• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ৪)

শূন্যকাননের ফুল

৪| ইচ্ছাময়ীর ডায়েরি

ডায়েরিটা অনেক কষ্টে পাওয়া গেছে। জারা মাকে লুকিয়ে বার করেছে আলমারি থেকে। মার জামা কাপড়ের নিচে লুকনো ছিল। আর পড়ছে। এত পুরনো ভাষা, তারপর কাগজে হাতের লেখা, ভালো বুঝতে পারছে না, তবু ছাড়তেও পারছে না। কি এক অমোঘ আকর্ষণে পড়ে চলেছে।
এটা মার কোন এক ঊর্ধবতন মাতামহীর ডায়েরি। মানে মার মার মার মা…. ডায়েরিতে সাল তারিখ কিছু নেই। আর মাকে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না কারণ এটা মা ভীষণ লুকিয়ে রেখেছে। তবে জারা এটুকু আন্দাজ করতে পারে ডায়েরিটার বয়স পাঁচশ বছরের কম নয়। যিনি লিখছেন তাঁর নাম ইচ্ছাময়ী। সেসময় মানে ২৫৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে মেয়েদের এমন নাম হত না, সেটা জানে জারা। তাই মনে হয় এটা তাঁর ছদ্মনাম। ডায়েরির শুরুতেই ইচ্ছাময়ী জানাচ্ছেন ডায়েরি লেখা পৃথিবী থেকে প্রায় উঠেই গেছে। তার প্রধান কারণ কাগজের দারুণ অভাব, তাছাড়া নিজের অনুভব গুলো এভাবে গোপন রাখার মানসিকতা এখনকার মানুষের প্রায় নেই। সবাই সব কিছু সকলকে জানাতে চায়। কিন্তু তাঁর এসব ভালো লাগে না। তাছাড়া তাঁর জীবনে এমন কিছু কথা আছে, যা একমাত্র ডায়েরিকেই বলা যায়।
ডায়েরি থেকে জারা জানতে পারছে ইচ্ছাময়ী ছিলেন একজন স্বনির্ভর নারী, নিজের ভরণপোষণ তো বটেই, এমনকি সন্তান ধারণের জন্যেও তিনি কোন পুরুষের ওপর নির্ভর করেননি। তখন অবশ্য এমনটাই চল ছিল। প্রচুর সংখ্যক মেয়ে এবং ছেলেও বিয়ে না করে সিংগল পেরেন্ট হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও পরের শতকে এসে এই চিন্তাধারা আর অত আধুনিক ছিল না। কারণ আধুনিকের সংজ্ঞাটাই তো পালটে গিয়েছিল, আধুনিকতা মানে হুজুগে গা ভাসানো নয়, যেটা করে নিজে কম ফর্টেবল থাকা যায় সেটাই আধুনিকতা। গবেষণা দেখিয়েছিল সিংগল পেরেন্টদের বাচ্চাদের মধ্যে ক্রাইসিস বেশি। তো যাই হোক, ইচ্ছাময়ী যে যুগের মানুষ সে সময় সিংগল পেরেন্টিংই ক্রেজ, সেই হাওয়ায় গা ভাসিয়ে ইচ্ছাময়ীও পুরুষসঙ্গীহীন পরিবারের দিকে ঝুঁকলেন, তিনি আর তাঁর মেয়ে – ছোট্ট সংসার। তিনি কাজে যান, মেয়েটি স্কুলে, বাকি সময়টা নানান চাইল্ড কেয়ার অ্যাপ মেয়ের দেখভাল করে।
বেশ চলছিল। হঠাত ইচ্ছাময়ীর শখ জাগল বাড়িতে এক টুকরো ফুলের বাগান করবেন, তাঁর ছোট্ট মেয়ে ডাহুক, বাগানে খেলে বেড়াচ্ছে এই ছবিটা তাঁর চোখের সামনে ভাসতে লাগল। কিন্তু পৃথিবীতে মাটির বড় আকাল। মাটি ছাড়া জল ছাড়া ফুল ফোটানোর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে বটে, কিন্তু তা এখনও সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে আসেনি। খুব বড়লোক ছাড়া বাড়িতে কেউ ফুল ফোটাতে পারে না। তবু শখ বলে কথা। ইচ্ছাময়ী টাকার মায়া না করে, শহরের সবচেয়ে নামকরা মালীর দোকানে সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যে সেখান থেকে এসে হাজির হল যে যুবকটি, তাকে দেখে জীবনে প্রথমবার বুক কাঁপল ইচ্ছাময়ীর। জেনেটিক্যালি নিখুঁত অপূর্ব সুন্দর নারী পুরুষ বানাবার এখন একটা প্রতিযোগিতা চলছে, কিন্তু তাদের বুকে একটা ব্যাজ লাগানো থাকে জি.এম. অর্থাৎ জেনেটিকালি ম্যানুফ্যাকচার্ড। একে দেখে বোঝা যাচ্ছে, এ তা নয়। কোন স্বাভাবিক মানুষ এত সুন্দর হতে পারে? বিস্ময়ের ঘোর কাটে না ইচ্ছাময়ীর। ডায়েরির ছত্রে ছত্রে সেই বিস্ময়, মুগ্ধতা আর উচ্ছ্বাস। সঙ্গে বেদনার সুরও গোপন থাকে না। কারণ ইচ্ছাময়ী উচ্চশিক্ষিত,ভালো চাকরি করেন, আর এই ছেলেটা, যতই গবেষণা করে ফুল ফোটাক, লোকে তো মালীই বলবে শেষ অব্দি। তাছাড়া ইচ্ছাময়ীর প্রতিজ্ঞার কি হবে? পুরুষ ছাড়াই একটা জীবন কাটিয়ে দেবার সঙ্কল্প? তবু দমকা হাওয়ায় যেমন শুখনো পাতা উড়ে যায়, তেমনি উড়ে গেল ইচ্ছাময়ীর সব সঙ্কল্প। ডায়েরিতে তিনি লিখলেন, পরের দিন রবিবার। জিয়ান (হ্যাঁ ছেলেটার নাম ওটাই) বাড়িতে আসবে। কাজ শেষ হয়ে গেছে, পাওনা নিতে। আর তখনি তিনি ওকে মনের কথা খুলে বলবেন। ওর ফোটানো ফুল দিয়েই ওকে প্রেম নিবেদন করবেন। পরদিন ভোরে উঠে সোজা বাগানে চলে যান। বাগান থেকে বেছে বেছে হলুদ আর লাল ফুল তুলে তড়া বাঁধেন। তোড়াটিকে সযত্নে সরিয়ে রাখেন মেয়ের দৃষ্টির আড়ালে। মেয়ে ডাহুক, যদিও খুব ছোট, কিন্তু ইচ্ছাময়ী চান না ও এখনি কিছু জানুক। ব্রেকফাস্ট সেরে ডাহুককে রুট স্কুলে ছাড়তে যান। সভ্যতা যত এগিয়েছে, তত দেখা গেছে পৃথিবীটা একরকম হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীর লোক এক খাবার খায়, এক জামা পরে, একরকম গান শোনে, এক সিনেমা দেখে, প্রায় এক ভাষায় কথা বলে। বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা যেসব স্কুলে পড়ে। সেখানে এসব শেখানো হয় না। তাই সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়েছে রুট স্কুল মুভমেন্ট, রবিবার রবিবার এই স্কুল বসে , যেখানে নাচ গান নাটকের মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতির শেকড়ের সঙ্গে বাচ্চাদের পরিচয় ঘটানো হয়। ডাহুক রবিবার করে এমন একটা স্কুলে যায়। সেখানে পৌছে দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসেন ইচ্ছাময়ী। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করেন। আয়নায় দেখেন নিজেকে। সোনালি গম রঙা মসৃণ ত্বক, সুগোল স্তন, নাভির ঘূর্ণি, সোনালি বদ্বীপ – কোন পুরুষের স্পর্শ পায়নি আজও। জিয়ানের মতো কারো অপেক্ষা ছিল হয়তো।
স্নান সেরে হলুদ আর পার্পল মেশা অফ শোল্ডার ফ্রক পরেন, সারা গায়ে ছড়িয়ে দেন সুগন্ধি। এই সুগন্ধিটা রুট স্কুল থেকে কেনা, প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে ভেজা মাটি যে সুগন্ধ ছড়ায়, এটা অবিকল সেইরকম।
গেট খোলাই ছিল। জিয়ান কখন ঢুকে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারেননি। হঠাৎ গায়ের কাছে ফুল আর পৌরুষের মাখামাখি সৌরভে চমকে উঠে ইচ্ছাময়ী দেখলেন জিয়ান এসেছে। তাঁর যে কি হল হঠাৎ!
ডায়েরিতে লিখছেন-
‘কি যে হল আমার এত কাছে জিয়ানকে পেয়ে। আমি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠোঁটে অবিশ্রান্ত চুমু খেতে লাগলাম, ওর হাতটা আমার বুকে টেনে চেপে ধরলাম আর বলে চললাম ‘লাভ ইউ বেবি। টেক মি, টেক মি’
জিয়ান প্রথমে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, মনে হচ্ছিল আমার আদরে গলে যাচ্ছে। কিন্তু দ্রুত সে নিজেকে সামলে নিল, আর আমাকে হতচকিত করে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল।
‘বলল, ছি ম্যাডাম। কি করছেন? এরকম করলে আপনার নামে রিপোর্ট করতে বাধ্য হব। আমি এখানে কাজ করতে এসেছি। তাছাড়া আমি এনগেজড। আমার গার্লফ্রেন্ডের নাম শিরিশ। আমি আর ও দুজনে মিলে এই ফুলের বুটিকটা চালাই।
সোফার হাতাটা চেপে আমি নিজেকে সামলাচ্ছিলাম। প্রথমে আমার নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল খুব, তারপর সেই রাগটা গিয়ে পড়ল জিয়ানের ওপর। কোথায় আমি, কোথায় শিরিশ। ফুলের দোকানের ওই পুঁচকে মেয়েটা আমাকে হারিয়ে দেবে! আমি সহ্য করতে পারছিলাম না আমার এই পরাজয়। আমি ওদের শেষ করে দেব। তখুনি আমার মাথায় চিড়িক করে উঠল একটা চিন্তা। জিয়ানকে বললাম ‘আই আম রিয়েলি সরি জিয়ান’ ওকে টাকা মিটিয়ে বিদায় করে আমি, লিখতে লজ্জা হচ্ছে, আমার ফ্রকটা টেনে টেনে ছিঁড়লাম, বুকের কাছে নিজের নখ দিয়ে আঁচড়ের গভীর দাগ তৈরি করলাম, তারপর, ওম্যান সেলে ফোন করে বললাম, আমাকে রেপের চেষ্টা করা হয়েছে, করেছে ‘সে ইট উইথ ফ্লাওয়ার’ বুটিকের জিয়ান।
আমি যা চেয়েছিলাম তাই হল, জিয়ানের চার বছরের জেল হল। শিরিশ ওকে ছেড়ে চলে গেল, ফুলের বুটিকটা উঠে গেল। কিন্তু আমি সুখী হতে পারলাম কই? জেল থেকে ছাড়া পাবার পর জিয়ান কোথায় গেছে জানার জন্য কি না করেছি। খুঁজে পাইনি। মেয়ে বড় হয়ে নিজের মতো থাকে। আমি একা। হঠাৎ এত বছর পর এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম, জিয়ান এখন আজবনগরে নতুন নতুন ফুল ফোটানোর চেষ্টা করছে। আজবনগর কোথায় আমি জানি না। শুধু জানি, সেখানে আমায় যেতে হবে, যত শিগগির সম্ভব।
এর পর ডায়েরিতে আর কোন এন্ট্রি নেই। জারা ডায়েরিটা কোলে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। নোয়া কি যেন বলেছিল ফুলটার নাম, আজবনগরের গোলাপ!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।