৯ অগস্ট, ১৯৭৫৷ কলকাতা পেল তার নিজস্ব দূরদর্শন চ্যানেল৷ তার মাত্র আট দিন আগে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে দূরদর্শনের সর্বভারতীয় পরিষেবার সূচনা করেছেন৷ প্রথম যে পঞ্চাশ মিনিটের ছোট্ট অডিও-ভিসুয়াল এপিসোডটুকু দিয়ে যাত্রারম্ভ, রাধা ফিল্ম স্টুডিওতেই তা রেকর্ড করা হয়েছিল৷ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের হাতে দূরদর্শন কেন্দ্র কলকাতার উদ্বোধন৷ সঙ্গে তত্কালীন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল৷
গোড়ার দিকে দিনে মাত্র তিন ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার, তা-ও কলকাতার ভিতরে আর আশপাশ মিলিয়ে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে যাদের বাস, দর্শনের সৌভাগ্য শুধু তাঁদেরই৷ সে সব বাড়ির ছাদে তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্টেনা আকাশপানে চেয়ে থাকত, বাতাসে দৃশ্য-শ্রাব্য তরঙ্গ ভাসলেই তা ধরে ফেলে টিভি সেটে চালান করতে হবে৷ কাল এবং স্থানের এ সব খুঁটিনাটি সমস্যায় অবশ্য জনতার তুঙ্গ উত্তেজনায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি৷ ঘরের মধ্যে চলমান চিত্রমালার মায়ায় তখন মজে মহানগরী৷ সে সব ছবি সাদা-কালো, তবে প্রায়শই তার গায়ে নীলচে একটা আভা৷ টিভির পর্দাটুকু যাতে বাঁচানো যায়, তার জন্য উপরে একটা নীল আবরণ সেঁটে রাখা হত৷ ফলে সেই নীল যাবতীয় দৃশ্যরূপের গায়ে৷ এ একেবারে আদিযুগের কথা৷ স্যাটেলাইট টেলিভিশন আসতে তখনও ঢের দেরি।
এসব যখন যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আমি তখন সবে জন্মেছি।মায়ের মুখে শোনা সেই পর্বে আমাদের গোটা পাড়ায় একটি মাত্র টেলিভিশন সেট ছিল।আমাদের পাশের বাড়ি অমর জ্যেঠুদের। জ্যেঠু নাটক,যাত্রা করতেন।এমনকি সিনেমার সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।একাধিক সিনেমার সুটিং তার বাড়িতে হয়েছিল।তারমধ্যে মা নিশিপদ্ম বলে একটি সিনেমার কথা বলত।সেটার সুটিং বোধহয় মা দেখেছিল।
যাহোক, এহেন বিখ্যাত অমর জ্যেঠুর বাড়িতে টিভি থাকবে, তাতে আশ্চর্য কী! কিন্তু আমরা কখনোই সে বাড়িতে টিভি দেখতে যেতাম না।যদিও পুরো পাড়ার মানুষ -বুড়ো থেকে বাচ্চা সবাই যেত।সে এক আশ্চর্য দুনিয়া।আমরা কেবল তার গল্পই শুনতাম।খানিক বড় হবার পর জ্যেঠিমা মাকে ডাকত, যদি উত্তম কুমারের সিনেমা থাকত। যদিও মা কদাচিৎ যেত, তবু সেদিনগুলো ছিল আমাদের কাছে মায়াবী। পর্দায় আমাদের মত মানুষ নাচ গান করছে, কথা বলছে, সে এক অবাক করা দৃশ্য।
আর কখনো কখনো চিত্রাহার দেখা হত।বুধবার হতো বোধহয়।রাত আটটা থেকে।তবে তা দেখার সুযোগ হয়ত ন মাসে ছমাসে একবার মিলত।
অবশ্য টিভি না থাকাটা আমাদের কাছে কোনো বিশাল বিষয় ছিল না।কারন সন্ধা বেলা পড়াশোনা আর তারপর গল্পের বই, তাছাড়া খেলাধুলা, নাচ গান তো ছিলই।আমার মা বলত আমরা তিন মেয়ে নিজেরাই এক একটা এন্টারটেইনমেন্ট। তারজন্য টিভি না দেখলেও চলে।
একবার কোনো এক রবিবার ভালো একটা কোনো সিনেমা ছিল।সিনেমাগুলো বিকেলে হত।পাড়ার সবাই মাটিতে বসে সিনেমা শুরুর অপেক্ষা করছি।হঠাৎ সে বাড়ির ছোটো ছেলে গৌতমদা তার হবু বউ নিয়ে ঢুকল ঘরে।আর এসেই কারোর দিকে না তাকিয়ে টিভির সুইচ অফ করে দিল।সবাই অবাক হলেও মা আমাদের নিয়ে সেই যে উঠে চলে এল,আর কোনোদিন সেখানে টিভি দেখতে যায়নি,জ্যেঠিমা হাজার ডাকা স্বত্বেও।
মার সেদিন প্রচন্ড আত্মসম্মানে লেগেছিল। বলে বন্ধ করতে পারত।কিন্তু কারোর দিকে না তাকিয়ে কোনো কথা না বলে বন্ধ করে দেওয়াটা মা মেনে নিতে পারেনি।
ফলে যতদিন ও পাড়ায় ছিলাম,টি ভি দেখা হয়নি।
আমাদের টিভি এল নিজেদের নতুন বাড়িতে আসার পর। সাদা কালো। বাক্সের ভিতর ঢোকানো।সার্টার খোলা বন্ধ করা যেত।সম্ভবত ৮৮সাল।সেবছর কিংবা তার পরে পরেই শুরু হল
জোছন দস্তিদারের ‘তেরো পার্বণ’। ধারাবাহিক এই অনুষ্ঠানটা দেখার জন্য আগে থেকে পড়া করে নিতাম। ইন্দ্রাণী হালদার, সব্যসাচী চক্রবর্তী, খেয়ালি দস্তিদার,সেই ধারাবাহিক থেকেই রীতিমতো ‘স্টার’ হয়ে গেলেন।সবার মুখে মুখে তাদের নাম।
এরপরে এলো ব্লক বাস্টার হিন্দি সিরিয়াল রামায়ণ, মহাভারত, বুনিয়াদ, হামলোগ।শনিবার আটটা বা নটায়,আর রোববার সকালগুলোয় এক রকম অঘোষিত কার্ফুই জারি হত রাস্তায় রাস্তায়, গোটা পাড়া বসে পড়ত টিভি সেটের সামনে৷ সেখানে তখন পর্দায় বহু বর্ণে দৃশ্যায়িত হয়ে চলেছে তাঁদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং নীতিবোধের আখ্যান৷আমার সেই দুটো দিনই ইংরেজি টিউসন থাকত।ছুটতে ছুটতে বাড়ি আসতাম এই দুটো দেখব বলে।
নিতিশ ভরদ্বাজের কৃষ্ণ তখন মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। তার সেই ভুবনমোহিনী হাসি..আহা!শুনেছি বহু মেয়ের হার্ট থ্রব বেড়ে গেছিল।আর তারসঙ্গে আমাদের ঘরের মেয়ে দেবশ্রী আর রূপা গাঙ্গুলি।
রূপার কোনে সিনেমা না দেখলেও ইতিমধ্যে দেখে নিয়েছি দাদার কীর্তি, ভালোবাসা ভালোবাসা।কাজেই এগুলো ছিল একস্ট্রা একটা আনন্দ।
আর ছিল চিত্রাহার ও বাংলা ছায়াছবির গান।এই সময় টিভি বন্ধ রাখা হত।কারন সেটা আমাদের পড়ার সময়।তবু পড়ার ফাঁকে জল বা বাথরুমের নাম করে একবার উঠে টিভি চালাবার চেষ্টা। অবশ্য বেশিরভাগই ব্যর্থ হত।ভগ্ন মন নিয়ে আবার পড়তে বসা।
আমার মায়ের টিভি দেখার কোনো ইচ্ছা বা ফুরসৎ ছিল না।স্কুল থেকে ফিরে আমাদের আতপ চালের ভাত,ডিম,আলুসিদ্ধ রেঁধে দিয়ে নিজে বাবার সঙ্গে বসে একবার চা বিস্কুট খেত।সেদিন হয়তো বাবা বিকেলের পর অফিস যাবেন।অন্য দিনগুলোয় একাই খেত।তারপরেই সকালে মেলে যাওয়া জামা কাপড় পাট,গাছে জল দেওয়া নিচে নেমেই ছাত্র ছাত্রী পড়ানো।আমি অবশ্য সেখানে না বসলেও মার কড়া দৃষ্টি ছিল যাতে ফাঁকি না মারি।তা আমি ফাঁকি মারতাম না।কেবল পড়ার বইয়ের সামনে কখনো থ্রি মাস্কেটিয়াস,কখনো ওয়ার এন্ড পিস কখনো আনন্দ মঠ,এমনকি দেশ পত্রিকাও থাকত।তখন সুনীলের পূর্ব পশ্চিম পড়তে পড়তে রাতের ঘুম উঠে যাবার উপক্রম। আমাদের বই পড়াট ক্ষেত্রে কোনো বাচবিচার ছিল না।সব রকম বই যা বাড়িতে থাকত তাই পড়তাম।বাবা বলত,পড়ার অভ্যাস থাকাটা জরুরী।অবশ্য নিয়ম করে বাড়িতে আসত শুকতারা,কিশোরভারতী ও আনন্দ মেলা। তাছাড়া বাবাকে দেওয়া উপহার একাধিক লেখক লেখিকার বই তো ছিলই।
তবে বাবার প্রকাশনার কোনো বই কখনো ছুঁয়েও দেখিনি।খুব ভারী মনে হত।
একবার আনন্দ বাজারের পাতায় নিজের নাম দেখে চমকে উঠেছিলাম।আস্ত একটা গল্প বেরিয়েছে আমার নাম দিয়ে।গল্পের নাম মুনাইয়ের দুঃখ।কিন্তু এ গল্প তো আমি লিখিনি।অন্য কোনো বিতস্তা নিশ্চয়ই। ফলে খুব একটা উচ্ছ্বসিত হতে পারছি না।অথচ স্কুলে যাওয়া মাত্র বন্ধু ও দিদিরা বলছে গল্পটা ভালো হয়েছে। কবে থেকে লিখছি,কিভাবে পাঠালাম!আমি সত্যিই জানতাম না এসবের কিছুই। এর কিছুদিন বাদে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটা গ্রিটিং কার্ড আর একশো টাকার চেক,তার সঙ্গে আর একটি গল্প আনন্দ মেলায় মনোনীত হয়েছে জানিয়ে চিঠি। এবার সত্যি অবাক হলাম।কে আমাকে লেখক বানাবার জন্য এমন মিথ্যে অন্যায় করছে!কিন্তু প্রথম গল্পটার সব কথাই আমার বলা।তখন মা বলল,এ নিশ্চয়ই তোর পিসির কাজ।বাচ্চাদের গল্প নিজের নামে লিখবে না,তাই তোর নামে।আমি ভীষণ রেগে গেছিলাম এ কথা শুনে।
পিসির ইচ্ছে হয়েছে নিজে লিখুক,কতই তো লেখে দেশে,আনন্দ বাজারে।আমার নামে কেন!
বাবাও একটু মনোক্ষুণ্ণ হয়েছিল।সম্ভবত পিসিকে বারন করেছিল এমন কিছু না করতে।তারপর থেকে বন্ধ হল।
এত কিছুর পরেও আমার লেখক হবার শখ হয়নি।বা লিখতেও শুরু করিনি। আমি যে আমার পুতুলবাড়ি যার বাসিন্দা দুই বোন,তাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম।আমার সমস্ত জগত জুড়ে তখন কেবল তারাই।