• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবহ -তে প্রভাত মণ্ডল (পর্ব – ৪)

ইছামতীর সন্তান – ৪

প্রকৃতির কোলে লালিত পল্লীর ছোটো ছোটো এই ঘরগুলিতে যেমন অপার শান্তি বিরাজমান তেমনি মাঝে মাঝে বাদ-বিবাদ,তর্ক-বিতর্কের সভাও কম চলে না।অশিক্ষিত অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন এই মানুষগুলো দিন পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়।সবটা বুঝতে না পারলেও নিজেদের সাথে ঘটে চলা অবজ্ঞা ও বঞ্চনার অনেক কিছুই বুঝতে পারে তারা,তবুও মুখ বুজে সবটা সহ‍্য করে নেয়।অর্থবল তাদের খুবই কম,নেই বললেই চলে,তাই অন‍্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষাও তাদের মুখে নেই।তবে অসন্তোষ যাবে কোথায়!দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ,তিল তিল করে জমা হতে থাকে বুকের কোনো এক স্থানে।শুধু সময়ের অপেক্ষা আগ্নেয়গিরির লাভা আর ম‍্যাগমার মতো বাইরে বেরিয়ে আসার।যা সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ গড়ে তুলবে।
মাস্টারের একমাত্র ছেলে রাহুল।এ পল্লীর মধ‍্যে শিক্ষিত বলতে সেইই।সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এবারে কলেজে ভর্তি হয়েছে সে।সাদামাটা ছেলেটা বাপের মতই সৎ ও আদর্শবান।অন‍্য পরিবারগুলো যেখানে সামান্য বিষয় নিয়ে নিজেরা চুলোচুলি লাঠালাঠি করে,অকথ‍্য গালিগালাজ নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে পড়ে,তখন রাহুল থাকে অন‍্য চিন্তা ভাবনা নিয়ে।এইটুকু বয়স থেকেই ওর মাথায় কাজ করে নানারকম যুক্তিনির্ভর কথা।বিজ্ঞানের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস।তাই পল্লীর অন‍্যদের মত কুসংস্কার তাকে অতটা গ্ৰাস করতে পারেনি।ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধাশীল এই ছেলেটা ঈশ্বরের প্রতি অন্ধ ভক্ত নয়।ঈশ্বরের নাম নিয়ে ভণ্ডামিও সে একেবারেই বরদাস্ত করে না।অন‍্যদের থেকে একটু যেন আলাদা।হবেই না বা কেন,স্কুলের মুখ দেখেছে সে,বই খাতা এসবের সাথেও তার পরিচয় ঘটেছে।তাই কুসংস্কার ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন অন্ধবিশ্বাসী এই পল্লীর জনসমাজ থেকে নিজের পরিবারকে মুক্তি দিতে চায় সে।পাশাপাশি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এই পল্লী থেকে একদিন সমস্ত কুসংস্কার দূর করে বাবুদের অত‍্যাচারের ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করবে।নিজেদের যোগ্য অধিকার বুঝে নেবে।কলেজে যেটুকু প্রয়োজন সে যায়,রোজদিন ক্লাস করে উঠতে না পারলেও মাঝে মাঝেক্লাস করে,বাকি সময়টা কাজের সন্ধানে ছুটতে থাকে।যা কাজ পায় তাতেই নেমে পড়ে একটু অর্থ উপার্জনের আশায়।যেটুকু অর্থ উপার্জন হয়,সেটুকুই গুছিয়ে রাখে।বাবার মতই বড় হিসাবী সেও।
এলাকায় নামকরা ঘোষ পরিবার রামেশ্বর ঘোষ।পাঁচে ভাই — রামেশ্বর,শ‍্যামেশ্বর,বীরেশ্বর,ভদ্রেশ্বর আর ছোটোটা ভবেশ্বর।কিছুকাল আগে এদের নিজেদেরই খাওয়া জুটত না।অন‍্য ঘোষ কাপালিদের বাড়িতে মাইনদারের কাজ করে খুব কষ্টের মধ‍্যে দিয়ে দিন চালাতো এরা।তবে সীমান্ত এলাকায় রমরমিয়ে অবৈধ কারবার করে খুব অল্পদিনের মধ‍্যেই বিত্তবানে পরিণত হয়।যতদিন গরীব ছিল ততদিন সুস্থ মানবতা এদের মধ‍্যে বিরাজ করত কিন্তু যেমনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হল,অবৈধ সম্পত্তির মালিক হল,অমনি দেমাক গেল বেড়ে।মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না আজকাল।অর্থের দম্ভে আজ অন্ধ।পড়াশুনার বালাই এদের মধ‍্যে বিন্দুমাত্র নেই,স্কুলের গন্ডীও কেউ অতিক্রম করেনি,তবে পয়সার জোরে ভাবটা এমন নেয়,যেন বিলেত ফেরত কোনো শিক্ষিত ব‍্যক্তি।
“পুঁজি বেশি বুঝি বেশি” বাংলার চিরপ্রচলিত এই কথাটি এদের সাথে অক্ষরে অক্ষরে খেঁটে যায়।গ্ৰামের প্রতিটি জায়গায় এদের পাঁচ ভাইয়ের কর্তৃত্ব একরকম জোরপূর্বক বলাই চলে।অবৈধ অর্থের জোরে কাপালিদের বহু জমি জায়গা এরা কিনে নিয়েছে চড়া দামে।উঁচু লম্বা প্রায় ফুট ছয়েক শরীরের অধিকারী রামেশ্বর ঘোষ তার এই অবৈধ কারবারের অর্থের জোরেই এখন গ্ৰামের মাথা হয়ে উঠেছে।বাহান্ন পল্লীও তারই হাতের মুঠোয় রাখতে চায়।একাত্তরে এদেশে এলেও,তৎকালীন পরিস্থিতিতে সরকার থেকে ত্রাণ পেলেও পরিস্থিতি থমথমে হয়ে যাবার পর পল্লীর মানুষগুলোর জীবন এক অন‍্য ধারায় বয়ে চলেছে।স্থায়ী ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জনের জন‍্য বহুদিন ধরে বহু জায়গায় ছুটোছুটি করলেও এরা আজ পর্যন্ত কিছুই সুরাহা করে উঠতে পারেনি।হাতে গোনা দু-একটি পরিবারের স্থায়ী ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্থাৎ ভোটার কার্ড থাকলেও অধিকাংশইরাই এখনো নাগরিকত্বহীন।তাই সরকার থেকে কোনো সুযোগ সুবিধা এরা পায় না।
বীরেশ্বর অতি সুচতুর।অর্থের জোরে এলাকায় রাজনৈতিক আধিপত‍্য বেশ ভালো মতোই প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে।বয়স সাতচল্লিশ হলেও বিয়ে করেনি।গোলকের বউএর সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক।গোলক যে একেবারে কিছু জানে না তা নয়।সেও অনেকটাই সুযোগসন্ধানী,অর্থলোভী।অর্থের লোভে বউকে বীরেশ্বরের বিছানায় পাঠাতেও দ্বিধাবোধ করে না সে।প্রায়দিনই সকালে আগমন ঘটে এ তল্লাটে বীরেশ্বরের ————
কি গো,ও সুলতা?সকালের খাবার কিছু আছে নাকি?পেট চনমন করছে তো।তোমার হাতের খাবার না খেলে আমার আবার পেট ভরে না।
—— হঅঅঅ,সেকতা কি আর কওন লাগে?আমি কি আর মোটে কিচু বুজিনা।আমাগে বাবু বইলা কতা।তা আমাগের সরকার থেইক‍্যা কি কিচু পাওনের ব‍্যবস্তা করা যাবো না?এই কও ভুটার কাড কইর‍্যা দিবানে।কতদিন তো হয়‍্যা গ‍্যালো।
—– আরে অত রাগ করো কেন?সামনেই একুশের ভোট,তা তোমারটা না হয় আমার গাঁটের টাকা খরচ করে করে দিলাম,তা বলে সবাইকে তো আর এভাবে দিতে পারিনা।পাড়ায় বলেছ পাঁচ হাজার করে টাকা লাগবে তা?
সুলতা রূপবতী, বুদ্ধিমতী।চারিত্রিক দিক থেকে সে যেমনই হোক, একটু ঝগড়ুটে স্বভাবের হলেও পল্লীর প্রতি তার অপার স্নেহ।এ পল্লীর মা যেন সে।নিজের রূপ যৌবন বাজি রেখে,ব‍্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করেও সমগ্ৰ বাহান্ন পল্লীর মানুষদের প্রতি তার যেন অগাধ দায়িত্ব ও মমত্ববোধ।সকলকে স্থায়ী ভারতীয় নাগরিকত্ব পাইয়ে দিতে সে উঠে পড়ে লেগেছে।একবার স্থায়ী নাগরিক হতে পারলে সরকার থেকে চাল পাবে,আটা পাবে,গম পাবে,ছোলা পাবে সব কম দামে।দুটো খেয়ে বাঁচবে পল্লীর ছেলে-মেয়ে গুলো।কামালদের সাথে কিংবা পল্লীর অন‍্যদের সাথে কথায় কথায় সে ঝগড়া জুড়ে দিলেও নিজেই আবার উবজে কথা বলে,কাছে টেনে নেয় সকলের সন্তানকে।তার নিজের সন্তানাদি কিছু হয়নি।অনেক চেষ্টা করেছে,বদ‍্যি,ডাক্তার সবই দেখিয়েছে কিন্তু মা হবার সৌভাগ্য তার আজও মেলেনি।তাই পল্লীর সকলের সন্তানই যেন তার নিজের সন্তান।পুজোর সময় সকলের জন‍্য খাবার আনে সে।দূর্গা পুজোর নবমীর দিন বাড়িতে পোষা দু-চারটে মুরগি কেটে দেয় পল্লীর সন্তানদের খাওয়ানোর জন‍্য।এ সন্তান তো তার নিজেরই,তাই এদেরকে খেতে দিয়ে সে মনে পরম সুখ অনুভব করে।বীরেশ্বরের ভোটার কার্ড করে দেবে বলে মাথাপিছু পাঁচ হাজার টাকা চাওয়াতে সে বলে ওঠে——
অত ট‍্যাহা পয়সা কারো কাচে নাই,ট‍্যাহার অঙ্ক কম করতে হৈব।এই কও তোমাগে এত হাত অত হাত,এই ন‍্যাতাগো সাতে উটা বসা,ওই ন‍্যাতাগো সাতে ডাহাত বাহাত,এই সগল কতা গুলান কি তাইলে ফালতু?
——উফফফফ,রাগ করিস ক‍্যানো সুলতা?এ টাকা কি আমি খাবো নাকি।সব ওপর মহলে যাবে।তোদের তো কাগজপত্র কিছুই নেই, ওসব তৈরি করতে হবে।একটা খরচ আছে বুঝিস না কেন?এক এক টেবিলে কিছু কিছু টাকা না দিলে কেউ কাজ করবে না।তোরা এসব বুঝবি না।তোদের থেকে তো কম নিচ্ছি বলে কয়ে,অন‍্যদের কাছে তো দশের নীচে কোন গল্পই নেই।
বীরেশ্বরের চোখ মাস্টারের বউ এর প্রতিও পড়ে একসময়।মাস্টারের বউ সাথে সাথে সেকথা স্বামীকে জানালে,মাস্টার সাফ সাফ জানিয়ে দেয় —-
দ‍্যাহো,ট‍্যাহা আচে তুমাগো আচে,সময়-অসময় তুমাগো খ‍্যাতে কাম করতি যাই বইল‍্যা হাতির পাঁচ পা দ‍্যাহো নাই।ভালোয় ভালোয় এ কতায় কাম না হইলে ধর থেহে মুণ্ডু আলাদা কইর‍্যা দিমু।মনে থাহে য‍্যান কতাডা।
বীরেশ্বর বুঝতে পারে এ জায়গায় তার জারিজুরি খাটার নয়।তাই মানে মানে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।এদিকে সামনেই একুশে ভোট।রামেশ্বর আর বীরেশ্বরের মূল লক্ষ‍্য,একুশের ভোট হবার আগেই এই সকল পরিবারের প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক সদস‍্যগুলোর ভোটার কার্ড তৈরি করা।এতে আখেরে লাভ তাদেরই।এই মানুষ গুলোর ভোটার কার্ড হলেই সমস্ত ভোট তাদের ঝুলিতেই যাবে।সুতরাং বিরোধী পক্ষ মাথা তুলে উঠতেই পারবে না।
মাস্টার একটু পড়াশোনা জানে,যেকোনো ভাবে অফিস কাছারি গিয়ে নিজের ভোটার কার্ড করে নিয়েছে আজ প্রায় বছর দুয়েক হল।তবু ঘোষ বাবুদের এক পয়সা দিয়ে পায়ে ধরেনি।বরং বীরেশ্বর টাকার কথা বললে সে মুখের উপর জবাব দিয়ে বলেছিল —-
ইচামতী পার হইয়া আইচি তা বইল‍্যা ইমান বেচি নাই।ইচামতীর সন্তান আমরা।এ দ‍্যাশ আমাগো দ‍্যাশ।এ গাঙ আমাগো গাঙ।এইহানে রক্ত দিয়া যামু তা এক পয়সা তোগে হাতে দিমু না।
সত‍্যিই তো,সৎ আর সাচ্চা এই মানুষটি অন‍্যায়ের সাথে কখনো আপোস করেনি।সকালে মাঠে কাজের ফাঁকে ভাত খেতে বসে স্ত্রীর সাথে গল্প করে বলে —–
জানিস লতা!একাত্তরে আইচি তা কি,কারো জমিন ভোগ করি নাই।সরকার এনে থাকতি দ‍্যাচে থাকচি,সরকার যা দ‍্যাচে খাইচি।একবেলা খাইয়ে দিন কাটাইচি।ইচামতীর এ চর,এ জমিন বাবুগে হইতে পারে।আমাগেও কম কিচু না।এ চর ছেলো বলে আর বাবুগে দয়া আচে বলে আজ দুইডা ভাত জোটে প‍্যাট।এ গাঙ আমাগো গাঙ,নিজের বাপ-মার কতা মনে কইর‍্যা তো আর প‍্যাটে ভাত জোটেনা।ইচামতী এ চর দান করচেলো বইল‍্যা আজ বাঁঁইচ‍্যা আচি,গাঙ আমাগো মা,আমরা ইচামতীর সন্তান।
দিন যেমন গড়িয়েছে, দিক পরিবর্তন হয়েছে ইছামতীর গতিপথের।সীমান্ত আর আগের মত নেই।চাইলেই এপার ওপার হওয়া যায় না।দেশের সুরক্ষার জন‍্য এখন প্রহরীর সংখ্যা অসংখ্য।আজ মাথায় চিন্তার ভাঁজ,চরে যেতে মানা পল্লী সহ গোটা এলাকার মানুষের। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কড়া নির্দেশ।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।