(৩১)
প্রত্যেকটা মনের মধ্যেই বাস করে লালন ফকির,
মন তো আকাশ ঘেরা, সাচ্চা মুসাফির…
এতদিন গৃহবন্দিত্বকে স্বীকার করেও মুসাফিরে প্রেম আমার কমেনি। একা একা প্রকৃতির মাঝে মিশে যাওয়ার অভ্যাস আজীবনের। প্রকৃতির বাকি সমস্ত প্রাণ যখন আপন উল্লাসে নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে তখন আমরা অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে ভুগতে বেশ বুঝতে পারছি এই পৃথিবীতে আমরা আসলে প্রথম শ্রেণীর অনুপ্রবেশকারী।
অনেকদিন পর আজ অতি ভোরে আমার জানলায় এসে বসল একটা চড়ুই পাখি। কতদিন পর দেখলাম চড়ুই। সে নিজের মনে খেলা করে, আমাকে পাত্তা দেয় না। তবুও ভালো লাগছে এই সকাল। পাত্তা পাওয়া বা দেওয়ার জন্য ফালতু অনেক সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেটা ওরা জানে বলে ওসব আপাতত অভিধান বর্হিভূত রাখাটাকেই হয়ত শ্রেয় বলে মনে করল। চড়ুইটিকে আমি কোনও বিরক্ত না করে কিছু খাবার দেবার চেষ্টা করতেই ও উড়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে খেলো।
বাড়ির সামনের রাস্তাটা এখন অধিকাংশ সময় ফাঁকা থাকে, অজানা একটা হাহাকার যেন আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে রাস্তাটাকে। চড়ুই পাখিটা খাওয়া শেষ করে আর জানলায় খেলা করার প্রয়োজন বোধ করল না। সামনের ফাঁকা রাস্তাটায় গিয়ে নামল। রাস্তার বুক থেকে আঁচলটা সরাতে গিয়ে নিজের ভাষায় বলে চলল হাজারো কথা। রাস্তায় লেগে থাকা ভোরের শিশিরবিন্দুগুলোকে খুঁজে নিয়ে বেশ গল্প জুড়ে দিল। আঁচলটা বেশ খানিকটা সরে যেতেই আমার মনে হ’ল, এত কাছে থেকেও ওই আঁচলটা সরানোর কোনও চেষ্টা এতদিন আমি করিনি! অথচ ছোট্ট চড়ুইটি সেটা অবলীলায় করে ফেলল।
আপনজনের কাছে তো বুকের আঁচল সরাতে কোনও আপত্তি থাকে না, এক্ষেত্রেও থাকল না; যত সমস্যা তো সেই পরের কাছেই। শুধু আপন আর পরের এই তারতম্যটাই অনেকদিন পর পৃথিবী নিজ দায়িত্বে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে…
(৩২)
ধীরে ধীরে সব কিছুই শিথিল হয়ে যায়। এই শিথিলতার মধ্যেই নিয়তির দৃঢ় পদক্ষেপ। বাইরে এখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। একমনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে গান শুনলাম-” আঁখি ফিরাইলে বলে, না না না, ও যে মানে না মানা “…
শিথিলতা শুধু গানকেই কখনও ছুঁতে পারে না, আর পারে না বলেই প্রতিটা সংসারী মানুষের মধ্যেই একজন করে দধীচি থাকে, আবার ইন্দ্রও থাকে। কী অসীম বৈপরীত্য! এই দড়ি টানাটানিতেই এক একটা বিকেল মায়াবী হয়ে ওঠে।
গাছগুলো সারাদিনের রোদ গায়ে মেখে সেই বিকেলবেলায় যখন আমাকে প্রশ্ন করে, আমি নির্বাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। গাছের পাতারা আমাকে অতিথি ভেবে আপ্যায়ন করে। তারা বলে — আমাকে বিনির্মাণ করো।
আমি তখন পরশ পাথর খুঁজি। মাথার ভেতরেও যে মহাশূন্যের অবস্থান আমরা সেখানেও ত্রিশঙ্কুর মতো ভেসে যাচ্ছি! শ্যাওলার আগ্রাসী খিদে অন্তরীক্ষ ভরিয়ে তোলে; বিপন্নতা আমাকে বলে — নগ্ন হও, আরও নগ্ন হও…
নগ্নতা আমাকে অতীতচারী করে তোলে, মৃত নদীর আত্মকথা শোনায়; আমি আর নিশ্চুপ থাকতে পারি না। ধুলোবালি উপেক্ষা করে বাতাসে আমার কণ্ঠ ধ্বনিত হয় — ক্ষমা করো; দ্যাখো, নাভিপদ্ম ফেটে বেরিয়ে আসছে পতিতালয়ের সেই পরম মৃত্তিকা! ভৈররী সুরে মৃত নদীটা জেগে উঠছে; হে পর্যটক, ক্ষমা করো…
(৩৩)
প্রতিটা বাঁকের মুখে কষ্টের একটা প্রতিচ্ছবি থাকে। বিরামহীন, স্বচ্ছতোয়া সেই কষ্টগুলো জমাতে জমাতে নিজে সম্মোহিত হয়ে পড়ি। নীরব চাহনিতে তাদের দেখি, স্পর্শ করি, তারপর সাধের হারমোনিয়ামের ধূসর রিডগুলো গোঙানির মতো আওয়াজ তোলে…
ওই একই আওয়াজ আমার হৃদযন্ত্রে প্রতিনিয়ত শুনতে পাই। আদতে আমরা প্রত্যেকেই উৎকৃষ্ট প্রুফ রিড়ার ছাড়া আর কিস্যু নই। জীবনে যেদিন প্রথম করোনার কথা শুনলাম, সেইদিন শোনার কাজটা কানের বদলে মনকে দিয়েছিলাম। যে মন এক আগুন বসন্তে আমাকে দিয়ে হলকর্ষণ করিয়ে নিত, সেই মন নিজেই এক প্রান্তীক চাষী হয়ে সেইদিন কানকে ছুটি দিয়েছিল।
এই সমঝোতা বিপদের দিনে ফিরে আসে। আমরা যারা একান্তই গৃহপালিত, তারা বেশ ভালোই জানি কীভাবে আলো আর বাতাসকে মেহগনি গাছে বেঁধে রাখতে হয়। কিন্তু গাছ তো কূটকৌশলের ধার ধারে না। তাই সে অচঞ্চল, নিরুত্তাপ, ভ্রূকুটিহীন…
জীবাশ্ম ঘেরা নিষিক্ত ফুল ভাবলেশহীন হয়ে পৃথিবীর নিয়মনীতিকে বলে দ্যায় – ছিপছিপে জ্যোৎস্নার বুনোগন্ধে আজ মাতোয়ারা তোমার এই প্রিয় পথ, হে প্রিয়; আজ থেকে আমি আরো নিষিক্ত হব, তুমিও হবে…
ছোটোবেলা থেকেই ওই পথে হাঁটা ছিল আমাদের নিষিদ্ধ। যে কোনও নিষেধ খুব তাড়াতাড়ি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে মানুষের জীবনে ধরা দ্যায়। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত এমন অজস্র নিষেধ ফাঁকি দিতে গিয়ে ওগুলোতে লবনাক্ত সামুদ্রিক জল মিশিয়ে দিয়েছি। শস্যরোপনের পাণ্ডুলিপি ঘিরে থাকা ছাত্রজীবনেই আস্তে আস্তে মহাকর্ষণ ছিঁড়ে মুঠোবন্ধ আঙুলগুলো আকাশের দিকে তীব্র প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। তার আবর্তন পথ-পরিক্রমা করতে করতে একদিন সব উপমাকে একসঙ্গে বেঁধে আততায়ী রূপে দাঁড় করিয়ে দিল।
এখানেই সমস্ত সততা নদী আর মানুষকে এক পথে মিলিয়ে দিয়েছে। না হলে মাস্কে নাক, মুখ ঢাকা আগামী প্রজন্মের কাছে গোপন অঙ্গের সংখ্যা বেড়ে যেতে হতে বাধ্য।
(৩৪)
কিন্তু জাগতিক নিয়মে মন যখন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে তখন কখনও কখনও মানসভ্রমণে অবগাহন করা ছাড়া উপায় থাকে না। আলোর ডাকে হাত মেলাতে মেলাতে যখন নিয়মনিষ্ঠ ধুলোবালি সরতে থাকে ঠিক সেই সময় সদ্য অঙ্কুরিত বীজ থেকে চারাগাছটি মুখ মেলে ধরে।
আমি পা মেলাতে থাকি সেই পথে যেখান দিয়ে গঙ্গার সোজা রাস্তাটা আঁকিবুঁকি করে নেমে গেছে। দুইপাশ জুড়ে বিচিত্র সব গাছ তখন আমার একমাত্র বন্ধু। মতিগঞ্জ মোড় আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে যায়। রাতের বেলা এখানে আলো ঝলমলে একটা আড্ডা মারার জায়গা রয়েছে। খুব সকালে ওটার পাশে থাকা খাল খন্দে ভরা ছোটো ছোটো পুকুর, বাঁধ, পাখিরা আমাকে ইশারায় ডাক দ্যায়।
যে কোনও ডাকেই তো কিছু না কিছু ইশারা থাকে। সেই ইশারাকে মান্যতা দিতে গাছের পাতা যখন ঝরে পড়ে কিংবা জ্যোৎস্নারা আকাশের বুক জুড়ে তপ্ত শীৎকার তোলে তখন ওরাও যেন সমস্বরে বলে ওঠে, ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।’
একসময় আবার সব কিছু নিজের তালেই থেমে যায়। পথও একসময় দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে একটা দিক চলে যায় শ্মশানের দিকে আর অন্যদিক যায় নদীর দিকে। শ্মশানের দিকে গেলে স্নান করে আসে শূন্যতা। আর নদীর দিকে গেলে ‘সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর। আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।’