• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবহ শ্রী সুতনু হালদার বিরচিত (পর্ব – ৮)

আলাপন

(আত্মজৈবনিক কাব্যোপাখ্যান)

(৩৫)
এই সময়টার একটা প্রকৌশলী ভাবাবেগ বাতাসে মিশে আছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে এমন বৃষ্টিপাত অনেকদিন দেখিনি! কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এবার হচ্ছে! আমার চোখে বৃষ্টিকণাগুলো গাছের শেকড়ের প্রতিশব্দের মতো ধরা পড়ছে।
অনেকদিন পর আজকে আবার স্কুল গেলাম। এখন আনলক ওয়ান। স্কুলের বাচ্চাগুলোর অভিভাবকদের মিড ডে মিলের চাল-আলু বিতরণের সময় বৃষ্টি এলো। অনেক বৃষ্টি শরীরের থেকে মনকে বড় বেশি ভিজিয়ে দ্যায়! আজকাল তো অসামাজিকতার যুগ…দূরত্বের গহীন ব্যঞ্জনবর্ণে অবলীলায় গা ভাসিয়ে চলাটাই এখন নিয়ম। সময় বিশেষে সেখানই ঘুণ পোকা হেঁটে চলে…
বাড়ি ফিরে আসার পর থেকে শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিল। আমার চারিধারে যে সমস্ত বৃষ্টির ছোঁয়া থাকে, তারা আমাকে দূর থেকে দেখছে; স্নান করে দরজা-জানলা সব খুলে দিলাম। তবুও বৃষ্টিকণারা ভেতরে এলো না। বুঝলাম ওরাও অসামাজিক হয়ে গিয়েছে। মনের ভেতর যে শেকড় আজন্মকাল ধরে রাজত্ব করে তার থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যায় না।
দুপুরে গোলমরিচ দিয়ে কড়া করে এককাপ লিকার চা খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম। সূর্যকে নিজের আঁচলে ঢেকে রেখে মরুদ্যানের সন্ধান করা মেঘরাশিকে দেখে মনে হ’ল, অষ্টাদশী যুবতি নারীর আড়ষ্টতা নিয়ে আজন্মের কৌতুহলকে অবলীলায় ওরা বৃষ্টির আকারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি জানলা বন্ধ করার সাহস পেলাম না। বৃষ্টি এক সময় কমে গেল। আলো ফুটে জন্ম নিল নবজাতক। আমার বিষন্নতা বিকেল থেকেই স্যানিটাইজড…
নিশুতি পূর্ণিমায় বোধিবৃক্ষের নীচে ধ্যানমগ্ন মন গ্রহণ করল পায়েসান্ন…
(৩৬)
ওই যে পথটা সোজা চলে গিয়েছে, সে আমাকে একদিন খুব সহজ একটা প্রশ্ন করেছিল, ‘শেষ আর শুরুর মধ্যে প্রকৃত প্রভেদ কি?’ সেদিন উত্তর দিতে পারিনি! অনেকদিন পরে বলেছিলাম, ‘কিছুই নেই। প্রতিটা শুরুর আগে যেমন একটা শেষ থাকে তেমনই প্রতিটা শেষের পরে একটা শুরু থাকে।’
আমার বলা শেষ হবার পরেই আমার কথাটার ওপর একটা শুকনো রোদ এসে পড়ল। নীল রঙের ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্পের মায়াবি জটিলতাগুলোকে নিয়ে লুকিয়ে সমিতি গড়তে গিয়ে ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেললাম; কী আশ্চর্য! আমার নিজেকে পাখির মতো মনে হচ্ছে! ভাসছি আসমুদ্র হিমাচল। আমার হাতগুলো পাখির ডানা হয়ে বাতাস কাটছে! বাস্তুসাপ হয়ে দিন কাটানোর সময় শেষ হয়ে এলো…
শুধু আধো আধো বুলিতে একটা বাচ্চা আমার দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘র‍্যাট রেস!’
যে অহংকারী সকাল আদিম স্বর্গ বানিয়ে দ্যায়, সমস্ত পীযুষ জল ব্যাধির মতো শরীর থেকে শরীর ছুঁয়ে যায়, তার নিপুণ দিবাভাগ অতিপৃক্ত হয়ে পাগলের মতো ভ্যাকসিনের খোঁজে ব্যাকুল হয়ে পড়ে…
অন্তরীক্ষে যে আর্তি, যে হাহাকার, তার খোঁজ রাখে কোন কারুশিল্পী?আমরা সবাই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি! কিন্তু পারছি কি?প্রতিটা চিরহরিৎ ছায়া আয়ুর বিপরীতে পৌনঃপুনিক কুয়াশা দিয়ে সব পথ ঢেকে দিচ্ছে!
এরই ফাঁকফোকরে সিসিফাস একসময় নিজেই পাথর হয়ে যান।
(৩৭)
মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেলেই একটা আতঙ্ক চেপে ধরছে আজকাল। ভীড়ের মাঝে মানুষ চিরকাল নদী হতে অভ্যস্ত। এই তো সেদিন গ্লাভস আর মাস্ককেই আমরা যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে এটা জানলাম। স্যানিটাইজারে পকেট গরম করতে করতে নিজেকে সৈনিক ভাবতে চেষ্টা করা শুরু করলাম। মাঝে একাত্তর বার সূর্য উঠল, আমরা যথারীতি গ্লাভস, মাস্ক, দূরত্বকেই সর্বপ্রথম স্যানিটাইজ করে দিলাম! বীরত্বের ঘূর্ণিঝড় কুয়াশার লালিত্য মাখতে গিয়ে চুপসে পড়ল।
আমার বাড়ির সামনে একটা পুকুর ছিল। ছোটোবেলায় ওখানে সাঁতার শিখেছিলাম। পুকুরটা বদ্ধ বলে বাড়ি এসে আবার ভালো করে স্নান করে নিতাম। সমুদ্রের লবনাক্ত চ্যাটচেটে ভাবটাকে তাড়ানোর জন্যেও আমি সমুদ্র থেকে উঠে মিঠে জলে স্নান করি। স্নানের সেইসব অনুভূতিগুলো ভিন্ন বলেই নিউজিল্যান্ড আর ভারতবর্ষ আলাদা আলাদা দেশ হয়ে যায়…
রাতের আকাশ জুড়ে যখন বাউল গান আমার কানে ভেসে আসে নিজের মধ্যের বাউলিয়া সত্তাকে ঠিক তখনই খুঁজে পাই। সেই খুঁজে পাবার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল, তেমনই আনন্দের পরিযায়ী স্রোত কখনও কখনও নদীর উষ্ণতাকে হিমাঙ্কে পৌঁছে দ্যায়। মনের পাহাড়ে তখন ধস নামে। আমরা সবাই খাদের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে নিজের কুশপুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে ফেলি!
তবুও ঘাসের ওপর পুলক ছড়িয়ে এখনও খেলা করে যায় কিছু সন্ধ্যাতারা…
(৩৮)
লগ্নভষ্ট হয়েও ইতিহাস ফিরে আসে। সবুজ পাতার নাভিতে যে দুর্বোধ্য ইঙ্গিত থাকে সেই একই তরঙ্গ বয়ে চলে মানুষের মস্তিষ্কের করিডরে, গ্রে-ম্যাটারে, হৃদপিণ্ডে। প্রহেলিকার মধ্যেই বসতি গড়ে লালন। নিহত জলচ্ছ্বাস তবুও অবাধ্য হতে চায়। এর দায় কার?
আকাশ বলে বাতাসের। বাতাস হাত তুলে দেয়। লোকে ভাবে হাত তুলে দিলেই বুঝি চৈতন্য ফেরে! ভুল ভাবনা। উর্ধ্বগামী পরিসংখ্যানের এপারে মেঘ, ওপারে মহাকাল!
স্বভাব রসিক সহজাত হাঁটাচলা নির্জন তান্ত্রিকের মতো যজ্ঞের আহুতি প্রস্তুত করে। আগুনের লকলকে জিভ ছেঁকে ধরে সংখ্যা। একজন উপসর্গহীন পজেটিভ — হাতে কমণ্ডলু; মানুষের মুখে আঁকা হয়ে যায় বিষন্ন একশালিক!
ধূসর চোরাবালির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বিবর্ণ ঘুম। জনশ্রুতির স্কেলিটন দিয়ে মেঘলা এপিটাফ পেরিয়ে আসা ছাড়া এখন আর উপায় নেই। এ যুদ্ধ হারার নয়।
হারার কোনও ছায়া থাকে না; মরুদ্যানহীন…
(৩৯)
শব্দরা অনেক সময় চুপ হয়ে যায়। একটা আলোকিত সন্ন্যাস তখন খড়ম পড়ে সামনে এগিয়ে আসে। বাতাস নর্তকীর ভূমিকা নেয়। এমন দিনগুলোতে আমার ঘাড়ে ব্যথা করে। আকাশ আজ মেঘলা। ভোর বেলা রাস্তার পাশের একটা গাছ আমাকে কাছে আসার জন্য ডাকছে। গাছের পাতাগুলো ঝিকিমিকি কুয়াশায় খেলা করছে।
আমার সঞ্চয়ে যতটা ঘুম বাকি ছিল তার সঙ্গে পরিমান মতো কল্পনা মেশানোর পর পটচিত্র থেকে দূর্বাজল গড়িয়ে পড়ল। আমি হাঁটতে হাঁটতে জলেশ্বর মন্দিরে এলাম।
অনেকদিন আগে এই অঞ্চলে একবার খুব অনাবৃষ্টি হয়েছিল, জঙ্গলাকীর্ণ চারিদিক ; মধ্যেখানে একটি শিবমন্দির। অতি উজ্জ্বলবর্ণের এক সন্ন্যাসী ওই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে এক অত্যাশ্চর্য বালককে ডেকে বলেছিলেন, ‘বিজয়, মন্দিরের ভেতর ওই যে শিবলিঙ্গটা দেখছ, ওই শিবলিঙ্গকে জল ঢেলে শান্ত করো। তোমাদের অঞ্চলের খরা দূর হয়ে যাবে।’
পরেরদিন ভোর থেকে অঞ্চলবাসী শিবের মাথায় জল ঢালতে লাগলেন। আশ্চর্য! দুপুরের মধ্যেই প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে খরা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। সেই থেকে মন্দিরটিও জলেশ্বর মন্দির হিসেবে প্রসিদ্ধ হ’ল।
শুধু কোনও কোনও মানুষের জীবনে হাজার বালতি জল ঢাললেও কখনও কখনও খরা দূর হয় না!
স্রষ্টা নিজে ফুটিফাটা হয়েও সৃষ্টিকে বুকে জড়িয়ে আর্দ্রই রেখে দেন। এটাই দস্তুর। জ্যামিতিক জ্যোৎস্না কোনো এক জাদু বলে রমরমিয়ে বেড়ে চলে…
(৪০)
প্রায় আড়াই মাসের ওপর অজ্ঞাতবাসে পাণ্ডব পাণ্ডব আদবকায়দাগুলো ফুটে বেরোচ্ছে। সামনে দিয়ে মহাভারত কলকলিয়ে বয়ে যাচ্ছে। মানুষের মতো অনেক বিকল যন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত ছাদবাগান থেকে গোলাপ চারা আর কুঁড়িগুলো দেখে রাখছে, ওদের পাশে কয়েকটা টবে ভাটফুল রাখা আছে। বেশ লাগে ওদের দু’জনকে পাশাপাশি দেখতে। ছাদবাগানটির নামটা ‘সাম্যবাদ’ হওয়া উচিত ছিল।
মহাভারত হাঁটছে। শুধু বাতিল হওয়া জিনিসগুলো আজও কুরুক্ষেত্র থেকে বিদায় নিচ্ছে না! জমাট হু হু বাওয়া…
অর্জুনের তির আর ভীমের গদা ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ দাপিয়ে বেড়ালেও দ্রৌপদীর শত লাঞ্চনা আজকাল আর যুধিষ্ঠিরের ঘুম ভাঙাতে পারে না! একমাত্র ঘুমন্ত অবস্থাতেই মিথ্যাচার করা অসম্ভব, ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ’ বলার পর সেটা যুধিষ্ঠির হাড়ে হাড়ে বুঝে গিয়েছিল। সেই ভুল আর করা চলবে না…
টবের মধ্যে থেকে অতি সন্তর্পণে ফুলের চারা সমেত কুঁড়িগুলো সবকিছু দেখে রাখছে।
(৪১)
অনেকেই পাক দিয়ে হিসি করতে অভ্যস্ত। যারা পারেনা তারা ঘুলিয়ে জল খায়। কাদা তখন মুখে না বাঁধলেও মন অনেকটা কাদার স্বাদ বুঝে নেয়। ফলত অবুঝ আস্ফালন বাস্তঘুঘু স্রোতের বিপক্ষে তরঙ্গের বার্তা দেয়।
এই স্রোত অবৈধ অধিকারকে নিজের আয়ত্বে রাখার একটা বৃথা চেষ্টামাত্র। বর্তমানে চিনসাগর তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। নামের ভ্রান্তি বাদ দিলে প্রতিটা ষড়ভূজে প্রসঙ্গটি আন্তর্জাতিক।
আজকাল তাই আর কাদা হতে পছন্দ করি না। বরং মাটিকে আরও একটু বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছা করে।
মাটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বীজকে আরও আদরে লালন করি। কোষ থেকে কোষান্তরের মানবিকতাকে মেঘমল্লারের উত্তুঙ্গ পীযূষ জলে ধুয়ে নিই।
আমাদের শহরের একপ্রান্তে একটা বড়সড় পতিতাপল্লী আছে, যেখানে বহু ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস মুথাঘাস হয়ে জমা থাকে। এইসব জায়গা বহুবর্ষজীবী বীরুৎ শ্রেণীর। এখানে সেগুন ফুলের উল্লাস নিশিযাপনের কার্ণিশ ছুঁয়ে পর্ণমোচী বিষাদের কোলাজ আঁকে। রোদ্দুর ছুঁড়ে মারলে ক্যানভাস ছিঁড়ে যায়!তার কয়েক হাত দূরেই হংশারুঢ়ো পূজিত হন।
এর ঠিক উল্টো ছবি ছিল বাকি শহরটাতে, মেঘযাপনের এপিটাপে পাতলা উপকাহিনী মোড়ানো শাক্ত-বৈষ্ণবের জলজোছনা কিংবা তুমুল প্লাবনের রাত মুছে দিয়ে সম্পৃক্ত জলীয় দ্রবণকে পেঁজাতুলোর মতো বৈভব দান করেছিলেন অদ্বৈতাচার্যসহ বহু গুণীজন।
প্রাত্যহিক মহাপ্রস্থান শুকনো ঠোঁট চাটতে চাটতে এগিয়ে আসে! আলপথ দিয়ে আমার শরীরেও যখন আগুনের সাপ খেলা করে তখন নিজের একটা পেখমের জন্য মন আকুলিবিকুলি শুরু করে দ্যায়।
প্রতিটা অসম্পূর্ণ কান্না হঠাৎই যেন আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তারা সমবেত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘আকাশ জুড়িয়া চাহিবে কাহার আঁখি, ঘরের বাহিরে নীরবে লইবে ডাকি’। ভাষার যে রহস্য থাকে তার থেকে স্পর্শ বা স্পন্দনের রহস্য অনেকটাই আলাদা।
জোনাকির ইস্তাহারে লিখে রাখা সমস্ত অতীত বাস্তবক্ষেত্রে বিপরীতগামী হওয়াটাও বড়ই প্রয়োজনীয়।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।