• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক T3 অরিজিনাল মিনি সিরিজে নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী (পর্ব – ৬)

ইংরেজ কখনও এদেশে আসেনি – ৬

মির্জা আবু তালিব এর ওয়ালিদের নাম ছিল আসিফ খান। আসিফ খানের মেয়ে মমতাজের সাথে শাহজাহানের নিকাহ হয়। পরিবর্তে শাজাহান আসিফ খানকে উজিরের পদ দেন। ইরানি মির্জা আবু তালিব একনিষ্ঠভাবে বহুবছর মোগলদের খেদমত খাটার পরপর উপাধি পান ‘শাইস্তা খান’। ‘শাইস্তা’ অর্থাৎ ভদ্র সভ্য আদব কায়দা জানা মানুষ। বাংলায় যা পরিণত হয় ‘শায়েস্তা খান’ এ। সেই শায়েস্তা’র অর্থ পুরোপুরি পাল্টে যায়, যখন শায়েস্তা খান শিবাজীর কাছ থেকে শায়েস্তা হয়ে বাংলায় এসে হার্মাদদের শায়েস্তা করে হৃত গৌরব ফিরে পান।
সম্পর্কসূত্রে শাইস্তা বা শায়েস্তা খান ছিলেন আওরঙ্গজেবের মামা। তার উপাধি ছিল আমীর-উল উমারা বা আমীরদের মধ্যে প্রধান। মোগল ডিপ্লোমাসিতে অত্যন্ত পটু দূরদর্শী মানুষটি উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় ভবিষ্যতের আলমগীরকে সাহায্য করেন এবং তাঁর বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শিবাজীর কাছে মির্জা আবু তালিবের নাস্তানাবুদ হওয়ার পর ওরঙ্গজেব তার উপর নারাজ হন এবং মীর জুমলার মৃত্যুর পর তাকে বাংলার সুবেদার করে পাঠানো হয় নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ দিতে। মারাঠা যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবার পর দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শায়েস্তা খানের সামনে বাংলা থেকে ওরঙ্গজেবের জন্য মারাঠা যুদ্ধের জন্য বেশি করে রেভিনিউ পাঠানোর ছাড়া, আর তা করতে গিয়ে বাংলাতে পর্তুগীজদের অধিকার খর্ব করা ছাড়া, মোগল দরবারে মুখ রক্ষার আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না।
১৪৯৭ সালে ভাস্কো দা গামা কালিকট পৌঁছয়। আর ১৫১৭ সালের মধ্যে পর্তুগিজরা বাংলায় ঢুকে পড়ে। ঢোকার কারন, বাংলার তিন সমৃদ্ধ বন্দর। চট্টগ্রাম সপ্তগ্রাম আর হুগলী। গোটা ফার ইস্টের গোল্ডেন ট্রেডিং রুটের মুখ।
রবীন্দ্রনাথের কটা লাইন বোধহয় সব বাঙালিরই ফেভারিট, বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী রাজদণ্ডরূপে। বণিক, রাজদণ্ড, মানদন্ড – সেসব তো নয় বোঝা গেল। কিন্তু ‘শর্বরী’? সাধারণ মানুষ হিসেবে একটু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় যদি একটা দেশে এতই সুশাসন থাকবে তাহলে ‘শর্বরী’ কোথা থেকে এলো? রাতের অন্ধকার নামল কেন? কী ঘটেছিল সেই রাতের অন্ধকারে? বাংলায় রাতের অন্ধকার নামানোর মূল কারিগর কারা?
সপ্তগ্রামে তখন সরস্বতীর নাব্যতা ধীরে ধীরে কমে আসছে । পর্তুগিজরা তাদের দৃষ্টি ফেরায় হুগলির দিকে। বাংলায় কিছু মানুষ কিন্তু এখনও শায়েস্তা খানের সময়ের সুশাসন নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগতে ভালবাসে। যারা বাংলায় শায়েস্তা খাঁর হার্মাদ দমনের গৌরবগাঁথা নিয়ে চওড়া কাহিনী শুনিয়ে বেড়ান, তাঁরা জেনে আশ্চর্য হবেন, পর্তুগীজদের বাংলায় আনার মূলে কিন্তু ছিলেন মহান মোগল পাদশাহ আবুল ফত জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর গাজী। ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ পেদ্রোট্রাভেস হুগলি থেকে আকবরের সভায় যান এবং আকবর হুগলিতে পর্তুগীজদের বসতি স্থাপন, চার্চ নির্মাণ এবং নিজের ধর্ম পালনের পুর্ণ স্বাধীনতা দেন। সম্রাট আকবরের সেই সনদে পর্তুগিজরা সপ্তগ্রামে এতটাই অধিকার পেয়েছিল যে তাদের অনুমতি ছাড়া হুগলিতে কোন বাণিজ্য পোতের প্রবেশাধিকার ছিল না। আর ধীরে ধীরে তাদের সেই দাদাগিরি পরিণত হতে থাকে দস্যুবৃত্তিতে। উড়িষ্যা বাঙলার সীমান্তে ছিল এক বন্দর। পিপলি। এই পিপলি পরবর্তীকালে দাস ব্যবসার প্রধান স্থান হিসেবে পরিণত হয়। পিপলিরও একচ্ছত্রাধিপতি হয়ে ওঠে পর্তুগিজরা।
প্রথমদিকে পর্তুগীজদের সাথে আরাকান রাজ্যের ঝামেলাই ছিল। বারোভূঁইয়া আর মোগলদের অশান্তির সময় পর্তুগিজরা ধীরে ধীরে স্ট্রাটেজিক্যালি অবস্থিত সন্দ্বীপ দখল করে নেয়। মেঘনার অববাহিকা চিরকালই বাংলায় তথা গৌড়ে প্রবেশের দ্বার হিসেবে পরিচিত ছিল। এই মেঘনা অববাহিকা পুরোপুরি চলে যায় পর্তুগিজদের হাতে। বারোভূঁইয়ার পতনের পর তাদের থামানোর ক্ষমতা সেই নতুন মোগল শাসকদের তখন ছিল না। কিছু ছোটখাটো প্রতিদ্বন্ধিতা করে একসময় পর্তুগিজ আর আরাকানীরা হাত মেলায়। বাংলায় শুরু হয় রাত্রির অন্ধকার। সেই রাত্রির অন্ধকারে লুটের মালের বখরা পর্তুগিজ আরাকানীরা আধাআধি ভাগ করে নিতে থাকে। লুটের মাল ছিল- জীবন্ত মানুষ।
কেমনভাবে পর্তুগিজ ও মগরা তাদের অপারেশন চালাত?
ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ার এর কিছু লেখায় এর প্রত্যক্ষ বিবরণ পাওয়া যায়। খুব দ্রুত ঝটিতি আক্রমণের ভঙ্গিতে মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুরা জলপথে আসতো এবং তারা বিভিন্ন গ্রাম-নগর এর মধ্যে ঢুকে যেত। জলপথের একশো কিলোমিটার দূরের গ্রামের জনপথে আক্রমণ করার ইতিহাসও ছিল। সেই আক্রমণ হতো অতি দ্রুত, কাউকে কোনরকম গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগের আগেই। স্ত্রী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান সকলকে বন্দী করে ফেলা হতো। তারপর গরম জ্বলন্ত শিক ঢুকিয়ে তাদের হাতের তালুতে ফুটো করা হতো, সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো বেতের বাঁধন এবং গাদা করে এক মানুষের ওপর আর একজন মানুষকে চাপিয়ে জাহাজের অন্ধকার পাটাতনের নিচে ফেলে রাখা হতো সাধারণ মানুষকে। খাবার জন্য তাদের উপর ছড়িয়ে দেওয়া হতো কাঁচা চাল।
তবে এই ‘মাল’ নিয়ে গিয়ে কোথাও ডেলিভারি দেওয়ার সময়, ধৈর্য তাদের ছিল না। তার জন্য ছিল ইংরেজ, ওলন্দাজ, ড্যানিশ এবং ফরাসিরা। এই জ্যান্ত কাঁচামাল নিয়ে গিয়ে তাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হতো। কখনো-সখনো তারাও আসত কেনাকাটা করতে। বিক্রির বাজার ছিল তমলুক, বালেশ্বর ও এই কলকাতায়। উৎসব অনুষ্ঠানের দিন ছিল এধরনের শিকার ধরা ও কেনাবেচার সেরা সময়। কী অসাধারণ সিসটেমেটিক ব্যবস্থা! মনুষ্যত্বের কী নিদারুণ অপমান। যে দেশে বসে খাওয়া, সেই দেশের মানুষের দাড়ি উপড়ানো! একদল বিদেশি শাসককে বাঙালি দিনের পর দিন খাজনা দিয়েছে অথচ ন্যূনতম সুরক্ষাও তারা পায়নি। বাঙালির কী অসীম ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা!
যে গ্রাম থেকে দস্যুবৃত্তি করা হতো সেইসব গ্রামে লুটপাট অবশ্যই চালানো হতো। বাড়িঘরে ধরে ধরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হতো। গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হয়ে যেত। প্রতিরোধ শক্তি বলে মানুষের কিছু ছিল না। এ তো গেল স্থল লুন্ঠনের ঘটনা। পূর্ববঙ্গ গীতিকায় জল লুন্ঠনের কথাও বলা হয়েছে-
লুটতরাজ করে তারা আর দাগাবাজি
সাগরে হার্মাদের তরে কাপে নায়ের মাঝি।
মগ ও পর্তুগীজদের এই আক্রমণের ফলে বহু লোকালয় খালি হয়ে যায়, দ্বীপগুলি জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং তা অরণ্যে পরিণত হয়। যদি কেউ ভাবেন, মোগলরা সাধারণ মানুষের দু:খ দুর করতে পর্তুগিজদের আটকেছিল তাদের জানাই, মোগলরা পর্তুগিজদের ইবলিশের মতো ভয় পেত। আর পর্তুগিজরা মোগল জাহাজ দেখলেই আক্রমণ করত। অবস্থা এমন হল, বাংলাদেশে ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। মোগল পাদশাহির খাজনার ভাঁড়ারে টান পড়ল।
বিশ্বের অন্যতম সেরা বাজার এই বাংলা, মোগলদের টাকা রোজগারের, রাজপুত ও মারাঠা যুদ্ধের অর্থ সাপ্লাইয়ের প্রধান জায়গায় প্রোডাকশন বিঘ্নিত হতে থাকলো। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার – বাদশা’র কর্মচারীদের ‘নিজস্ব ব্যবসা’ বিঘ্নিত হতে থাকলো।
‘নিজস্ব ব্যবসা’ , ‘ প্রাইভেট বিজনেস’ ব্যাপারটা ইতিহাসের এত বড় নিয়ন্ত্রক যে কেউ না বুঝলে তাকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। বাংলায় রাজকর্মচারীদের নিজস্ব ব্যবসা বিঘ্নিত হওয়ায় এরপরেও একটা বড় যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধের নাম পলাশীর যুদ্ধ। কিন্তু তার কথা পরে।
যুগে যুগে সব শাসক শ্রেণীর কর্মচারীর রমরমা বিজনেস চলে। কখনো তা পান রপ্তানির কখনো পাট রপ্তানির, কখনো রুপো আমদানির, কখনো হাওয়ালার। ইংরেজ আমলের রাজকর্মচারীরা এবং পুর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি শাসকদের সেপাইরা যেমন বিভিন্ন নিজস্ব ব্যবসায়ে যুক্ত থাকত, মোগল আমলেও তা ছিল। শায়েস্তা খান নিজেও ব্যবসা চালাতেন। সেসব ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। তখন শাসকেরা নড়েচড়ে বসে এই হার্মাদদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। তারপর রাজ্যের লোক ধন্য ধন্য করল। কিন্তু তালেগোলে তারা এটা ভুলে গেল এই পচা পুকুর আসলে খনন করেছিল কে? কে ডেকে এনেছিল খাল কেটে কুমির? আর নিরীহ বাঙালি প্রজাদের ছেড়ে দিয়েছিল তার মুখে।
অবশ্য বাঙালি প্রজারা নিজেরাও যথারীতি এই মগ আক্রমণের সময় যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিল। তাদের চিরাচরিত ব্যবস্থা মেনে প্রথমেই তারা প্রতিকারের অস্ত্র হিসাবে নিজেদের মানুষকে আক্রমণ করেছিল। পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে কোনরকম প্রতিরক্ষা না গড়তে পারুক, নিজেদের আক্রান্ত মানুষগুলিকে এমনকি তাদের আত্মীয়স্বজনকে অবধি যতখানি সম্ভব সামাজিক ও মানসিক নির্যাতন আর হেনস্থা করে তারা বরাবরের মতো প্রকৃত বাঙালি হওয়ার যথার্থ প্রমাণ রেখেছিল। কোন সংসারের একজন মগ আক্রান্ত হলে তারা পুরো বংশকে দোষী বলে চিহ্নিত করে দিত। যথেচ্ছভাবে সমাজে নিজের জাতির মানুষকে সমাজ বর্জিত করার সর্বনাশা কাজটি বাঙালি পণ্ডিতেরা সবসময় করে গেছে এবং তখনও তাই করত। হার্মদরা কোন মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে গেলে যদি তার স্বামী বা পিতা আবার তাকে ফিরিয়ে নিতে চাইতো তাহলেও অসভ্য নৃশংস সেই পণ্ডিতরা তাদের ব্যাপারে কিছুমাত্র সহানুভূতি দেখাত না। বাঙ্গালীদের এই স্বভাবের কথা জেনে ফিরিঙ্গি দস্যুরা অনেক সময় মেয়েদের অপহরণ না করে, সম্ভ্রম নষ্ট না করে, শুধুমাত্র তাদের গায়ে থুথু ফেলত অথবা আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করত এবং তার ফলে তার গোটা পরিবারকে বাঙালি সমাজ নিগ্রহ করত, অপবাদ দিত। সেই কলঙ্কিত ঘৃণ্য ব্যবহারের সাক্ষী দিতে আজও কিছু কথা রয়ে গিয়েছে। মগা ব্রাহ্মণ, মোগো বৈদ্য, মগা কায়েত, মগ পাড়া, মগরা, মগরাডাঙ্গা- এই কথাগুলো আমাদের জানায় যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিগৃহীত মানুষদের চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন। এ সময় বিভিন্ন দুর্ঘটনার ফলে বহু বর্ণসঙ্কর মানুষের জন্ম হয়। যাদেরকে মগ ফিরিঙ্গি বলা হতো।
হার্মাদ আক্রমণের পরেই যে কুখ্যাত আক্রমণটি বাঙালিকে জাতিগত ভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছিল তা ছিল বর্গী আক্রমন। তার বিষয়ে আগেও কিছু বলা হয়েছে। বর্গীদের নারকীয় অত্যাচার সম্ভবত পৃথিবীর বহু কুখ্যাত জেনোসাইডের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু সেই অত্যাচারের শুরু কোথা থেকে হয়েছিল? কেন হয়েছিল তা?
সম্ভবত সেই ঘটনার মূল প্রোথিত ছিল মুর্শিদকুলি খাঁয়ের মোগলদের প্রতি অতিভক্তি এবং তার উত্তরসূরী আলীবর্দী খাঁর অপরিণামদর্শিতায়। মসনদ দখল ও খাজনা আদায়ে এই নবাবরা এতই ব্যস্ত থাকতেন যে তারা নিজেদের প্রজার ওপর আগত অভিশাপের কালো মেঘ যে ঘনিয়ে উঠছে তা দেখার ফুরসতটুকু তাঁরা পাননি।
হার্মাদ ও মগরা যখন বাংলাকে প্রায় বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল, তার পরেও বাংলা কিন্তু ছিল মোগল যুগের সবচেয়ে অর্থকরী সুবা। ফলন্ত মাটি, প্রচুর কৃষিজাত দ্রব্য, কুশলী তাঁতী ও অন্যান্য কারিগর, নদীপথের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সবসময়ের মত সস্তার লেবার এই সব মিলে সেই ঘনঘোর সময়েও বাংলা ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রদেশ। অনেকটা সেই নারীর মতো, যার এ সংসারে নেওয়ার কিছুই নেই, অথচ দেওয়ার জন্য সবকিছু আছে। সে শিশুকে স্তন দান করবে, সঙ্গীকে দেবে দেহ। সবশেষে সংসারকে নিজের কায়িক শ্রম দেওয়ার পরেও সেই নারীর সৌন্দর্য এত বেশি, জীবনশক্তি এত অফুরান যে তাকে রাতের বেলা পাঠানো হবে অতিথি পারসিকদের কাছে, আবিসিনিয়ানদের কাছে, আরব ও চীনাদের কাছে, গুজরাটিদের কাছে, মারোয়াড়িদের কাছে, মালাবারি, তুর্কি, ইহুদিদের কাছে, আরমেনিয়ানদের কাছে, ইংরেজ, ডেনিশ, ওলন্দাজ ও ফরাসিদের কাছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই সবকটি জাতির কাছে তখনও অর্থের সন্ধান মানেই, বাংলা মুলুকে এস, আর বাংলাকে যথেচ্ছ ভোগ কর।
যখন মুর্শিদকুলিকে বাংলায় পাঠানো হয় তখন ওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে অর্থাভাবে জর্জরিত। সাম্রাজ্যের অন্য কোথাও থেকে বিশেষ কর আসছে না। একমাত্র ভরসা বাংলা। বাংলার ঐশ্বর্য তখন প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। ফারসি ঐতিহাসিকেরা বাংলাকে বলছেন- জান্নাত ইদ মিলাদ অর্থাৎ প্রদেশের মধ্যে মধ্যে স্বর্গ। আওরঙ্গজেব নিজে তাকে বলছেন জাতীয় স্বর্গ। আর বলবেন নাইবা কেন! অর্থ, আশ্চর্যজনক সস্তা দামে সুন্দরী রমণী এবং অল্পবয়স্ক ছেলে – মুঘলদের প্রয়োজনীয় তিনটি জিনিসই এখানে পাওয়া যেত অপর্যাপ্ত।
মুর্শিদকুলি রাজস্ব সংস্কারের নামে ওরঙ্গজেবকে সেই জিনিসটি দেন যা তখন তার সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল। টাকা। সে টাকার পরিমাণ এতটাই বেশি যে মুর্শিদকুলি ব্যাপারে কোন অভিযোগই কানে তোলেন না জাফর মোহাম্মদ মহীউদ্দীন আলমগীর পাদশাহ গাজী।
আজ, গাজীর নাতি, বাংলার সুবাদার আজম উস শানকে অগ্রাহ্য করেছে দেওয়ান মুর্শিদকুলি?
মাফ।
কাল, ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়েছে মুর্শিদকুলি?
মাফ।
পরশু, মাকসুদাবদকে নতুন রাজধানী করেছে মুর্শিদকুলি? যাকে পরে সে মুর্শিদাবাদ নাম দেবে?
তাও মাফ। বিলকুল মাফ।
কী এমন করেছিলেন মুর্শিদকুলি? যার জন্য মহামহিম ধুরন্ধর আলমগীরের তার প্রতি এত দরদ উথলে উঠেছিল? ইতিহাস চওড়া হেসে বলে মুর্শিদকুলি রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করেছিলেন। কিন্তু সেই কাজের সিনারিও এনালাইসিস আমাদের চুপিচুপি কী বলে?দেখা যাক এ কাজের জন্য মুর্শিদকুলি ঠিক কী কী করতেন।
মুর্শিদকুলির খাজনা রিফর্ম সিস্টেমের জন্য তৈরি হয় এক হিংস্র নতুন জমিদার শ্রেণী। পুরনো জমিদারেরা যারা প্রজাদের বংশগতভাবে চিনতেন, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং সুখে দুঃখে খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে কমিয়ে রাখতেন তারা বাতিল হয়ে যান। যেভাবে হোক, যে কোন উপায়ে খাজনা আনতে হবে এই ছিল মুর্শিদকুলির কথা। এর ফলে গরিবেরা আরো গরিব হয়ে পড়ে। নতুন জমিদারেরা নিষ্ঠুরভাবে মানুষের মুখের ভাত মেরে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা শুরু করে। বস্তুতঃ তিনি এমন এক মেকানিজম শুরু করেছিলেন যাতে রাজস্ব আদায় ছাড়া আর কোনো কাজই হতো না। আর তিনি কী পেয়েছিলেন? এই পদ্ধতিতে অচিরেই তিনি হয়ে ওঠেন সবচেয়ে ধনী প্রদেশের সবচেয়ে ধনী নাজিম। এতটাই ধনী যে সেই নাজিমকে পাত্তা দিতে ওরঙ্গজেব নিজের দৌহিত্র আজিম উস শানকে বাংলা থেকে ফুটিয়ে বিহারে পাঠিয়ে দেন।
নবাব আজিমুসশান ও তার দিওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁর প্রতিদ্বন্দিতায় পড়ে সাধারণ জমিদারেরা অতিষ্ঠ, তটস্থ হয়ে উঠলেন। খাজনার টাকা জমা না পড়লে খাবার দাবার এমনকি পানীয়জল অবধি না দিয়ে বন্দী করে রাখা বা উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা তো অতি সাধারন ব্যাপার। তাদের নিক্ষেপ করা হতো বিষ্ঠা ভরা কুয়োর মধ্যে এবং যতক্ষণ না খাজনা আদায় হয় ততক্ষণ তার মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হতো। ঘৃণ্য রসিকতা করে তার নাম দেওয়া হয়েছিল বৈকুণ্ঠ। তাতেও খাজনা আদায় না হলে মুখে গোবর মাখিয়ে সারা শহর ঘুরিয়ে তারপর কোতল করা হতো। এবং তাতেও আদায় উসুল ঠিকমত না হলে সবংশে তাদের ধর্মান্ত করা হতো। তবে একবার গুষ্টিসুদ্ধ ধর্মান্তকরণ হয়ে গেলে, তখন সব অপরাধ মাফ।
মুর্শিদকুলি খানের নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার ও হৃদয়হীন স্বভাব প্রায় প্রবাদপ্রতিম হয়ে ওঠে।

ক্রমশ…

তথ্যসূত্র:
যশোর খুলনার ইতিহাস – সতীশ চন্দ্র মিত্র
বাদশাহী আমল – বিনয় ঘোষ
বাঙ্গালার ইতিহাস – কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।