি বারবার ভগিনী নিবেদিতার Kali,The Mother কে খুঁজে পাই।স্বামী বিবেকানন্দের যে মৃত্যুরূপা মাতা,’অনন্ত জীবনের প্রতীক’,তিনিই নজরুলের ভাষায়,”সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়/মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে/কাল নৃত্য করে উপভোগ/মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।”
যে কবি কবীরের মতো রাম-রহিমের বিভেদ ঘুচিয়েছেন অনায়াসে,শক্তি আরধনায় বৈষ্ণব প্রেমরসও মেলাবেন তিনি মেলাবেন!তাই শ্মশানকালীর বর্ণনায় তিনি বলেন,”মা যে আমার শবের মাঝে শিব জাগায়”…আবার আমার প্রথম শোনা তাঁর শ্যামাসঙ্গীতে তিনি বলেন,”শ্যামামায়ের কোলে চড়ে,জপি আমি শ্যামের নাম”…