• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ৬)

শূন্যকাননের ফুল

৬। জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসো রাজা

‘তুই কেন এসবের মধ্যে যাচ্ছিস জারা? তোকে ওরা শেষ করে দেবে। আমার কথা শোন। তুই এটা থেকে বেরিয়ে আয়’
জারা ব্যালকনিতে বসে ছিল, হাতে কফির কাপ। মা-ই দিয়ে গেছে একটু আগে। আর চুমুক দিতে দিতেই এসে হাজির হয়েছে জ্ঞান দিতে। জম্পেশ করে কাপটা দুহাতে ধরে সকালটাকে উপভোগ করছিল সে। মার কথায় কফিটা তেতো লাগল তার। বাকিটা এক চুমুকে শেষ করে মার দিকে চাইল জারা। কেটে কেটে বলল ‘আমাকে একরকম করে বাঁচতে শিখিয়ে এখন আবার অন্য কথা বলছ কেন মা? আমার পক্ষে অন্য রকম হওয়া সম্ভব কি আর? তুমিই বল’
মা এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে ব্যালকনির অন্য মোড়াটা টেনে বসল। মার বসার ভঙ্গি দেখে মনে হল অনেক কিছু বলবে, মানে অনেক সময় লাগবে বলতে। জারা কয়েকদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে বটে, তা বলে তো ওর হাতে প্রচুর সময় আছে, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। একটু পরেই ব্রেকফাস্ট সেরে ও বেরোবে। আর্থেনিয়ায় পৃথিবীর মতো আইন আদালত কিছু নেই। ওতে নাকি সময় নষ্ট ছাড়া কিছু হয় না। সেন্ট্রাল হাব যদি কাউকে অপরাধী মনে করে, সোজা তাকে ধরে জেলে পুরে দেবে, আর তার শাস্তি হিসেবে রয়েছে ফার্স্ট ডিগ্রি মেমরিপ, সেকেন্ড ডিগ্রি মেমরিপ, থার্ড ডিগ্রি মেম রিপ। মেমরিপ আর কিছুই নয়, মেমরি বা স্মৃতিকে চেঁছে তুলে দেওয়া। কতটা তোলা হচ্ছে, তার ওপর ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড ডিগ্রি । আইন আদালত নেই, তবে একটা নাম কা ওয়াস্তে জাস্টিস সেল আছে, আসামীর আত্মীয় বন্ধুরা সেখানে অভিযোগ জানাতে পারে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকটি সিটিং হবে। পুলিশ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি আর সমাজের কয়েকজন বিশিষ্টজনকে নিয়ে। যদিও সবাই বলে পাপেট মিটিং, তবু প্রাথমিক ভাবে সেখানেই কমপ্লেন লজ করবে জারা। তাতে একটা সুবিধে হচ্ছে, যতদিন না জাস্টিস সেলের ফাইনাল মিটিং-এ ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি হচ্ছে, ততদিন নোয়াকে কোন শাস্তি দেওয়া যাবে না। আর এই সময়ে জারা তার প্ল্যান অব অ্যাকশন সাজিয়ে নিতে পারবে।
জারার চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল মার একটা কথায়। মা হঠাৎ বলল ‘জারা , আমরা সামনে যা দেখি, সবসময় তা সত্যি নয়। আড়ালে হয়তো অন্যকিছু’ শুনেই মাথা গরম হয়ে গেল জারার। সে বলল ‘শোন মা, আমি লোক চিনি। নোয়া খুব ভালো ছেলে। ও এ কাজ করতেই পারে না। ওকে ফাঁসানো হয়েছে’
‘আমি তা বলিনি জারা। আমি বলছি যে রেপ অ্যান্ড মার্ডার কেস নিয়ে এত তোলপাড়, সেটা কি আদৌ সত্যি? মারিওভা কফি জয়েন্টের ওয়েট্রেসের সাক্ষ্য ছাড়া কি প্রমাণ আছে বলতো? আর মারিওভায় মিকি টকিহাউসের শেয়ার রয়েছে এ কথা ভুললে চলবে না’
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল জারা।
‘তার মানে বলতে চাইছ পুরো ব্যাপারটাই সাজানো? কিন্তু আমি যে নিজের চোখে দেখলাম বডিটা পড়ে আছে’
‘দেখেছিস, কিন্তু আর্থেনিয়ার সি.এইচ. লোগো দেওয়া কাপড়ে পুরো ঢাকা, ওর মধ্যে সাপ ব্যাং কী আছে কে বলতে পারে?’
‘কিন্তু মা, যে রেপ নিয়ে আর্থেনিয়ায় এত ঢাকঢোল, সেই রেপকে এভাবে ইউজ করতে চাইছে রাষ্ট্র? এ তো ঘৃণ্য ব্যাপার’
‘শোন জারা, পৃথিবীতে একজন কবি ছিলেন সেকালে, রবি ঠাকুর নাম, তিনি একজায়গায় লিখছেন – সিংহ সনে নখ দন্তে নহে কো সমান / তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ কোন নর লজ্জা পায়?’
জারা এক বিন্দুও বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইল
‘মানে!’
‘মানে কিছু পাওয়ার জন্যে যেকোন উপায় অবলম্বন করা। রাষ্ট্র একটা কিছু পেতে চাইছে, তার জন্যে ওরা যেকোন পথ ব্যবহার করবে, সেখানে ন্যায় নীতির কোন জায়গাই নেই’
‘বুঝলাম। কিন্তু লক্ষ্যটা কী?’
‘আপাতত মনে হচ্ছে বাইরের লোককে খেদানো। আরও কিছু থাকতে পারে, এখনি বুঝতে পারছি না’
হঠাৎ একটা কী মনে পড়ে গেল জারার। জানো মা, নোয়া কোথা থেকে এসেছে?’
‘পৃথিবী, আবার কোথায়? ‘
‘পৃথিবী তো অনেক বড় মা। নোয়া এসেছে আজবনগর থেকে’
এটা বলে ফেলেই জিভ কাটল জারা। মা বুঝে যাবে ইচ্ছাময়ীর ডায়েরিটা ও পড়েছে। মা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, জারাও হেসে ফেলল, ধরা পড়ে যাওয়ার হাসি।
বকুনি দেবার বদলে মা বলল ‘ আচ্ছা, আজবনগর, ফুল ফোটানো, ইচ্ছাময়ীর ডায়েরির সঙ্গে কী অদ্ভুত মিল তাই না?’
‘আমিও কদিন ধরে তাই ভাবছিলাম মা। তুমি আমাকে ছোটবেলায় বলতে যে মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে।’
‘এখানে যোগসূত্রটা কী বলতো? ফুল’
‘ফুল!’ অবাক গলায় বলে জারা
‘হ্যাঁ। কেউ বা কারা চায়না আর্থেনিয়ায় ফুল ফুটুক। হোক শূন্যে, তবু ফুল তো। ফুল তাদের কাছে একটা থ্রেট, বিপদ’
‘কী বলছ মা, ফুল কেন থ্রেট হতে যাবে? একটা সুন্দর জিনিস।’
‘একটু তলিয়ে ভাব। আর্থেনিয়ায় এর আগে কেউ কখনো ফুল ফোটায় নি। ফুল নিয়ে মানুষের চিন্তা অবদমিত ছিল। কিন্তু এখন আর থাকবে না। অনেকেই তো ইতিমধ্যে নোয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কেউ কেউ ফুল কিনে এনে ঘর সাজাবে, কিন্তু বেশির ভাগ লোকই চাইবে নিজের বাগান তৈরি করতে। নিজের বাগানে ফুল ফুটতে দেখার আনন্দই আলাদা।’
‘তাতে কী হল?’
‘তাতে এই হল যে, আর্থেনিয়ার লোকগুলোকে যে ভাবে সেন্ট্রাল হাব বেঁধে রেখেছে, তা আর থাকবে না। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ইচ্ছে নিয়ে চলবে, সেন্ট্রাল হাবের শাসন আর খাটবে না’
‘বাব্বা! ফুল থেকে এত! সামান্য ফুলের এত শক্তি!’
‘ফুল সামান্য নয় জারা। যারা ফুল ফোটায় তারা যেমন সামান্য নয়, আবার যারা ফুল ফোটাতে বাধা দেয়, তারাও’
জারার দেরি হয়ে যাচ্ছিল, সে উঠে চট করে একটা বাইরের ওভারঅল পরে নেয়, আজ আর মা তাকে নিউট্রাল মোড অন করার কথা বলে না। তবে অ্যান্টি গ্র্যাভিটি বেল্টটা পরার কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা পরতে পরতে চোখে জল এল জারার। মনে পড়ে গেল কীভাবে নোয়া তার প্রান বাঁচিয়েছিল। এই বেল্টটা পরা না থাকায় সে পা ফসকে পৃথিবীতে আছড়ে পড়তে যাচ্ছিল। নোয়ার সেই স্পর্শ, তার ফোটানো ফুলের মতই সে ভুলবে না কোনদিন। কে সে লোক, যে চায় না আর্থেনিয়ায় ফুল ফুটুক?
এরো স্কুটিতে স্টার্ট দিতে দিতে সে পেছন ফিরে মাকে জিগ্যেস করল ‘মা, এমন কাউকে দেখেছ যে ফুল ভালবাসেনা?’
‘শুধু ভালবাসেনা নয়, রীতিমতো ভয় পায়।’
‘কে?’
‘সেন্ট্রাল হাবের চিফ’
‘চিফ একজন রিয়েল! সত্যি মা? সবাই যে বলে চিফ বলে কেউ নেই। ওটা একটা প্রোগ্রাম’
জারার মা বিড়বিড় করে ‘চিফ আছে। আমার থেকে বেশি কেউ জানে না সে কথা। আর আমি চাইনা জারা তুমি চিফের ত্রিসীমানায় যাও’
মা কী বলছে জারা শুনতে পায় না। তার মাথায় শুধু ঘুরতে থাকে চিফ বলে একজন সত্যি সত্যি আছে!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।