• Uncategorized
  • 0

স্মৃতিচারণে ঋতুপর্ণ ঘোষ – লিখেছেন সঞ্জীবন হাটী

ঋতুবিয়োগের সাতবছর

‘সেই জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, হোঁচট খেতে খেতে হলেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় তার’। নিজস্ব সিগনেচার স্টাইলে নিতান্ত আন-অ্যাপোলোজেটিক ভাবে কথাগুলো বলে যাচ্ছে ঋতুপর্ণ। বাইরের আকাশে তখন শেষ বর্ষার মেঘ। বারোতলার ফ্ল্যাটের জানলার কাঁচে এসে টোকা মারছে জলভরা বাস্প। আমাদের পরিচিত জগতে থাকলে এবছর ওর বয়স হতো সাতান্ন। আজ ৩০ শে মে। ঋতুপর্ণর মৃত্যুদিন।সারাদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায়, টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আবারও ফিরে দেখা হবে ওকে। একলা বসে ভাবলে মনে হয় ঋতুপর্ণ তো ছেড়ে চলে গেলো, কিন্তু আমরা ওকে ছেড়ে থাকতে পারলাম কই?
তখন ওর বয়স কম। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল। সদ্য বানানো ‘হীরের আংটি’। কিন্তু ছবিটা মুক্তি পেলোনা। হাল ছেড়ে দিয়ে অ্যাড এজেন্সিতেই মুখ গুঁজে পড়ে থাকেনি সাউথ পয়েন্ট, যাদবপুরে অর্থনীতি পড়া সাধারণ ছেলেটা। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তৈরী হলো ‘উনিশে এপ্রিল’। টিমটিম করে লম্ফ জ্বলতে থাকা বাংলা ছবির থিয়েটারে নতুন করে ভিড় জমালো শহুরে শিক্ষিত মানুষরা। সেই তো শুরু! আস্তে আস্তে জাতীয় পুরস্কার আনতে দিল্লী যাওয়াটা ঋতুপর্ণর একটা বার্ষিক কর্মসূচী হয়ে পড়লো। বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বর্যা রাই থেকে অমিতাভ বচ্চন, প্রীতি জিন্টা থেকে বিপাশা বসু – বলিউডের তাবড় তাবড় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এসে অভিনয় করলো বাংলা ছবিতে। স্টারডম, ফ্যাশন, গ্ল্যামারের সাথে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক স্থাপন করে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে আক্ষরিক অর্থেই তারকা হয়ে উঠেছিলো সেই গোলফ্রেমের চশমা পড়া, কোঁকড়া চুলের ছেলেটা।
কেরিয়ারের প্রথমার্ধে প্রচুর পুরস্কার জয়ের পরও ওকে খুব একটা আদর দেয়নি আমাদের বিনোদন জগত। ‘অন্তরমহল’ ছবির মুক্তির সময় ‘ঋতুপর্ণ’র থেকে ‘পর্নগ্রাফি’ শব্দটার ডেরিভেশন করা হয়েছিলো। দিনের পর দিন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে, অ্যাওয়ার্ড সেরিমনিতে ওর নারীসুলভ আচরণকে নিয়ে ঠাট্টা করা হয়েছে। অডিটোরিয়াম ভরতি দর্শকাসনে বসে থেকেছে স্বনামধন্য অনেক শিল্পী, লেখক। কেউ নিঃশব্দেও এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলো কিনা আমার জানা নেই। আর এই অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্যই যেন ঋতু’কে আরও বেশী করে নিকড়ে নিচ্ছিলো ওর সিনেমার মধ্যে। একের পর এক তৈরী হচ্ছিলো ‘চোখের বালি’, ‘দোসর’, ‘দ্য লাস্ট লিয়র’, ‘রেনকোট’। পড়তে থাকা বাংলা ছবিকে সাহিত্য, শিল্পে আপাদমস্তক মুড়ে সাড়া বিশ্বের সামনে এনে উপস্থাপন করছিলো ঋতুপর্ণ। তখন ও শুধুমাত্র টালিগঞ্জ-র একটা চেনা মুখ নয়, সাড়া পৃথিবীর ছবিপ্রেমীদের সামনে ভারতীয় সিনেমার প্রতিনিধি।
নিজের ছবিতে বারবার সম্পর্কের জটিলতা, একাকীত্ব, গল্পের বই, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এসেছিলো ঋতু। আসলে এসবই ছিলো ওর নিজের জীবনের অংশ, দর্শন। ঋতু কি ভালো ছিলো? মনে মনে? সেকথা আমি বলতে পারবো না। তবে ‘ফার্স্ট পার্সন’ পড়তে গিয়ে বারবার চোখে জল এসে যায়। মন খারাপ হয়। যে মানুষটা এতো জটিল বিষয় নিয়ে ছবি বানায়, তার নিজের আত্মকথন এতো সোজাসাপ্টা হয় কী করে? বারবার মনে হয় ওরও খুব মন খারাপ হতো। মা-বাবা’র জন্য, ঠাকুমা‘র জন্য, ওর ফেলে আসা ছোটবেলার জন্য। ভাইয়ের বিয়ে করে আলাদা সেটল হওয়াতেও কষ্ট পেয়েছিলো ঋতু। মনে মনে ওর নিজের শৈশবের বাড়িটাকে খুব মিস করতো ঋতুপর্ণ। একবার কোনো এক ইন্টারভিউতে ওকে সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলো, ওর করা ছবিগুলোর মধ্যে কোন চরিত্র্যের সাথে ও সব থেকে বেশী রিলেট করতে পারে? ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’র অভিরূপ বা ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’র অর্ণব করার পরও ঋতুর উত্তর ছিলো ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী। কারন কামুক মহেন্দ্রও সংসার পেলো। কিন্তু বিনোদিনী পেলোনা’। ‘ফার্স্ট পার্সন’র সেই মানুষটা ছবি আঁকতে ভালোবাসে। লিখতে ভালোবাসে। জামাকাপড়, ঘর সাজানোর জিনিস ঘাঁটতে ভালোবাসে। আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া সিনেবোদ্ধার ছিটেফোঁটাও নেই সেই মানুষটার মধ্যে। এটাই হয়তো ঋতুপর্ণ, যার লেখা ডাইরিটা একটা বাচ্ছা ছেলের মতন সোজা আর বানানো সিনেমাগুলো পড়াশোনা করার মতন ভারী।
যত সময় এগোচ্ছিলো, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো ঋতুপর্ণর। সমকামীতা, ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে আমাদের সমাজের ভন্ডামি যেন আর নেওয়া যাচ্ছিলোনা। তখন সেই ছেলেটার কোঁকড়া চুল নেই, গোল ফ্রেমের চশমা নেই। তখন তার চোখে কাজল, গলায় হার। ‘বেশ করেছি গয়না পরেছি’ – আত্মবিশ্বাস চাপড়ে হাজার ফ্ল্যাশবাল্বের সামনে দিয়ে নিজের স্বতন্ত্র্য আভিজাত্যে হেঁটে গেছে ঋতুপর্ণ। তখন ওর শরীরে নারীর লাবণ্য, মুখে সৌন্দর্যের প্রশান্তি। কোনো সাক্ষাৎকারে ও বলেছিলো, ‘আমি সেলিব্রিটি। আমি কাজল, গয়না পরতে পারি। কিন্তু সবাই তা পারেনা। সেটা করলে লোকে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, মজা দেখে’। এরকমই যেন আস্তে আস্তে নিজের পরিপূর্ণতার দিকে দিকে এগোচ্ছিলো ঋতু। হয়ে উঠছিলো এল-জি-বি-টি কমিউনিটির একজন সক্রিয় কর্মী। ঠিক সেই সময়েই কৌশিক গাঙ্গুলীর ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’তে চপল ভাদুড়ী’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো ঋতু। বলা বাহুল্য, সেই ছবিতে ওকে দেখতে রেখা’র থেকেও বেশী সুন্দর লেগেছিলো।
ঋতুপর্ণর শেষ সম্পূর্ণ ছবি ‘চিত্রাঙ্গদা’। এই ছবিতেই যেন নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিলো ঋতুপর্ণ। এতদিনের ছবি বানানো, গল্প বলা, লড়াই সব মিশে তৈরী হলো এক আখ্যান। এ তো জীবন দর্শন! এমন একটা গল্প যেটা আমাদের সমাজের গালে একটা চড় কষিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে আমার জীবন আমি আমার মতন করে বাঁচতে পারি। ‘বি হোয়াট ইউ উইশ টু বি। ইটস ইওর উইশ’। এই ছবিতে প্রেম, ত্যাগ, মা-বাবা, মহাভারত সব যেন এসে একসঙ্গে মিশে গেলো। ‘চিত্রাঙ্গদা’র সঠিক মূল্যায়ন আমাদের দেশে হয়তো আজও হয়নি।
প্রকৃতির নিয়মই হলো আস্তে আস্তে জীবের পূর্ণতা ঘটানো। ‘হীরের আংটি’ দিয়ে যার সূচনা হয়েছিলো, ‘চিত্রাঙ্গদা’য় যেন তার সম্পূর্ণ বিকাশ হলো। অভাগা তো আমাদের দেশ যেখানে সমকামীতা সাংবিধানিক স্বীকৃতিই পেলো ঋতু-বিয়োগের চার বছর পরে।
আজ ৩০ শে মে। ঋতুপর্ণর মৃত্যুদিন। সাড়াদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায়, টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আবারও ফিরে দেখা হবে ওকে। কিন্তু তাতে ওর কী? ও তো নিজের জীবনটা নিজের মতন করে কাটিয়ে সবার সামনে একটা দাগ রেখে দিয়ে চলে গেলো। ঐ শান্ত, স্থির, সুন্দর বাংলা বলতে পারা পরিশীলিত ছেলেটা কোনো দুর্বল মানসিকতার সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হওয়া ‘হোমো’ হয়ে থাকেনি। বরং ‘বেশ করেছি গয়না পড়েছি’ বলতে পারা অসামান্য সুন্দর, দৃপ্ত, সাহসী একজন শিল্পী হয়ে উঠেছিলো যে তার জীবনটাকে তার নিজের সৃষ্টির সাথে মিলিয়ে দিতে পেরেছে।
স্যালুট ঋতুপর্ণ। তোমায় কুর্নিশ। ভারতীয় ছবির ইতিহাসে তুমি অমর। যেখানেই থাকো, এরকমই থাকো। ভালো থাকো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।