সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্ঘ্য রায় চৌধুরী (পর্ব – ৮)

মুনকে লেখা চিঠিগুলোর থেকে

(আট)

মুন,
আমার প্রবাস জীবনের সব কথাই তোমাকে জানাতে ইচ্ছে করে।সেইসব দিনগুলোতে ছিলেনা তুমি, কিন্তু কোথাও যেন তোমারই অপেক্ষা ছিল।সহ্যাদ্রীর সেসব দিনগুলো আমার যেভাবে কেটেছিল।আজ শহরে বসে সেসব কথা ভাবলে স্বপ্নের মত মনে হয়।কি জানি কেমন আছে বিঠঠল? আমার সেই কিকউয়ী গ্রাম? সহ্যাদ্রীর সেই গভীর বন।
পুনে গেছিলাম আজ থেকে পাঁচ বছর আগে।পুনে শহরটা আসলে একটা ভ্যালির মত, চারিদিকেই পাহাড় আর টিলা।ওখানে একটা ভালো চাকরিও পেয়ে গেলাম।একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম ইন্দিরানগরে।ইন্দিরানগর জায়গাটা সোয়ারগেট থেকে একটু দূরে।সোয়ারগেট হল কলকাতার এসপ্ল্যানেড অঞ্চলের মত একটা জনবহুল জায়গা।
তার একটু দূরেই ছিল পন্ডিত ভীমসেন যোশীর বাড়ি।এক দুপুরে ওনার বাড়িতে গেছিলাম।শান্ত একটা পাড়া, বাড়িটার চারিদিকে পাঁচিল, পাঁচিলের গায়ে লেখা “কলাশ্রী”।ওই বাড়ির চারপাশে যেন সুর তার সমস্তটুকু সৌন্দর্যটুকু নিয়ে এখনও নদীর মত বয়ে চলেছে।
পুনে শহর ঘুরতে আমার বেশিদিন লাগল না।জানোই তো আমার পায়ের তলায় সর্ষে।বহুবার পলাতক আমি ছোট থেকেই।শান্ত বলে সুনাম আমার কোনওদিন ছিলনা।এখন যে আমাকে দেখ, সে কিছুটা শান্ত হয়ে গেছে, কিন্তু ঘর ছেড়ে কোথাও যেতে বললে সে এখনও একপায়ে খাড়া।
আমি পুনে শহরে একা একা ঘুরে বেড়াতাম।কলিগরাই বন্ধু ছিল, ওদের থেকে সহ্যাদ্রী যাওয়ার খোঁজ খবর নিতাম, কিন্তু কেউ বিশেষ উৎসাহ দেখাত না।তাই এক সকালে আমি একাই বেরিয়ে পড়লাম।কাতরাজ দিয়ে একটা টানেল পার হয়ে এন.এইচ ফোর।তারপর সোজা রাস্তা চলে গেছে সহ্যাদ্রীর পথে।একটু এগোলেই পরে খেড়শিবাপুর টোল নাকা।আমরা এখানে যাকে টোল ট্যাক্স বলি।তারপর আরো আট কিলোমিটার গিয়ে নসরাপুর ফাটা, ফাটা মানে মারাঠি ভাষায় ফটক।আসলে ওটা একটা তিন রাস্তার মোড়, কোন ফটক বা গেট ওইখানে নেই।ওটাই পুনে থেকে কাতরাজ পার হলে সহ্যাদ্রীর প্রথম প্রবেশদ্বার।
তারপর দুদিকে হালকা বন শুরু হল, সেই বন ক্রমশ ঘন হতে হতে নিঝুম।দিনের বেলাতেও ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসে।তারপর ওই যে নীরার ওপর দুনম্বর কাঠের ব্রীজ, সেটা পার হয়ে তুমি সহ্যাদ্রীর ভেতর ঢুকে গেলে।বন থেকে একঝলক টাটকা বাতাস বয়ে এল।চোখ জুড়ানো সবুজ, দিগন্তরেখায় যতদূর দৃষ্টি চলে পরপর পাহাড়ের সারি।চারপাশে শিবাজির চারটে দূর্গ।রাজগড়, পুরন্দর, তোর্ণা আর সিংহগড়।আর ওই বিস্তীর্ণ উপত্যকায় দু একটা পাহাড়ি গ্রাম।শিব্বারাওয়ের বিখ্যাত মাওয়ালি সৈন্য এইসব গ্রাম থেকেই সংগৃহীত হয়েছিল।
মাওয়ালী গ্রামগুলো জলরঙে আঁকা ছবির মত সুন্দর।সেইসব গ্রামের মানুষেরা সহজ সরল, মনে কোন ঘোরপ্যাঁচ নেই।পুরুষেরা নির্মেদ পেশীবহুল সুঠামদেহী, মেয়েরা ভাস্কর্যের মতো সুন্দর।কষ্টিপাথরের মতো গায়ের রং, কর্মঠ ও শক্তিশালী।
মাওয়ালীরা প্রচণ্ড স্বাধীনচেতা, প্রবল সাজাত্যাভিমানী, গর্বিত ও সত্যিকারের সাহসী একটা জাত।এখনও ওইসব বন পাহাড়ে কান পাতলে জিজাবাই আর শিব্বারাওয়ের কথা শোনা যায়।জিজাবাইকে ওরা জিজামাতা বলে।
আমি ওই বন পাহাড়ে একা একা ঘুরে বেড়াতাম।নিস্তব্ধ দুপুরে শনশনে হাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই।মাঝে মাঝে পাখির ডাক শোনা যেত।নির্জন দুপুরের বাঙ্ময় বন তখন আমাকে একা পেয়ে অস্ফুটে কথা বলে চলত, আর আমি সেই বনের একাকী আলাপচারিতার সঙ্গী হয়ে উঠতাম, বনের যে কত কিছু বলার থাকে।পাহাড়ের ওপর থেকে ভেসে আসত ময়ূরের ডাক।বনমোরগের আওয়াজ।আর ওই বন যেন ঘুম ভেঙে উঠে আমাকে আপ্যায়ন করে বসাত তার ঘরে।
যখন বর্ষা আসত, তখন সমস্ত বন নববধূর সাজে সেজে বৃষ্টির প্রতীক্ষায় থাকত।সমস্ত আকাশ ঢেকে যেত মেঘে।বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ত, আর বন, প্রেমিকের প্রথম স্পর্শের মতো শিহরনে কেঁপে উঠত।
ধীরে ধীরে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে গেলে বন পাহাড় ক্রমশ আরোই নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে আসত।কথা বলে চলত শুধু বৃষ্টি।

চন্দ্রতাড়িত।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।