• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দীপান্বিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৫)

ঢেপ্সির প্রেমকাহিনী

পঞ্চম ভাগ

সে রাতের পর থেকে ঢেপ্সিকে এড়িয়েই চলতাম। আমি চাইনি আমার কারণে ওদের সম্পর্কের মধ্যে ভাঙন ধরুক। পার্ট ওয়ান রেজাল্ট আউট হয়ে গেছে। কলেজে রেজাল্ট আনতে গেছি দুপুরের দিকে। ইচ্ছে করেই দুপুরের দিকে গেছি যাতে করে ঢেপ্সির সঙ্গে দেখা না হয়। দোতলায় লেডিস টয়লেট লাগোয়া বারান্দায় দেখলাম ঢেপ্সি ও অজয় বসে বসে গল্প করছে। ওরা আমাকে দেখে ফেলতে পারে এই আশঙ্কায় ওড়না জড়িয়ে বাথরুমে গেলাম। বেরিয়ে দেখলাম ওরা চুম্বনরত অবস্থায়। আমার ব্যাপারটা একটু চোখে ঠেকলো কারণ খোলা বারান্দা থেকে সামনের রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়। লোকজনের যাতায়াত লেগেই আছে।
অন্যসময় হলে আমি ওদের এই ব্যাপারটা বলতাম কিন্তু ঢেপ্সির ব্যবহারের পর আমার বলাটা সাজে না। তাই আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম। রাতে ঢেপ্সির নম্বর থেকে মেসেজ এলো ‘ চোরের মতো আমাদের ফলো করা বন্ধ কর। তোকে দেখিয়েই আমি অজয়কে চুমু খেয়েছি।’ আমি রিপ্লাই দিলাম ‘ তোদের সম্পর্কে নাক গলানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। তুই ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলবি না। আর মনোভাব পরিবর্তন করতে না পারলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দরকার নেই।’ ঢেপ্সির নম্বর থেকে মেসেজ এলো ‘ চল ফোট। তুই কে!? তোর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে আমার কিছুই যায় আসে না। তোকে ব্লক করলাম।’ ঢেপ্সি আদৌও ব্লক করেছে কিনা দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি আমি।
দিন চলছিল। সময় কখনো কারোর জন্য থেমে থাকে না। এখনও মাঝে মাঝে ওর আমার বন্ধুত্বটা মনে পড়লে কান্না আসে। অজান্তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে কিন্তু ঢেপ্সির মতো প্রগাঢ়তা কারোর সঙ্গে হয়নি। এসবের মধ্যেই সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষার অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেল। রোল নম্বর অনুযায়ী সিট খুঁজতে গিয়ে দেখি লাখেচক্রে আমার আর ঢেপ্সির এক‌ই রুমে সিট পড়েছে। আমাকে দেখে ঢেপ্সি হেসে বললো ‘ ভালো আছিস?’ আমি ঘাড় নেড়ে উত্তর দিয়ে চলে নিজের জায়গায় চলে গেলাম। সেবছর জেনারেল পেপারের পরীক্ষা অন্য কলেজে হয়েছিল। আমরা কয়েকজন মিলে গাড়ি ভাড়া করে গেছিলাম। শেষ মুহূর্তে জানতে পারি ঢেপ্সি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। ঢেপ্সি বাকি সবাইকে বলেছিল ও যাচ্ছে শুনলে আমি যাবো না। তাই কেউ আমাকে আগে থেকে কিছু জানায়নি।

গাড়ির মধ্যে ও নিজে থেকেই আমার পাশে এসেবসলো। বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু আমিই এড়িয়ে গেলাম। এতদিন মন গুমরে মরলেও সেদিন ওর সঙ্গে কথা বলতে কেন জানি না আমার একফোঁটা ইচ্ছা করছিল না। বাকি ক’দিন এক‌ই গাড়িতে গেলেও আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতাম তার ফলে আমার সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ থাকতো না।

পরীক্ষার মাসখানেক পর একদিন রাতে ছাদে পায়চারি করছি দেখলাম অজয় ও তার পাঁচ ছটা বন্ধু আমাদের পাড়ার ক্লাব থেকে বেরোচ্ছে। ওরা মদ্যপ ছিল বুঝতেই পারলাম। আমি ব্যাপারটা দেখার জন্য ছাদের কার্নিশের কাছে গেলাম। ওরা রাস্তা থেকে আমাকে দেখতে পাবে না কিন্তু আমি ওদের দেখতে পাবো। অজয়ের ফোনে একটা ফোন এলো। অজয় ফোনটা কেটে দিলো। খানিকক্ষণ পর আবার ফোন। এবার পাশ থেকে ওর একটা বন্ধু বলে উঠলো ‘কোন মাগী এখন ফোন করছে?’ অজয়ের আরেক বন্ধু বলে উঠলো’ ‘আরে ওটা মাগী নয়। মাগীর মাসি বল। আমাদের অজয় আবার ওই মালটাকে ভালোবাসে। বিয়ে করবে।’ সাথে সাথেই সবাই একসাথে হাসিঠাট্টা করে উঠলো। আমার ভীষন রাগ হচ্ছিল ভাবছিলাম নেমে গিয়ে কষিয়ে থাপ্পড় দিয়ে আসি। কিন্তু অজয় চুপচাপ বসে থাকলো। ওদের কিচ্ছু বললো না পর্যন্ত। সিগারেট টানতে আরম্ভ করলো। কিছুক্ষণ পর ওরা চলে গেল। খানিকবাদে অজয় আবার ফিরে এলো তবে একা। আমার বাড়ির উল্টোদিকের বাড়ির বারান্দায় বসে ফোনটা পকেট থেকে বের করলো। কাকে যেন ফোন করলো। তাকে বলছে আমার কাছে পাওয়ার আগে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, গার্লফ্রেন্ড অনেক পড়ে। নিজের স্যাটিসফেকশনের বিনিময়ে আমি কোনো কিছুর সঙ্গে আপোস করতে রাজি ন‌ই। তারপর আবার চুপচাপ। খানিক বাদে ওর ফোনে একটা ফোন এলো। ফোন ধরেই চিৎকার করে বলতে শুরু করলো ‘ধ্যার বিরক্ত করিস না। ফোন রাখ। সবসময় এতো খোঁজ নেওয়ার কিছু নেই। গার্লফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের মতো থাকবি। ব্যক্তিগত ব্যাপারে বেশি মাথা গলাবি না। ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ কর। নিজের মতো থাক। আমাকে আমার মতো থাকতে দে। না তো বেরিয়ে যা আমার লাইফ থেকে। বেরিয়ে গিয়েও বা কী হবে!? কে তোকে ঘরে নেবে? তোর চেহারা দেখেছিস কখনো!? চল্ ফোন রাখ। আর এখন একদম বিরক্ত করবি না। তোর বান্ধবীর বাড়ির সামনে আছি। আমাকে তুই আর একবার ফোন করলে ওকে চিৎকার করে ডাকবো। তারপর ওর বাড়ির লোক কিছু বলতে এলে তোর নামে যা ইচ্ছে বলবো। যদি ফাঁসতে না চাস ফোন করিস না।’ এসব শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আশ্চর্য ছেলে তো! ঢেপ্সি এরকম একটা ছেলেকে ভালোবাসে!? বেচারার কপালে কষ্ট আছে।
সে রাতের পর থেকে আমার মনটা খচখচ করতে শুরু করে। ঢেপ্সির সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। কিন্তু ও যদি আমাকে ভুল বোঝে!? পরেরদিন সকালে টিউশন গেলাম। রিমার ফোন থেকে ঢেপ্সিকে ফোন করলাম।‌ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ‘ঢেপ্সি কাঁদতে শুরু করলো। তারপর বললো কলেজ আসিস দেখা হবে।’ রিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলো কেসটা কী বলতো? ঢেপ্সিকে কিছুদিন ধরেই মনমরা দেখছি। ও আর আগের মতো মনখুলে কথা বলে না। খুব কম কথা বলে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।রিমাকে সবকিছু খুলে বললাম। ও বাড়ি চলে গেলো।
কলেজের লাইব্রেরীর রিডিং রুমে অপেক্ষা করছি। ঢেপ্সি এলো। এসেই শুরু করে দিলো চোটপাট। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেরে দিল একচড়। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ঘরভর্তি সকলের সামনে ঢেপ্সি চিৎকার করে বলছে ‘তুই কেন এমন করছিস? অজয় রাত এগারোটার সময় তোর বাড়ির সামনে কী করছে? ও তোর বাড়ির সামনে ছিল বলেই আমাকে এড়িয়ে গেলো। নোংরা মেয়ে একটা তুই। আমি ভেবেছিলাম তোর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করে নেবো, সরি বলবো। আর তুই কিনা আমার অজয়ের দিকে নজর দিয়েছিস?’ আমি যত‌ই ওকে বোঝাতে শুরু করলাম এরকম কিছুই নয় তত‌ই ও চিৎকার করতে শুরু করলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে লাইব্রেরীর রিডিং রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।

বেরিয়েই দেখি অজয় দাঁড়িয়ে। অজয়কে দেখে ঢেপ্সি আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। অজয় ঢেপ্সিকে শান্ত গলায় বললো দীপুকে নিয়ে মাঠে আয়। আর একটা কথাও তুই ওকে বলবি না। যা বলার আমি বলবো। আমি যেতে চাইছিলাম না। অজয় রিকোয়েস্ট করলো তাই শেষপর্যন্ত গেলাম। অজয় ঢেপ্সিকে একটা প্রশ্ন করলো ‘তুই দীপুকে মারলি কেন?’ ঢেপ্সি বললো ‘ওই খালপাড়ের মেয়েটা তোর থেকে আমাকে কেড়ে নিতে চাইছে।’ অজয় শান্ত ভাবে বললো ‘ তুই শান্ত হ। কেউ তোর থেকে আমাকে কেড়ে নেয়নি। তুই ভুল ভাবছিস। আমি রাজনীতি নিয়ে খুব চাপে আছি। তোকে সময় দিতে পারছি না। তার মানে এটা নয় তোর বান্ধবীর সঙ্গে আমি প্রেম করছি’। এবার আমি বললাম দ্যাখো অজয় দা তোমার সঙ্গে ঢেপ্সির কী হয়েছে আমি জানি না। আজ সকালে ওকে এমনিই ফোন করেছিলাম তাতে ও খেপে গিয়ে এসব বলতে শুরু করলো। যদিও আমি বেমালুম চেপে গেলাম গতকাল রাতে আমি অজয় ও তার বন্ধুদের দেখেছি সেই বিষয়টা। ঢেপ্সি আঙুল তুলে বললো ‘তোরা থাম। দীপু অজয় গতকাল তোর বাড়ির সামনে থেকে আমাকে ফোন করে হুমকি দিয়েছে। আর আজ সকালে তুই ফোন করলি?’ আমি বললাম ‘আমি এসব কিছুই জানি না। তোদের ব্যাপার তোরা মিটিয়ে নে। আর হ্যাঁ অজয়দা শোনো একটা কথা বলি রাজনীতি করলেও গার্লফ্রেন্ডকে সময় করে ফোন করা যায় একটু আধটু। ওর বাড়িতে ওকে সবাই ব্যঙ্গ তামাশা করে। ও তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। তাই হয়তো ভাবে তুমি ওকে অ্যাভোয়েড করছো।ও মোটা বলে এড়িয়ে যাচ্ছো। ওকে আর ভালোবাসো না। এগুলো তোমাকেই মেটাতে হবে। তোমরা ভালো থেকো। আসছি।’ অজয়দা বললো একমিনিট দাঁড়াও। তারপর ঢেপ্সিকে উদ্দেশ্য করে বললো ‘ তোকে আমি ভালোবাসি। হ্যাঁ প্রথম প্রথম তোর সঙ্গে সমস্যা হতো। তাই ভেবেছিলাম অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো। কিন্তু আমি এই দেড় বছর পর বলছি আমি তোকেই ভালোবাসি। তুই ওসব ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে চল। আমি তোকে কখনো ছেড়ে যাবো না।’ আর দীপুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। ওর যে পাড়ায় বাড়ি সে পাড়ার ক্লাবে আমার যাতায়াত আছে। তাই ওদের বাড়ি চিনি। ওর সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে নে। কিন্তু ঢেপ্সি গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম। আসতে আসতে শুনতে পেলাম অজয়ের সঙ্গে ঢেপ্সির ঝামেলা শুরু হয়েছে। আমি ফিরে তাকালাম না। সোজা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কলেজ থেকে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *