শীতকালে সকাল বড় দেরি করে আসে। এতে আমার তেমন আপত্তি না থাকলেও নন্দিতা প্রায়ই ক্ষেপে ওঠে। কিছুতেই তাকে বোঝাতে পারি না সকাল একটা প্রাকৃতিক নিয়ম, তার আসা যাওয়া আমার হাতে নেই। কিন্তু বৌ হলেও সর্বোপরি সে একজন নারী, আর সমাজে কে না জানে নারীদের যাবতীয় সমস্যার কারণগুলিও কেমন যেন পুরুষতান্ত্রিক। যেমন সেদিন সকাল আসতে আসতে প্রায় একটা বাজিয়ে ফেললো। তাই দেখে নন্দিতার কি হম্বিতম্বি। মাঝে একবার সকালের পক্ষ নিয়ে ফস করে বলে ফেলেছিলাম, “তুমি কেবল সকালেরই দোষ দেখো, তোমার কাজের মাসি কোনদিন ঠিক সময় আসে বলো দেখি?” ব্যাস, গনগনে গরম তেলে যেন জল ছিটকালো, “একদম বাজে কথা বলবে না কাজের মাসির নামে। তোমার এই অলপ্পেয়ে কথা শুনে যদি মাসি কাজের থেকে বিদায় নেয়, তবে বাড়ির সব কাজ তোমায় করতে হবে বলে দিলাম।” শুনে সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেলাম, মাসির হুমকি আছে, বেচারা সকালের নেই। অবশ্য মাসি বা সকাল – যে কোনও কারোর কামাই হলেই দোষ কেবল আমারই তা এই গত কয়েক বছরে বিলক্ষণ বুঝে গেছি, যাক, সে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই আর।
তবে গতকাল নন্দিতা পিতৃগৃহে যাওয়ায় সকালের আজও কামাই। এমনিতে সে কোথাও গেলে কাজের মাসিকে আসতে বারণ করে যায় একা থাকি বলে। যথারীতি বাড়িতে একাকীত্বের যাবতীয় দায়িত্ব এসে পড়ে আমার কাঁধে, সকাল এলে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কষ্ট, এরপর খাওয়া-দাওয়া-নাওয়া ইত্যাদি সংক্রান্ত সাংসারিক ঝক্কি অনেক। এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হিসেবে শীতকালীন নানা কবিসভায় চলে যাই। এই সভাগুলি আমার কাছে যেন বিশুদ্ধ অক্সিজেন। নানা প্রান্তের নানা কবিদের লেখা নানা কবিতা আমায় নিয়ে চলে এক মুক্তির দুনিয়ায়। গতকাল নন্দিতা ওবাড়ি যাওয়ার পরই ভেবে রেখেছিলাম আজ একবার ‘দিবসের শেষে’ পত্রিকার তরফে কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ আছে, সেখানে যাব। কিন্তু সকালটা আজ এত দেরি করায় সময়ে পৌঁছানোর সংশয় জাগলো। গতকাল রাত্রে বাড়ি ফিরেছিলামও যথাসময়ে। চাবি দিয়ে দরজা খুলতেই দেওয়াল ঘড়ি ঢং ঢং করে পাঁচবার শুনিয়ে দিলো রাত একটা বাজে। ঘড়িটাকে নন্দিতার যেন শিখিয়ে রাখা আছে আমার আচরণের উপর নজর রাখতে। তাই সভ্য ভব্য ছেলেটির মতো ঠিক একটার সময়েই ফিরতেই গম্ভীর ভাবে সেটা পাঁচবার না জানালেও হতো, কিন্তু ফোকটে খবরদারী করতে ঘড়িও ছাড়ে না। ‘দিবসের শেষে’র সভা বিকেলের দিকে, তাই সকাল আসার দিকে আর বেশি পাত্তা না দিয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে থাকলাম।
ইছামতীর ধারে পৌঁছতে দেখতে পেলাম ইতিউতি দু-একজনকে ঘোরাঘুরি করতে। এখনও সকলে এসে পৌঁছয়নি। আয়োজকদের খোঁজ করতে জানলাম তারা সবে রওনা দিয়েছেন মাত্র। যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে কুটোগ্রামের স্বনামধন্য কবি মানবিক জোয়ার্দ্দারও উপস্থিত হয়েছেন। অনেকদিন বাদে দেখা হওয়ায় আলিঙ্গনে কুশল বিনিময় হলো খানিক। কথায় কথায় জানতে পারলেন আজ সকাল কামাই করায় পাঠপ্রস্তুতির বিন্দুমাত্র সময় পাইনি। খানিক আহাউহু করে বাঙালিজাতির পাল্লায় পড়ে সকালের এই হ্যানো আচরণের প্রতি ক্ষোভ জানালেন বেশ খানিক। তবে বাঙালি কবিরা সবসময়ই গতানুগতিক সমাজের থেকে এক কদম এগিয়ে, তাই প্রস্তুতি নিয়ে খুব একটা ভাবিত হলাম না। আলোচনায় জ্ঞান বাড়ে, তাই মানবিকবাবু বাংলা ভাষা নিয়ে খানিক পর্যালোচনা করতে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললেন নদীর ধারে। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসতে যাবো, নাকে একটা বিকট গন্ধ ভেসে আসলো। তা জানাতেই দেখি শুধু আমি নই, তিনিও পেয়েছেন বটে। রাগে গজ গজ করে উঠলেন, “ইসস, এখানে পাঠালো হারামজাদা!” কে পাঠালো জিজ্ঞেস করায় তেমনিভাবে উত্তর দিলেন, “ওই তো ওপাশ থেকে গ্রামের এক লোক দেখে ফাঁকা জায়গার খোঁজ করতে এদিকটা দেখালো, বললো এদিকে মানুষজন কেউ আসে না, প্রয়োজন সেরে নিতে। তখন কি আর ভেবেছি কোন প্রয়োজনের কথা বলছে! অ্যাঃ, থু থু থু…”
যাই হোক, ততক্ষণে দিবসের শেষের তরফে তরুণ উদ্যোক্তা পরিচ্ছন্ন দে এসে উপস্থিত। আলোচনার জন্য একটু নিরিবিলি স্থানের খোঁজও পাওয়া গেলো। সেখানে বসতে মানবিকবাবু ব্যাগের মধ্যে হাত ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, “বুঝলে সতু, আজকালকার বাংলায় আর জোর নেই। জোশ চাই বুঝলে, জোশ। এমন জোশ যে রক্ত আগুনের মতো টগবগ করে ফুটে উঠবে। তবে না আসবে কবিতা। সত্তরের দশক, বুঝলে, তখন তোমরা শিশু কি জন্মাওনি, সেই বাংলা আর এই বাংলা, হাঃ ভগবান! বাংলার জোশে তখন রক্ত ঝরত, রক্তবীজের মতো জন্মাতো কবিতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল আন্দোলন, যুগান্তকারী সব ঘটনাগুলো এলো কোত্থেকে? দুনিয়ায় আর কোনও নিদর্শন আছে আমাদের বাংলার মতো? আহা, কর্কের ছিপি কাঁচের বোতল, কী ছিল…” ব্যাগের থেকে চানাচুরের প্যাকেট আর স্বচ্ছ বোতল বের করে সামনে রেখে, “…আর কী হলো। বাংলাও ব্র্যান্ডের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে, বুঝলে ভায়া। টাইগার, পাঞ্চ – বাংলা কোথায়? আমি ভাই এখনও ফিফটি আর সিক্সটি আপের ভক্ত।” আমিও তার উক্তিতে সম্মতি জানালাম। যাবতীয় বিলিতির পাশে আমাদের গর্বের বাংলা আজও স্বমহিমায় টিমটিম করে জ্বলছে, আমাদের কবিতার যথার্থ ইন্ধন। বাংলার ব্র্যান্ডেড বিপননের নিশ্চয়ই একটা প্রতিবাদ হওয়া কাম্য।
বোতল থেকে দুঢোক টলটলে বাংলা পান করে চানাচুর মুখে নিয়ে দেখতে থাকলাম পরিচ্ছন্ন দে ও তার দল সকলেই উপস্থিত হয়ে পরিষ্কার একটি জায়গা দেখে কবিমঞ্চ গড়তে ব্যস্ত। দেখে আক্ষেপ গলায় দলা পাকিয়ে উঠল। কোথায় গেল সেই বাংলা কবিতার আকুতি, যখন বাঙালি কবিদের ডাক আসতো বিদেশি মঞ্চের থেকে। ইছামতীর ধারে কবিতার সায়াহ্নে মনে পড়ল সত্তর দশকের এক স্বনামধন্য বাঙালি কবির তুলোঁ সফরের কথা, শোনা কথা যদিও। বাংলা কবিতা তখন শ্যাম্পেন শেরী দিয়ে উদ্যাপন হতো। বিশ্ববন্দিত কবিদের কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর সেদিন সবাই অনেক রাত অবধি অবসর যাপনে ব্যস্ত। পরের দিন খুব সকালে হোটেলের রিসেপশনিস্ট কবির একটি ফোন পেলো, “বনজো মাদামে, দয়া করে আমাকে জানাতে পারেন আপনাদের হোটেলের বারটি কখন খুলবে?”
“এটি ১৪ হাউরেসে খুলবে মঁসিয়ে।” ফরাসী রিসেপশনিস্ট মেয়েটি স্বভাবসুলভ ভদ্রতায় জানালো তাঁকে, শুনে ফোনটি কেটে দিলেন কবি।
আবার ঘন্টা খানেক পর ফোন, “বনজো মাদামে, দয়া করে আমাকে জানাতে পারেন আপনাদের হোটেলের বারটি কখন খুলবে?”
এবারও ভদ্রভাবে মেয়েটি একই উত্তর দিলো, ফোন কেটে গেলো। আবার ঘন্টাখানেক বাদে রিং রিং, “সি ভ্যু প্লে মাদামে, আপনাদের বারটি কখন খুলবে?”
বার বার এই হ্যানো ফোনে এবার মেয়েটিও খানিক বিরক্ত, এবার তিনি জানালেন, “মঁসিয়ে, আমাদের বারটি দুপুর দুটোয় খুলবে। আপনি যদি অর্ডার করেন, তবে আমাদের বয় আপনার রুমেই ড্রিঙ্ক ডেলিভারি দিয়ে দিতে পারবে।”
শোনামাত্র এবার কবির ম্রিয়মাণ কন্ঠ শোনা গেল, “আমি ড্রিঙ্ক চাইছি না মাদামে, গতকাল রাত থেকে বারের ভিতর আটকে আছি, দয়া করে যদি আপনাদের কেউ একটু তাড়াতাড়ি খুলে আমাকে উদ্ধার করেন…”
আরও দুঢোক খেতে খেতে দেখতে পেলাম মঞ্চ তৈরি, সেখান থেকে উদ্দাত্ত সম্বর্ধনার আওয়াজ ভেসে আসছে পরিচ্ছন্ন দে’র কন্ঠ থেকে। মানবিক বাবুর পাঠ ছিলো সবার প্রথমে, ঝটপট একটি পেয়ালা মুখে নিয়ে কুলকুচি করতে করতে তিনি চলে গেলেন সেদিকে। খানিক দূরে মঞ্চ, মানবিক বাবুর স্তুতির পরে শুরু হবে তাঁর পাঠ। মঞ্চে তখন কবি গৈরিক মুন্সীর আত্মহত্যা নিয়ে একটি গম্ভীর বক্তৃতা চলছে। এই প্রসঙ্গে দুই কবির কথোপকথনের কথা মনে পড়ে গেল। এবার লন্ডন শহরের এক বার। বসে আছেন প্রখ্যাত দুই কবি, পানপাত্রে মগ্ন ও চোখ টিভিতে খবরের চ্যানেলে। সেখানে তখন আরও এক কবি লন্ডন ব্রীজের মাথায় উঠে আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই দেখে সেই দুইজন নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করলেন। প্রথম কবি বললেন, “কবি জেরাল্ড এই ব্রীজ থেকে লাফ দেবে, দশ পাউন্ড বাজি।”
লন্ডনে কবিদের রেষারেষি দুনিয়ায় জনপ্রিয়। এই শুনে দ্বিতীয় কবিও অমনি বাজি ধরলেন, “দেবে না, আমিও দশ পাউন্ড বাজি রাখছি।” ডিল সম্পন্ন হওয়ায় দুজনেই তাকিয়ে বসে থাকলেন টিভির দিকে। একসময় জেরাল্ড ব্রীজের উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল টেমসের জলে ও মারা গেলেন। সেই দেখে দুই কবি আক্ষেপ করতে করতে আরও দুই পাত্র পানীয় খেয়ে ফেললেন।
অত্যধিক পানীয়ের পরে প্রথম কবির মন নরম হয়ে এলো। তিনি দ্বিতীয় কবিকে বললেন, “ভাই রে, সত্যিটা স্বীকার করি। আমি আগের থেকেই জানতাম কবি জেরাল্ড আত্মহত্যা করবেন। দুপুরে একবার দেখেছি এই খবর। তোমার বাজির টাকা আমি নিতে পারব না।”
শুনে দ্বিতীয় কবি উত্তর দিলেন, “ভাই, আমিও দেখেছি ওই খবর। কিন্তু বাজি ধরার আগে মাথায় ঢোকেনি যে গর্দভটা একই ভুল দুবার করবে। দশ পাউন্ড তোমারই প্রাপ্য।”
এর মধ্যে দেখলাম নবীন কবি তরুণ মিত্রর অবস্থা খুব বেসামাল। তাকে আরও কয়েকজন ধরাধরি করে এনে আমার পাশে বসিয়ে দিতেই বোতল ধরে বাকিটা সে উদরে চালান করে দিলো। অবস্থা দেখে তাকে প্রশ্ন করলাম, “কী ব্যাপার ভাই, আজ এত খাচ্ছ কেন?”
সে উত্তর দিলো, “দুঃখের কথা আর কী বলবো দাদা, জানেন গত আগস্ট মাসে ব্যাঙ্কে সাত লাখ টাকা রেখে আমার বাবা মারা গেছেন?”
বড়ই দুঃখ পেলাম। আহা বলে উঠতেই সে আবার বললো, “সেপ্টেম্বরে আমার মা মারা গেলেন আমার জন্য পাঁচ লাখ টাকা রেখে।”
সত্যিই আক্ষেপের কথা। গালে দুহাত রেখে ‘ইসস’ বলে উঠলাম। দেখে সে বলে উঠল, “এখানেই শেষ নয়, গেল মাসে তিন লাখ টাকা আমার নামে করার পর পরই আমার ঠাকুমাও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো, ছোটর থেকেই ভালোবাসত খুব।”
সত্যিই বড় আক্ষেপের খবর, তার হাত ধরে বললাম, “আমি দুঃখিত ভাই, তিন জন স্বজন হারানোর দুঃখ মেনে নেওয়া সত্যিই কষ্টকর তা বুঝি।”
শুনেই হাহাকার চরম মাত্রায় নিয়ে গিয়ে তরুণ মিত্র জানালো, “সবচেয়ে আক্ষেপের খবর এই মাসে দাদা, আজ নভেম্বরের উনত্রিশ তারিখ হয়ে গেলো, কারোর কোনও খবর পেলাম না এখনও!”
তরুণ মিত্র শুধুই কবিতা লেখেন। তার কবি জীবন দীর্ঘায়িত করতে আত্মীয় স্বজনদের এমন পদক্ষেপের পাশে নিজের অবস্থা ভেবে খানিক মনোক্ষুণ্ণ হলাম। নন্দিতার কোনও হেলদোল নেই আমার কবিজীবনের প্রতি। সে শুধুই সংসার আর স্বজন বোঝে আর সব সময় আমার প্রতি উল্টোপাল্টা ধারণা করে। গত সপ্তাহেই এক বন্ধুর বাড়ির আসর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতেই দরজায় তালা দেখে তার থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করছি, কিন্তু বার বারই ফস্কে যাচ্ছে সে আমায় ঠেলে সরিয়ে বলল, “ছাড়ো তো যতসব। চাবিটা দাও, আমি খুলছি।”
তখনও পর্যন্ত একদম সুস্থ ছিলাম, কথাটা শুনে আঁতে বড় লাগলো। উত্তর দিলাম, “তুমি কী ভাবছ, আমার নেশা হয়েছে, তালা খুলতে পারব না? তুমি শুধু বাড়িটা শক্ত করে ধরে রাখো, আমিই খুলে নিতে পারব।” শুনে নন্দিতা খুব একচোট রাগারাগি করলো। কিছুতেই বোঝে না, বড় বেশিমাত্রায় চিন্তা করে ফেলে।
কথায় কথায় ততক্ষণে তিন চার জনের পাঠ শেষ হয়েছে। মানবিকবাবু আবার ফিরে এলেন এবং শুনলেন তরুণ মিত্র বোতলের বাকিটুকু শেষ করে ফেলেছে। নবীন প্রজন্মের এই হ্যানো হাল দেখে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “চলো হে, আর এক বোতল জোগাড় করা যাক।” তা আজও নন্দিতা ফিরবে না, তাই কোনও অসুবিধা নেই ভেবে তাঁর মতে মত মিলিয়ে উঠে আসলাম নদীর ধার থেকে। আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে বাজারের মধ্যে এক গলিতে এসব বেচার ব্যাবস্থা আছে। শুনেই মানবিকবাবু আমায় টেনে এক রিক্সা ধরে চললেন তার উদ্দেশ্যে। গলির সামনে পৌঁছতেই রিশকাওয়ালা বললো, “বাবু, গলিতে রিক্সা ঢুকবে না, আপনারা হেঁটেই চলে যান।” শুনে মানবিকবাবু ক্ষেপে উঠলেন, বললেন, “পয়সা দিয়েছি যাবে না মানে? মদ খেয়েছি দেখে আমায় মাতাল পেয়েছো নাকি? গলির মধ্যে অত বড় বড় দোকান ঢুকে গেল আর তোমার রিক্সা ঢুকবে না মানে?” এরপর আমার দিকে ফিরে বললেন, “কি অবস্থা দেখেছো, রিক্সাওয়ালারাও আজকাল নিজেদের লরির ড্রাইভার ভাবে।”
তা যাই হোক, তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে গলির মধ্যে ঢুকে দেখি সেটি একটি অন শপ। বসে খাওয়ার ব্যবস্থা দেখে মানবিক বাবু উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। দু’গ্লাসের অর্ডার দিয়ে বললেন, “বাঃ! বেশ ভালো ব্যবস্থা দেখছি। জানো গত সপ্তাহে কী কাণ্ড?”
বললাম, “কী?”
“আর বোলো না, ভয়ঙ্কর ভৌতিক কাণ্ড। সেদিন এক বারে প্রচুর খেয়েছিলাম। আরও অর্ডার করতে বয় এসে বললো আমাকে নাকি আর দেওয়া যাবে না। খুব রাগ করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। পাশে আরেকটা বারে গিয়ে দেখি সেই ছেলে তখন সেখানে। এবারেও বারণ করলো। শুনে আমি আবার বেরিয়ে এলাম আর ফের যতবারই অন্য বারে ঢুকে মদ চাই ততবারই দেখি সেই ছেলেটাই বলে আর দেওয়া যাবে না। শেষে এক জায়গায় তো আমায় ঢুকতে দেখেই এগিয়ে এসে ধাক্কা মেরে বের করে দিলো। তুমিই বলো ভাই ভৌতিক কাণ্ড কিনা।”
এর মধ্যে আরও দু’বোতল শেষ করে ফেলেছি দুজনে। কবিসভা থাকলে এই সুবিধা সর্বত্র। বাঙালি কবিদের রক্তের জোশ বাড়ানোর আদর্শ আরক হলো এই পানীয়। পেটে যেতেই বিদ্রোহী সত্বার বিপ্লব ঘটে। দু’চার লাইন লিখলেও কবিতাপাঠের মধ্যে আমি কোনওকালেই নেই। তার থেকে কবিদের একান্ত সান্নিধ্যই বেশি পছন্দের। তাদের দর্শন, আলোচনা, উদ্দামতার বিকাশ কখনই মঞ্চে বসে পাওয়া যায় না। কবিরা সেখানে আটকে থাকতে পছন্দ করে না। মানবিকবাবুও ব্যতিক্রম নয়। বেশ খানিক খাওয়ার পরে দুজনেরই পা টলোমলো। পানীয় শেষ হওয়ায় বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মানবিকবাবু সামনের রাস্তায় এগিয়ে গেলেন ট্যাক্সি ডাকতে।
সবে একটা সিগারেট অর্ধেক শেষ করেছি, দেখলাম খানিক দূরে কোনও ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে তিনি উদ্দাম তর্ক জুড়েছেন ও ভীষণ চ্যাঁচামেচি। এগিয়ে যাব কি, দেখি কোত্থেকে দুজন পুলিশ এসে তাঁকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে চলে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কী করি ভেবে আশেপাশের লোকেদের জিজ্ঞেস করে গেলাম পুলিশ স্টেশনে। গিয়ে দেখি ততক্ষণে মানবিকবাবুকে তারা গারদে পুরে দিয়েছে। বড়বাবুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম গারদে পোরার কারণ। ওদিকে মানবিকবাবু আমাকে দেখতে পেয়েছেন ততক্ষণে, চেঁচিয়ে অভিযোগ জানাতে লাগলেন, “এইটুকু রাস্তা যাওয়ার জন্য পাঁচশ টাকা ভাড়া, মামদোবাজি নাকি?”
সত্য অভিযোগ। তাঁর পক্ষ নিয়ে বড়বাবুকে জানালাম, “হাফ কিলোমিটার যেতে পাঁচশ টাকা ভাড়া! সরকারি নিয়ম জানেন না নাকি মশাই? যেমন খুশি ভাড়া চাইলে ট্যাক্সিওয়ালাকেই আপনাদের ধরার নিয়ম। তার জায়গায় এই গোবেচারা কবিটিকে আপনি গারদে আটকে দিলেন?”
বড়বাবু চোখ তুলে চাইলেন আমার দিকে, বললেন, “তুমি কী ওর সঙ্গী নাকি, তোমাকেও ঢোকাবো? দেখেই মনে হচ্ছে তুমিও টেনে আছো?”
এমন উক্তি শুনে খুব ভয় পেলাম। যতটা সম্ভব ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, শুনি এনার বিরুদ্ধে অভিযোগটি কী?”
বড়বাবু আমাকে আরও ভয় পাইয়ে দিয়ে জানালেন সেই ট্যাক্সিতে নাকি কোনও ড্রাইভারই ছিল না।
একটু আগেই মানবিকবাবু জানিয়েছিলেন তিনি যেখানে সেখানে ভূত দেখছেন আজকাল। কিন্তু সে দাবী যদি আমি এখানে রাখি, তবে তাঁর পাশে আমারও স্থান হবে তখনও এটুকু চেতনা আছে। গারদের মধ্যে চেয়ে দেখলাম চেঁচামেচি করে ততক্ষণে মানবিকবাবুও খানিক নেতিয়ে পড়ে গারদের মাটিতে বসে হেঁচকি তুলে চলেছেন। ভাবলাম এখন বেশি কর্তব্য দেখিয়ে লাভ নেই, পুলিশে আমাকে তাঁর ঘরে বা তাঁকে আমার ঘাড়ে গছানোর আগেই থানার থেকে বেরিয়ে আসাই উচিত মনে হলো। মদ খেলে আমি অন্তত কবি অক্লান্ত সেনের মতো আচরণ করি না। তখন বরিস ইয়েলেতসিনের আমল, অক্লান্তদা ফিরলেন রাশিয়া থেকে। একদিন তার বাড়িতে আমন্ত্রণ পড়লো, গিয়ে দেখি পানভোজের বিপুল আয়োজন। শুনতে পেলাম অক্লান্তদার সঙ্গে বরিস ইয়েলেতসিনের সাক্ষাৎ হয়েছে। শুনেছিলাম বরিসবাবু বেজায় রসিক মানুষ, উৎসবের শেষে উৎসাহ নিয়ে অক্লান্তবাবুর কাছে জানতে চাইলাম, “আচ্ছা, প্রেসিডেন্ট ভদ্রলোক মানুষ কেমন?”
অক্লান্তদা জানালেন, “হেব্বি লোক ভাই, মদ ছাড়া কিছুই বোঝে না, সারাদিন মদ খায়।”
থতমত খেয়ে বললাম, “সেকি! রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েও এমন মাতাল?”
অক্লান্তদা উত্তর দিলেন, “প্রেসিডেন্ট আবার কে? আমি তো আমার কথা বলছিলাম।”
হঠাৎ দেখি সেখানে মানবিকবাবুর স্ত্রী এসে উপস্থিত। একসাথে এসেছিলেন, কবিসভায় মানবিকবাবুকে ছেড়ে পাশেই তার বোনের বাড়ি গিয়েছিলেন দেখা করতে। ফিরে এসে সমস্ত খবর পেয়ে থানায় এসেছেন। বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করে মুচলেকায় সইসাবুদ করে সে যাত্রায় মানবিকবাবু ছাড়া পেলেন।
কুটোগ্রাম যাওয়ার রাস্তা আমাদের এলাকার উপর দিয়ে, তাই তাদের গাড়িতে আমারও একটু জায়গা জুটে গেল ফেরৎ আসার জন্যে। একটা আদর্শ কবিসভার আয়োজন করেছিল বটে ‘দিবসের শেষে’। গাড়ির আবহাওয়া দেখে খুব একটা মুখ খুললাম না। বাড়ি ফিরে এসেই বজ্রপাত, নন্দিতা উপস্থিত।
আমতা আমতা করে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নন্দিতা আমাকে দেখে বলে উঠল, “হাড়গিলের বংশধর, আমি বাড়ি নেই কী আজও তুমি মদ গিলে এসেছো? এইসব করে বেড়াও আমি না থাকলে? একদিনেই এই হাল, সব ছেড়ে চলে যাবো যেদিন, সেদিন দেখবো কী করে থাকো।”
সেদিনের কথা ভেবে মনে মনে বড়ো খুশি হয়ে উঠলাম, এমন ভাগ্যও আমার আসতে পারে তবে! পরিস্থিতিটা কল্পনায় সিনেম্যাটিক ফ্রেমের মতো ভেসে উঠতেই আবেগ আর বাঁধ মানলো না, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, “আহা! এমনও হয়!”
পরের দিন নন্দিতাকে দেখতে পেলাম না আর। তারপরের দিনও নয়, তারপরের দিনও। এমনি করে দিনসাতেক কাটার পর একদিন কোনও মতে বাঁ চোখ সামান্য খুলতে পারলাম। তার কোণ দিয়ে আবছা দেখলাম নন্দিতা হরলিক্সের গ্লাস হাতে আমার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে।
মন প্রসন্ন হয়ে উঠলো…