জন্ম:১৯৮১,পুরুলিয়া
শিক্ষাঃস্নাতকোত্তর,এম.ফিল.বাংলা ভাষা ও সাহিত্য -কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কর্ম-শিক্ষকতা,বাঁকুড়া
সাহিত্যচর্চা - কবিতাচর্চা ২০১৭ থেকে।
বই-চারখানা শীর্ণ হাত ও ঠাকুরমার ঝুলি
সাগরে নুড়ি কুড়োই..
“…আর্দ্র করি দিয়ে যাও ধরিত্রীর নির্মল ললাট
তব আশীর্বাদে।নিত্যবিগলিত তব অন্তর বিরাট,
আদি অন্ত স্নেহরাশি-আদি অন্ত তাহার কোথা রে!
কোথা তার তল!কোথা কূল বলো কে বুঝিতে পারে
তাহার অগাধ শান্তি,তাহার অপার ব্যাকুলতা
তার সুগভীর মৌন,তার সমুচ্ছল কলকথা,
তার হাস্য তার অশ্রুরাশি”…’সমুদ্রের প্রতি’ কবিতায় সমুদ্র দর্শনের এই বিস্ময়রূপ আমরা অনায়াসে যে মানুষটির দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারি,তিনিই আমাদের প্রানের সাগর,বিদ্যাসাগর।
আর হ্যাঁ, গভীর সাগর থেকেই পাকে পাকে পাকদণ্ডী অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় ‘হিমাদ্রির হেমকান্তি’।হিমালয় সদৃশ্য সেই মানুষটিই আমাদের ঈশ্বর।
আবির্ভাব দু’শ বছর আগে।কোম্পানির রাজত্বকালে,টোলপাঠশালার দেশে।শহরে একদিকে কোম্পানির দাক্ষিন্যে হঠাৎ নতুন শ্রেণির ধনী-বাবুমাশাই,তাদের বিলাস,ব্যসন,বিকৃতরুচিবিলাস।অন্যদিকে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে বহুবিবাহ,বাল্যবিবাহ, সতীদাহ,কুলীনকুলসর্বস্বতা।ছিল দিনে ও রাতে অশিক্ষার সমান অন্ধকার।
এমনই এক পরিবেশে ১৮২০ সালে জন্ম নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে ধুতি, চাদর আর চটির ঢেউ তুলে ‘নিদ্রা রসে ভরা’বাঙালি জীবনে নিয়ে এলেন নবজাগরণের সুনামি।অসম্ভব প্রজ্ঞাবান,পরিশ্রমী মানুষটি মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের পাঠ শেষ করে শুরু করেন অবিস্মরণীয় এক কর্মজীবন।১৮৪১ সালে,ডিসেম্বর মাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত পদে নিয়োগ দিয়ে শুরু। তারপর সংস্কৃত কলেজের সহসম্পাদক,কর্মত্যাগ,পুণরায় ফোর্টউইলিয়াম কলেজের হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ, সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক, অধ্যক্ষ পদ, বিদ্যালয় পরিদর্শক,পুণরায় চাকরিতে ইস্তফা, স্বাধীন অবস্থায় অক্লান্ত পরিশ্রমে মেট্রোপ্লিটান কলেজ কে প্রতিষ্ঠিত সুনাম দেওয়া,সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি প্রতিষ্ঠা…মাথা নত করেন নি কোথাও।করেন নি আদর্শের সঙ্গে সমঝোতা। রক্ষণশীল সমাজ হোক,বা ইংরেজ সরকার,কিংবা অতি আপনার জন,প্রিয়জন প্রত্যেকের কাছেই বাধা প্রাপ্তি ঘটলেও দমে যাননি কখনও।যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছে,অন্তরে গড়িয়েছে অশ্রু।আমরা পেয়েছি মেয়েদের শিক্ষা,পেয়েছি বিদ্যালয় -কলেজে শিক্ষার সংস্কার।শহর ও জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পেয়েছি ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’,’বাঙ্গালা ভাষার ইতিহাস,’জীবন-চরিত’,’বোধদয়’,’বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’,’উপক্রমণিকা’, ‘ঋজুপাঠ’,’শকুন্তলা’ সীতার বনবাস’, ইত্যাদি।যেন ধীরে ধীরে তিনি গড়ে দিয়ে চলেছেন বাঙালির ভাবনার ভাষা,চিন্তার খোরাক।
অন্যদিকে বীরসিংহে জেগে থাকেন মা।অন্যের দুঃখে কাতর মা,মায়ের কান্না টলিয়ে দেয়,গলিয়ে দেয় কোমল অন্তঃধারায় প্রবাহিত পর্বত প্রাণ। চার-পাঁচ-ছয় বছরের বহু ও বিধবা বিবাহে পীড়িত মেয়েদের অসহায় করুণ ভাবে জীবন সমর্পন,শিক্ষালাভে অনধিকার নিয়ে প্রতিবাদী যুক্তিবাদ নিয়ে তাই লড়াইয়ে নামেন সমাজ -সংসারের নিয়ন্তাদের সঙ্গে।এ বড় ঘোর যুদ্ধ,সেই সময়ের সমাজের প্রেক্ষিতে। জেলায় জেলায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা,বিধবা ভাতা,আইন পাশ করে বিধবা বিবাহ ও বহুবিবাহ রদ..তাঁর অক্লান্ত চেতনার ফসল।
অভিমান করে প্রিয় বন্ধুকে একবার বলেছিলেন,”আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না” তবু দেশের লোকের জন্যই নিজের জীবন তিনি সর্বার্থ ভাবে উৎসর্গ করেছিলেন।ব্যথিত দুঃখীজীবনের নিঃশ্বাস, ঈশ্বরের দীর্ঘশ্বাস বুঝছিল কি কর্মাটাঁড়?জানি না।আমাদের জানা নেই মানুষকে এমন গভীর ভাবে ভালোবাসার ঐশ্বরিক মন্ত্র।
আজ তাই শুধু তাঁর স্মরণ নয়।চাই সেই মন্ত্রের খোঁজ। তার উত্তরসূরি দের জন্য আজ এমনই চিরিত্রবান মানুষের মাথার ওপর প্রয়োজন।কেন এত বছর পরেও আমাদের মনে হচ্ছে,আমরা বোধ হয় পেছনেই হাঁটছি বারংবার!আমাদের সমাজে,আমাদের শিক্ষায় কি তবে নেই সেই বীরসিংহের সিংহপুরেষের স্বছতা ও বিশালতা! ধর্ম,জাতি, পুরুষ,নারী,মানুষ নিয়ে যে বিজ্ঞান সম্মত, যুক্তিবাদী ভাবনা দু’শ বছর আগে জন্মানো একটি মানুষের চিন্তাকে যে ভাবে আলোড়িত করেছিল,আজকের প্রজন্ম কে তা করতে পারছে না কেন!নাকি তারা গ্রহণে সক্ষম হওয়ার জন্য প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে! চন্দ্রযান, মঙ্গলযানের থেকেও কী তবে উৎকৃষ্ট ছিল উনিশ শতকের সেই নবজাগরণ অভিযান!
শিশু বিধবার কোমল কান্না শুনে যাঁর চোখ দিয়ে জল ঝরত,বিধবা বিবাহের জন্য বারংবার সমাজ পরিবারের কাছে অপমানিত ঝড়ে ভাঙা বনস্পতি হতে হয়েছিল যাকে -আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন? দেশের শত শত নির্ভয়া, আসিফা,মণিকাদের দেখে তিনি আজ কীভাবে লড়াই করতেন!আমরাই বা কী করছি তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটা সমাজের সামনে থেকে অবক্ষয় দেখে!!
আজ বিদ্যাসাগরের জন্মের দু’শ বছরে এমনি কিছু প্রশ্নের রেখাপাত হোক।মাস্তুলে জ্বলে উঠুক দূরের দ্বীপ। অজানার সন্ধানেই সাগরবেলায় উঠে আসুক পরশপাথর।অসীম গভীর সাগরে শুরু হোক আমাদের একনিষ্ঠ নুড়ি আহরণ।
ঋণ স্বীকার
১।বিদ্যাসাগর জীবন-চরিত: শম্ভুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
২।রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজঃশিবনাথ শাস্ত্রী