আজ সারাটা দিন মেঘলা। আকাশের মতো গৌরীর মনটাও। কণা কণা বাষ্পও যেন জমছে সেখানে। কিন্তু কেন? এত দুর্বল তো সে ছিল না! তাহলে কি ওই ব্লু হেভেন অপারেশনের ব্যাপারে কাগজের রিপোর্টিং, ভেতরটাকেও নাড়িয়ে দিয়েছে? হয়তো তাই। মনটাও বড্ড শ্রান্ত, ক্লান্ত। একটু যেন বিশ্রাম চাইছে।
ডিজি সাহেবকে এ কদিন বহুবার ফোন করেছে, উনি তোলেন নি লাইন। একবার শুধু ওঁর পি এ ফোন ধরে জানিয়ে দিল, সাহেব ব্যস্ত। বাইরের ফোন নিচ্ছেন না।
যথেষ্ট অপমানিত গৌরী। তার মানে ব্লু হেভেনের ব্যর্থতার জন্য তিনিও তাকেই দায়ী করছেন। অথচ ওই অপারেশন স্পটেই তাকে যেতে দেওয়া হল না।
ছুটির অনুমতি চেয়ে, অফিসে একটা মেল পাঠিয়ে দিল গৌরী। সঙ্গে সঙ্গেই অরিন্দমের ফোন।
-কী ব্যাপার? ছুটি চাইছ! এনি প্রবলেম? শোন, তোমার সেদিনের কথা আমি সম্পূর্ণ ভুলে গেছি, এভরিথিং ডিলিটেড ফ্রম মাই মেমোরি লিস্ট। আরে বাবা জানি তো, ওগুলো সব অভিমানের কথা। ওকে, চলে এসো। অফিস জয়েন কর। ঠিক আছে, অফিসে কোনও কাজ দেওয়া হবে না তোমাকে। শুধু বসে বসে আমার সঙ্গে গল্প করবে। হা হা হা। আসলে তোমায় না দেখলে আমি তো কাজে মন পাই না। প্লিজ কাম।
লোকটার স্পর্ধা দিন দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছে। গৌরী তবু রাগটাকে বশে রাখে, মন বলছে সামনের পথ আরও দুর্গম।
-তাহলে আসছ তো?
বিরক্ত এবার গৌরী। কাঠ কাঠ শব্দগুলো বেরিয়ে এল মুখ থেকে, ‘সরি স্যার। আজ, কাল, হয়তো পরশুও যাব না অফিসে। অ্যাকচুয়ালি, এমন একটা ভাইটাল কাজ নিয়ে বসেছি, ওটা নিষ্পত্তি না করে … তবে কিছু প্রয়োজন পড়লে, অবশ্যই ফোন করবেন’।
কথা বলতে বলতে গৌরী তার সামনে ছড়ানো ছেটানো পত্রিকাগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে। … বহু আলোড়ন তোলা জ্যোতিপ্রিয় সিনহার সেই কেসের খবর এখন তার চোখের সামনে, পাতায় পাতায় জ্যোতিপ্রিয়র ছবি, সাত বছর আগের এক খল নায়ক … কী দোর্দন্ডপ্রতাপ ছিল তখন মানুষটার।
আর আজ? এক শিকড় ওপড়ানো গাছ যেন। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিজের পাপের কথা মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেছেন, অনুশোনচনায় ফুঁপিয়ে কাঁদছেন কখনও, কখনও আবার ক্ষমা ভিক্ষা চাইছেন গৌরীর কাছে। সময় কত কী কেড়ে নেয় !
তাই বুঝি ওই মানুষটার প্রতি প্রগ্রাঢ় ঘৃণার চাঁইটা একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করেছে গৌরীর মধ্যে। মৃত মানুষকে নতুন করে আর কীভাবে সে মারবে?
নিউজগুলোর কাটিং সে অতি যত্নে একটা ফাইল বন্দী করে রাখছে। কিন্তু এত কাঠখড় পুড়িয়ে জোগাড় করা তথ্য থেকে সে কোনও একটা জায়গায় পৌঁছতে পারছে না কেন? আর কারা কারা ছিল জ্যোতিপ্রিয়র সাথী? খুঁটিয়ে পড়েও তার হদিস মিলছে না।
আসলে পত্রিকাগুলো প্রথম দিকে ঘটনা খুড়তে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পরের দিকে হঠাতই যেন ঝুপ করে পর্দা ফেলে দিল।
তবু পোস্টমর্টেমের চোখ গৌরীর, বারংবার খবরগুলো থেকে সে কিছু টেনে বার করতে চায়। মন বলছে আপাত চেনা কিছু মানুষের মুখে এঁটে আছে মুখোশ, কিন্তু তারা কারা?
ব্যালকনিতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল গৌরী। টবের বাগান ফুলে ফুলে ঢাকা। বটুকদার হাত যশ আছে। কত সুন্দর সুন্দর ফুল! শরত এসে গেল। কিন্তু বাতাসে তো সেই পুজো পুজো গন্ধটা নেই। আর তো মাত্র কদিন। তবে কি এবার শরৎ ফাঁকি দিল তাকে?
কোথায় সেই শিউলি ভোর, চিকচিকে রোদ, আর ঘাসের ডগায় শিশির জল? তেরো তলায় বাস করেও দিব্যি সে সবের ঘ্রাণ পেত এতকাল। কিন্তু এবারের শরত পুরো অপচয় হয়ে গেল শিব শম্ভুর পেছনে। তবু ওই ভন্ড বাবাজীর চুলের ডগা পর্যন্ত ছোঁয়া গেল না। সত্যিই, এ যে কত বড় পরাজয় তার জীবনে।
দুপুরের দিকে পরপর অনেকগুলো ফোন গৌরীর মোবাইলে। প্রথমে হরিবাবু, একটু আমতা আমতা ভাব, – খবরটা শুনেছেন ম্যাডাম?
-কী খবর?
ওপাশটা নীরব। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে বলে, ‘আপনাকে কমপালসারি ওয়েটিং এ পাঠানো হচ্ছে। চিঠি তৈরি’।
এমন কিছু ঘটতে পারে, আগেই সন্দেহ হয়েছিল। অরিন্দম পালের প্রতিশোধ স্পৃহা সাংঘাতিক!
মুখে তাই কোনও ভাবাবেগ না ফুটিয়ে গৌরী বলে, ‘যাক, কদিন তাহলে বিশ্রামে শুয়ে বসে কাটাতে পারব, কী বলেন ক্যাপ্টেন?’
-না ম্যাডাম। – হরিবাবুর গলাটা ধরা ধরা। – আপনার সঙ্গে যা হল, ঠিক হল না মোটেই। এটা অন্যায়, ভীষণ অন্যায়। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবে আমার পাকা চুলের অভিজ্ঞতা বলছে, পিকচার অভি বাকি হ্যায়। পাশা পাল্টাবেই’।
-দেখা যাক। তবে আমি মনে মনে প্রস্তুত, আরও বড় লড়াইয়ে নামতে হবে। যাক, আপনারা সবাই ভাল থাকবেন। মাঝে মাঝে যোগাযোগ রাখবেন। ছাড়ি ।
এলোমেলো ভাবে এরপর অনেকক্ষণ সে হেঁটে বেরায় ব্যালকনিতে। হাতের মোবাইলটা অকারণেই নাড়াচাড়া করে, সকালে গুড মর্নিং মেসেজ পাঠিয়েছে অনুভব। সঙ্গে আরও দু চার লাইন। কলকাতা নাকি ওকে ডাকছে। তাই আবার ওপর মহলের কাছে দরবার শুরু করেছে, যদি ফিরে আসা যায়।
মনে মনে হাসে গৌরী। এও একটা মিশন ছিল অনুভব সিনহার। … ব্লু হেভেনকে ছিনিয়ে নেওয়া গৌরীর হাত থেকে, অপারেশনকে অসফল প্রমাণ করা, সর্বশেষ, গৌরী সিনহার ক্যারিয়ারকে পুরোপুরি ধবংস করে দেওয়া।
এখন মিশন কমপ্লিট। তাই ওই পাহাড়ি রুখা শুখা জমিতে পড়ে থাকতে আর চাইছে না অনুভব।
একটা হাহাকার ছেয়ে যায় বুকে। সারা জীবনে কি একটাও কাছের মানুষ পাবে না গৌরী?
কী মনে করে জ্যোতিপ্রিয়র নম্বরটাই সে টিপে দেয়।
-হ্যাঁ ঘুঙুর মা, বলো? অফিসে বেরিয়ে গেছো?
-না। আজ বাড়িতে। কী করছেন?
-এই সব পুজোর লিস্টি ফিস্টি তৈরি করছি। সকালে পুরোহিত মশাই একগাদা জিনিসের ফর্দের কথা বললেন। সময় নেই তো হাতে। শরীরও ভাল যাচ্ছে না, তাই দুজন ছেলেকে কাজে লাগিয়েছি, ওরাই সব কিনে কেটে এনে দেবে। মা, আর একটা কথা। পুরোহিত মশাই বার বার বলছেন, তোমাকে কিন্তু দীক্ষা নিয়ে পুজোর কাজে বসতে হবে।
-দীক্ষা! প্লিজ বাবা, ওই দীক্ষা টীক্ষার চক্করে আমাকে টানবেন না। পুজো পালিতেও আমি বিশ্বাসী নই। তবে দুর্গা পুজোর উৎসবটা খুব এনজয় করি।
জ্যোতিপ্রিয় চুপ, কোনও দ্বিধা দ্বন্দে ভুগছেন মনে হল। -আসলে, আমাদের বাবা ঠাকুর, মানে আমাদের কুলপুরোহিত, উনিই বার বার বলছেন দীক্ষার কথা। ওটা এমন বড় কোনও কাজ নয়, সামান্য আয়োজনের মধ্যেই মিটে যাবে, অল্প সময় লাগবে। মহালয়ের পরদিনই আমি ঠিক করেছি …
-আচ্ছা, সে হবে’খন। আমার কিন্তু এই পুজোয় কয়েকটা জিনিস চাই বাবা।
জ্যোতিপ্রিয় হাসলেন, ‘বল না কী চাই? সাধ্যের বাইরে গিয়েও তোমাকে দেব, যা চাইবে।
গৌরী মৃদু হাসে। কথাগুলো বড্ড মোহাচ্ছন্ন করে দেয় তাকে। ভুল হচ্ছে না তো কোথাও? এক জীবনেই এত পরিবর্তন একটি মানুষের!
-এই পুজোয় আমি বেশ কিছু মানুষকে নিমন্ত্রণ করতে চাই। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী মানুষদের, ভিড় ভাট্টায় যারা পুজো দেখতে পারে না। আমি কিছু হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করব, ওতে করে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আসা হবে। তারা ঘুরে ঘুরে আমাদের ঠাকুর দেখবে, আনন্দ করবে, উৎসব করবে। পুজো তো মানুষেরই উৎসব।
-বাহ, বেশ বললি তো। আমি রাজি। শোন মা, তাহলে পুজোটা বরং আমার নতুন বাড়িতেই হোক। কুসুমপুরের বাড়ি। তৈরী হয়ে পড়ে আছে। গৃহপ্রবেশ পর্যন্ত হল না। অনু তো একবার গিয়েই এমন বকাঝকা শুরু করল। অমন পান্ডব বর্জিত জায়গায় নাকি কেউ বাস করতে পারবে না।
গৌরী নিজেও শুনেছে কুসুমপুরে তাদের প্রাসাদতুল্য বাড়ির কথা। জ্যোতিপ্রিয়র সারা জীবনের সঞ্চয় নাকি ওখানেই অর্ধেকের ওপর ঢেলে দিয়েছেন। তবে অনুভবের কেন যেন টান নেই ওই বাড়ির প্রতি।
-কুসুমপুর জায়গাটা এত সুন্দর! তেমনি সুন্দর আমার কুসুম ভিলা, ওটাই বাড়ির নাম। – জ্যোতিপ্রিয় হাসতে হাসতে বলে চলেন। – কুসুম ছিল অনুর মায়ের নাম, ওর নামেই নাম রেখেছি। দু, তিন হাজার লোক দিব্যিসে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পুজো দেখতে পাবে। আনন্দ করতে পারবে। আর একটা কথা, এবার ঠিক করেছি, আমার ওই পুজোর থিম হবে, নারী শক্তি।
ফাইলের মধ্যে আলগা হয়ে থাকা টুকরো কাগজগুলো হঠাত হাওয়ায় পতপত করে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। ব্যালকনি থেকে ছুটে এসে গৌরী ওগুলোকে সামলায়। তারপর ধীরে বলে, ‘কবে আমার দীক্ষার দিন ঠিক করেছেন বাবা?’
জ্যোতিপ্রিয় থেমে থেমে বলেন, ‘দেবীপক্ষের প্রথম দিন। খুব ভাল তিথি সেদিন, তুমি দীক্ষা নিয়ে মায়ের পুজোয় বসার যোগ্যতা অর্জন করবে’।
গৌরী ভ্রু কুঁচকে কিছু চিন্তা করে নেয়।
-আচ্ছা ঘুঙুর, তোমায় তো সেদিন তাহলে অফিস ছুটি নিতে হবে মা। পারবে? যা দায়িত্বপূর্ণ পদে আছো’।
হাসল গৌরী, ‘না, এখন আমি নির্ভার। কাঁধ থেকে সব গুরু দায়িত্ব তুলে নিয়েছে ওপর তলার কর্তারা’।
-মানে? কী হয়েছে? আমাকে বলা যায়?
-হ্যাঁ, বলা যেতেই পারে। আমাকে আপাতত কমপালসারি ওয়েটিঙে রাখা হয়েছে।
জ্যোতিপ্রিয় অনেকক্ষণ চুপ। পরে ধীরে ধীরে বলেন, ‘তোমার জীবনের সব দুর্যোগ সরে যাবে একে একে। পুজোটা এবার ভাল করে করতে দাও। বুঝতে পারছি একটা সাইক্লোন যেন আছড়ে পড়তে চাইছে তোমার ওপর, কষ্ট হয় এসব শুনতে। সন্তানকে বিপর্যস্ত দেখলে কোন পিতার না কষ্ট হয় ! কিন্তু আমার তো কিছু করার ক্ষমতা নেই, শুধু কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, ওই তুফান থেমে যাক, বৃষ্টি নামুক আমার সন্তানের জীবনে’।
সারা দিনটা গড়িয়ে গড়িয়েই কেটে গেল গৌরীর। ঠিক বিকেলের দিকে মেলটা ঢুকল। হ্যাঁ, হরিবাবুর কথাই ঠিক। তাকে আপাতত কমপালসারি ওয়েটিঙে রাখা হচ্ছে। ভেবেছিল, অনুভবকে ফোন করবে, কী এক অভিমানে, নম্বর টিপেও কেটে দিল সে।
বটুকদা চা জলখাবার টেবিলে রেখে গেছে অনেকক্ষণ, ওগুলো জুড়িয়ে এখন ঠান্ডা। নতুন করে আবার সব বানিয়ে এনেছে বটুকদা। টেবিলে সাজিয়ে দিতে দিতে গজগজ করে ‘কদিন তোমরা দুজনে একটু বিদেশ ফিদেশ ঘুরে এসো দেখি। এই বাড়ির মধ্যে থেকে পচে মরবে দেখছি এবার’।
অনুভবও একই তাল তুলেছে, এবার পুজোয় নাকি তারা বিদেশ সফরে যাবে। সব প্রোগ্রাম ফিক্সড। গৌরীর কাছে বাড়িতে দুর্গা পুজো হবার কথা শুনেও উড়িয়ে দিল। ‘রাখো তো বাবার কথা, পুজো করলে বাবা একা একা করুক, তুমি আমি থাকতে পারব না। এতগুলো টাকা পেমেন্ট হয়ে গেছে ট্র্যাভেল এজেন্টের কাছে। আর ফেরত পাব?’
অবাক হয় গৌরী। বাবার অনুগত ছেলে অনুভব, হঠাৎ এমন জেদ ধরল কেন? পুজোয় নাকি কিছুতেই এ দেশে থাকা যাবে না।
… গৌরী, ভীষণ জরুরি কিছু ডকুমেন্টস পাঠালাম ক্যুরিয়ারে। কবে পৌঁছবে, জানি না যদিও। পাহাড়ে আবহাওয়া খারাপ, অনবরত বৃষ্টি । তবু রেইনকোট চাপিয়ে বৃষ্টি মাথায় করেই ক্যুরিয়ার করতে বেরিয়েছিলাম। জিনিসগুলো তোমার হাতে পৌঁছনো দরকার। আর শোন, তুমি কিন্তু সাবধানে থেকো, প্রতিটি পা ফেলবে হিসেব করে। তোমার চারদিকে বিপদ।
… জানো, আমার জীবন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। কিন্তু এখনই হঠাৎ জীবনকে জবরদস্ত ভালবেসে ফেললাম। কী জ্বালা! এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। আরও কিছুদিন ডিকির সঙ্গে থাকব। মানে ওই পাশে পাশে, বন্ধু হয়ে। ওর টুকটুকে রাঙা বউ আসবে। তা আসুক, আমার বন্ধুত্বের জায়গা কেউ নিতে পারবে না।
…পরের বার যদি আবার সুমনা হয়ে জন্মাই, দুটো জিনিস ফেরত চাইব। ডিকি আর তোমাকে। গৌরী, বড় অল্প সময় কাটিয়ে গেলাম তোমাদের সঙ্গে। আশ মেটে কখনও? আগামী জন্মে অর্ধেকটা জীবনই যেন তোমরা জুড়ে থাকো।
… ভাল থাকবে, নিজেকে সুরক্ষিত রাখবে। আর হ্যাঁ, চুপিসারে জানাচ্ছি, আজ রাতেই হোটেল ছাড়ছি। একটা গোপন খবর এসেছে। রাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে। একটা গাড়ির সঙ্গে কথা বলে এসেছি। এখান থেকে সোজা শিলিগুড়ি, তারপর কলকাতায়। তারপর হয়তো তোমার কাছে। অপেক্ষা করবে তো আমার জন্য? আর যদি এ জীবনে না হয়, পরের জীবনে নিশ্চয়ই থেকো। অনেক আদর দিলাম, অনেক আদর নিলাম।
মেসেজগুলো যত পড়ছে, মন তত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। কতবার যে সুমনার নম্বরে ফোন করল, সেই এক অবস্থা, সুইচড অফ। তাহলে কি একবার হোটেলের নম্বরে … না থাক। হিতে বিপরীত হতে পারে। কিন্তু রাতে কেন ও হোটেল ছাড়ছে? এই ঝড় জলে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে … দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি তো বেশ কয়েক ঘন্টার পথ। কোনও কি বিপদের ইঙ্গিত পেয়েছে? নইলে রাতারাতি এভাবে পাহাড় ছাড়ার সিদ্ধান্ত!
সারা রাত একটা ছটফটানি চলল ভেতরে ভেতরে। কখন চোখ লেগে এসেছিল। চমকে উঠল মোবাইলের শব্দে। ওপাশে অনুভব। কী ব্যাপার, এখন?
-ও নো! – চমকে উঠল গৌরী। তারপরেই বুক ফাটা আর্তনাদ। – প্লিজ অনুভব, একবার পরীক্ষা করে দেখো, আমার মন বলছে সুমনা বেঁচে আছে। এখনও প্রাণ আছে ওর। ভাল একটা নার্সিংহোমে নিয়ে যাও প্লিজ। তোমার তো অনেক কানেকশন, একজন ভাল ডাক্তার দেখিয়ে … বিশ্বাস কর, ও এবার বাঁচতে চেয়েছিল। আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। বলেছিল কলকাতায় ফিরে দেখা করবে। অনুভব, আর ইউ লিসনিং টু মি? তোমার থেকে কোনদিন কিছু চাই নি। বলো চেয়েছি? আজ চাইছি, সুমনার প্রাণ। ওকে বাঁচিয়ে দাও। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। এভাবে একে একে আমার সব ভালবাসারা দূরে চলে যেতে পারে না।
বটুকদা কখন যে ঘুম চোখে উঠে এসেছে, খেয়াল করে নি। পরম মমতায় গৌরীর মাথাটা নিজের বুকে লেপ্টে ধরে বলে, ‘চুপ করো বৌদিমনি, চুপ কর’।
অনুভব একসময় আস্তে বলে, ‘থানায় খবর এসেছে আধ ঘন্টা আগে। আমি ফোর্স নিয়ে পৌঁছে গেছি স্পটে। ডাক্তার পরীক্ষা করে গেছে, শী ইজ নো মোর। তুমি নিজেকে শক্ত কর’।
(১৪)
সারা দিন আজ টিভির সামনেই কেটে গেছে গৌরীর। সুমনার মৃত্যুর খবর আজ সব চ্যানেলেই। যে জায়গায় খুন হয়েছে, সেটাও বার বার দেখানো হচ্ছে।
টিভি দেখতে দেখতেই বার কুড়ি ফোন করে ফেলেছে অনুভবকে। ভারী গলা, কোনরকম কান্না চেপে রাখা স্বর, ‘সুমনার মৃত্যুর একটা পূর্ণাংগ তদন্ত কর অনুভব। কোথাও কোনও ফাঁক রেখো না। যাকে বলে একটা ফুল ফ্লেজেড এনকোয়েরি। – এরপরেই গৌরী আপন মনে বিড়বিড় করে চলে, -মেয়েটা একেবারে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেল আমাকে।
টিভি থেকে সংবাদ পাঠিকার গলা ভেসে আসছে, ‘হোটেল থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে, সাংবাদিক সুমনাকে গুলি করে হত্যা করে চলে যায় খুনি। এতে চাঞ্চল্য ছড়ায় গোটা পাহাড়ে। অনেকে বলছেন …
টিভিটাকে মিউট করতে করতে গৌরী হাত মুঠো করে, আমারও তো একই প্রশ্ন, হাউ ক্যান ইট বি পসিবল? হোটেলের চারিদিকে আলোর ফোয়ারা, এত লোক চলাচল, তার মধ্যেই …
আবার ফোন লাগায় অনুভবকে, ‘তোমরা হোটেলের সি সি টিভি ক্যামেরা দেখছ না কেন? খবরে বলছে, বাইকে চড়ে এসেছিল আততায়ী।
অনুভব মৃদু হাসে, ‘হ্যাঁ, বাইক থেকেই সে গুলি চালায়। বাইকটাকে রেখেছিল গৌরীর ক্যাবের পেছনে। যাতে ক্যামেরায় ধরা না পড়ে। নিজেও সমস্ত আটঘাট বেঁধে এসেছিল। কোন কোন অ্যাংগেলে সি সি টিভি ক্যামেরা লাগানো, সব ছিল তার নখদর্পনে। গুলি চালনার সময় মাথায় হেলমেট থাকায় আর সামনে একটা ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে রাখায়, তার চেহারার আদলটাও ফুটে ওঠে নি ক্যামেরায়।
গৌরী আবার সাউন্ড বাড়ায় টিভিতে। সংবাদ পাঠিকা বলে চলেছে, -সুমনা নাকি একবার লাগেজ নিয়ে বেরিয়েও পড়েছিল হোটেল থেকে। মিনিট পাঁচেক পর, আবার তার গাড়ি ফিরে আসে হোটেলে। কারণটা এখনও জানা যায় নি।
অনুভবের কাছেই তাই সে কারণ জানতে চায়। ফোনেই উত্তরে শোনে, -হ্যাঁ, হোটেল কর্তৃপক্ষ নাকি একটা ভুল করে বসেছিল। তাদের কমপিউটরে ধরা পড়ে, সুমনার কাছ থেকে আরও কিছু পেমেন্ট বাকি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন লাগিয়ে সুমনাকে ডেকে নেয়।
গৌরী ভ্রু কুঁচকে শুনতে থাকে। কোথায় যেন হিসেব মিলছে না। যদি তাই হয়, হোটেলে ফিরে আসার পর সুমনাকে তো রিসেপশনে গিয়ে পেমেন্ট করতে দেখা যাবে। সি সি ক্যামেরা কী বলছে? প্রশ্নটা করতেই অনুভব চুপ। ও হয়তো মনে মনে অসন্তুষ্ট। গৌরী কি একটু বেশিই কেসের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে?
গলা ঝেড়ে গৌরী তাই বলে ওঠে, ‘অনুভব, সুমনার চলে যাওয়াটা আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। জানি ঘটনাটা তোমার জুরিসডিকশনে, এক্ষেত্রে আমি থার্ড পার্সেন, স্টিল বন্ধুত্বের দাবীতে বলছি, সুমনার গাড়ি ড্রাইভারকে ইমিডিয়েটলি অ্যারেস্ট কর। আর হোটেলটাকে ঘিরে দাও ফোর্স দিয়ে। আমার ইনস্টিংক্ট বলছে, কালপ্রিট ওখানেই লুকিয়ে আছে। এখনও সে পালাতে পারে নি।
অনুভব একটু জোরেই হেসে উঠল এবার, ‘খুনি তার কাজ সেরে অনেক আগেই বাইক ছুটিয়ে বেরিয়ে গেছে। সুতরাং হোটেলে তুমি কাকে খুঁজবে?
-যারা খুনের চক্রান্ত করেছে।
অনুভব এতক্ষণে সায় দেয়, ‘হ্যাঁ, এটাও একটা পয়েন্ট। শুধু শুধু সুমনাকে কেন হোটেলে ফেরানো হল? তবে ড্রাইভারকে আমরা আগেই অ্যারেস্ট করেছি, বেচারা ভয়ে সিটিয়ে আছে। বলল, সুমনা ম্যাডাম, গাড়িতে পা দিয়েই টেনশন করতে শুরু করেছিল। গাড়ির স্পিড বাড়াতে বলছিল, সরু গলি ধরে ছুটতে বলছিল যাতে কোথাও ট্র্যাফিকে আটকে না পড়ে।
-আই অ্যাম সিওর – শুনতে শুনতে গৌরী মাথা দোলায় – সময়ের কিছু একটা হেরফের হয়েছিল। হয় সুমনা নির্ধারিত সময়ের আগেই বেরিয়ে পড়েছিল বা ওই গলি গালা ধরার জন্যই আততায়ী ওর ট্র্যাক হারিয়ে ফেলেছিল। তাই ওকে আবার হোটেলে ফিরিয়ে আনা হয়।
অনুভব এবার ফোন ছাড়তে চাইছে। অহেতুক তাড়া দেখাচ্ছে। ও কি চায় না, সুমনার খুনি ধরা পড়ুক। কিন্তু কেন? যাওয়ার আগে, বন্ধুকে ক্যুরিয়ারে জরুরি কিছু কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে সুমনা। সেগুলো না আসা পর্যন্ত অনেক কিছুই তার সামনে ধোঁয়া হয়ে আছে। সুমনার খুনি আসলে কে?