২২।।
রাত তখন এগারোটা । রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে সন্দীপন আজ প্রস্থানের পথে । এর আগে অফিসে যাবতীয় পেপার ওয়ার্কস রেডি করে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ঘরে ফিরে আসে সে । যদিও এই স্থান তার জন্য নতুন , মাত্র মাস ছয়েকের পরিচয় ; তবু কেমন যেন নিজের মতো হয়ে গেছিল সব । যতই হোক , হাসি কান্না , মান অভিমান , রাগ , শান্তি অশান্তি যেন এই কদিনে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছিল মহাকালের পায়ে । এই তো সেই শহর যার ছাওয়ায় কিছু দিন আগে দেখেছিল সে রাজনৈতিক উত্থান পতন । কৃষক আন্দোলনের যে ঝড়ে মধ্যপ্রদেশ সরকার কেঁপে উঠেছিল ; সেই আন্দোলন তো এই উজ্জয়িনের চরণ ছুঁয়েই গেছিল সেদিন । ইন্টারনেট ডাউন , কারফিউ সব কিছুই অভিজ্ঞতা করেছিল সে এই মহানগরীর বুকে ।
আজ সে সব ছেড়ে বিদায়ের পালা । যদিও চিরকালীন নয় এ বিদায় । মাস দশেক পরে আবার এখানেই ফিরে আসতে হবে তাকে , তবু ইচ্ছে যে হয়না । রাত এগারোটায় ঘর থেকে বেড়িয়েই মা কে ফোন করে দিয়েছিল সে , তাই সে দিক থেকে কোন রকম দায়িত্বের বোঝা নেই তার কাঁধে । পাড়ার মোড়ের দোকানটা বন্ধ হবে হবে করছে । সেদিকেই এগিয়ে গিয়ে হাঁক মেরে বলে উঠলো ,
—– পান্ডে জি । হো কেয়া ?
দোকানের পেছন থেকে তার ছেলে বেড়িয়ে এসে উত্তর দেয় ,
—– পাপা নেহি হ্যায় । কেয়া দু বোলিয়ে ?
সন্দীপন একটা ফ্লেক কিনে টাকা মিটিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে গেল মূল রাস্তার দিকে । গভীর রাতের নির্জনতা আজ গোটা শহরকে গ্রাস করেছে । পিঠে ও দুই কাঁধের বোঝা নিয়ে গুটিগুটি এগিয়ে চলা পা দুটিও বেশ ক্লান্ত । এই অবস্থায় একটি অটো না পেলে চলছে না আর । সিগারেটের শেষ টান দিয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো সে একবার । অসহায়তার মধ্যেও এবার এক আলোর কিরণ দেখা দিলো । কাছে আসতে সে দেখলো একটি ভিড় অটো , ভেতরে পাঁচ জন বসে আছে ইতিমধ্যেই । হতাশ হয়ে হাত নামিয়ে নিলো সে । কিন্তু ওই কথায় আছে না ভাগ্য যেখানে নিয়ে যায় , আজ এই অটো তার ভাগ্য হয়েই এসেছে আর তাই কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ব্রেক কষলো সে ।
—– কিতনা দূর চলোগে ?
পিছন ফিরে জিজ্ঞাসা করলো অটো ড্রাইভার ।
সন্দীপন ধীর স্বরে স্টেশন বলতেই উত্তর এলো ওদিক থেকে ,
—– পচাস লাগেগা । আ যাও আন্দার ।
আর বিলম্ব না না , আর বিলম্ব নয় ; গানটা যেন বেজে উঠলো সন্দীপনের দেহ মন জুড়ে । দুজন সামনে গিয়ে বসলো আর সে পিছনে কোন রকমে উঠে বসলো । অন্ধকার ভেদ করে এই তিন চাকার আলো ধরেই স্টেশন অভিমুখে যাত্রা শুরু । বাকি পথ রেল বাহনে পূর্ণ হবে ।
স্টেশন যখন পৌছালো তারা তখন বারোটা পনেরো । ট্রেন ছাড়বে রাত দুটো । তার মানে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে কোন বেঞ্চের ওপর পা ছড়িয়ে বিশ্রাম , তবে সময় নিয়ে সাবধান থেকে ।
২৩।।
ট্রেনের মুহুর্মুহু চিৎকার আজ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলেছে । সন্দীপনের দুচোখে ঘুম নেই । হাজার দায়িত্বের বোঝ তার দুই কাঁধে । এরই মাঝে কেটে যাওয়া মুহূর্ত গুলোতে একটু আরাম বলতে ওই সত্যের স্পর্শ । আজকের পৃথিবী জুড়ে যখন প্রেম মানে শরীর হয়ে উঠছে , তখন সন্দীপনের কাছে প্রেম আজও এক মগ কফির উষ্ণতা শীতল সকালে , নিকোটিনের আসক্তি থেকে মুক্তিদায়িনী প্রাণবায়ু , জ্যোৎস্নার আলোতে নির্জন জঙ্গলে বসে থাকা ঘন্টার পর ঘন্টা আর পেশাদারিত্বের মধ্যেও একটু সময় বের করে নেওয়া সুখ দুঃখের খবর লেন দেনের তাগিদে ।
ট্রেনের হুইসাল হোক অথবা নির্জন হোটেলের কামরা ফেসবুকে আজ সারাটাদিন সত্যের জন্য তুলে রাখা । ভোপালের হোটেলে চায়ের কাপ হাতে অপেক্ষায় থাকা এক রাস বসন্তের । ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে নটা । ম্যাসেজ বাক্সে এসে উপস্থিত কাঙ্খিত সেই চিঠি ; একটু অভিমানী আজ ;
—– কোথায় ছিলে এতদিন ?
সন্দীপন হেসে উত্তর দেয় ,
—– ব্যস্ততার জগতে । অতীতের দরজায় কড়া নাড়ছিলাম ।
উত্তর আসে ,
—– সব চিঠি পড়েছি । মাম কেও পড়িয়েছিলাম । এভাবে কাঁদায় কেউ ?
সন্দীপন নিজের মনেই মুচকি হেসে লিখে পাঠায় ,
—— মন ভেঙে গেলে শব্দ হয় না গো । শুধু এরকম অক্ষরের জন্ম হয় ।
উল্টোদিক থেকে উত্তর আসে না আর । এদিকে সন্দীপনেরও অফিসের সময় হয়ে আসে । তাই বিদায়ী সম্ভাষণ লিখে অফলাইন হয়ে যায় সে এবার ,
—- অফিসের সময় হলো । আজ আবার ফ্ল্যাট দেখতে হবে , থাকার ব্যবস্থা করতে হবে । সম্ভব হলে রাতে অনলাইন আসবো । বাই ….
ওপাশ থেকে তখনও কোন উত্তর এলো না আর ।
২৪।।
এ জি ভোপালের মূল ফটকে পৌঁছানো মাত্রই মিলিত স্বরে চিৎকার শোনা গেল বাইরে থেকে ,
—- গুড মর্নিং ইন ভোপাল ।
তীব্র সে শব্দের কম্পনে থমকে দাঁড়ালো সন্দীপন । পিছন ফিরে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই একত্রে তীব্র স্বরে সকলে গর্জে উঠলো আবার ,
—- ভোপাল মে আপকা সোয়াগত হ্যায় ।
তীব্র এ স্বর কম্পনে সন্দীপন বেশ হকচকিয়ে উঠলো , তারপর , কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সকলের দিকে ফিরে তাকালো আবার ,
—– আরে নিশা , রজত , শামীম , অজিত ; তুম সব আ গয়ে ।
সন্দীপন হাসতে হাসতে উত্তর দিলো ।
—– আ গয়ে !! বহত পেহেলে হি আ গয়ে হম ।
নিশা বলে উঠলো ।
—— তো দাদা মহাকাল ক্যায়সা লগা ?
পাশ থেকে অজিত বলে উঠলো ।
সন্দীপন একগাল হেসে উত্তর দিল ,
—— বরে জোর সে লগা অজিত ভাই ।
রজত হঠাৎ ই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে উঠলো এবার ,
এই টুকু বলেই সে অফিস লঞ্জ ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল আর বাকিরা …. এগিয়ে গেলো লিফটের দিকে ।
২৫।।
সন্ধ্যা ঘন্টা বেজে উঠছে চারদিকে । শঙ্খের গম্ভীর স্বর আজ বিজয় ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করছে বারবার । অন্ধকার আকাশ গঙ্গা জুড়ে বয়ে চলা অমৃত যে তৃষ্ণা তার ধারায় ধারায় বিজয় উল্লাস । সত্য যে সেই তো সুন্দর আর বিজয় তাই তার , সদা সর্বদা ।
ফ্ল্যাটের ব্যাবস্থা হয়ে গেছে । একটু দূরে , আরেরা মার্কেট , ১২ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের কাছে । কাল হ্যান্ডওভার পাওয়া যাবে আর তাই সন্দীপন বেশ ব্যস্ত আজ বিকেল থেকেই । সন্ধের আগে মুক্তির কোন সুযোগ নেই তার ।
সন্ধ্যা তারা তখন শুক হয়ে জ্জ্বলছে আর নিভছে , সুখময় কপালে । ক্লান্তি অন্যদিকে গ্রাস করছে বারবার , তবু মনের কোন এক কোনায় ক্লান্ত চেতনায় শীতলতা এখনো বেঁচে , নতুন মেঘের ইশারায় । ম্যাসেঞ্জারের পাতা খুলে গুটি গুটি পা ফেলে ঢুকে পড়লো সে যখন , তখন কাঁটা দুটো জুড়ে প্রায় নৌনে প ; অর্থাৎ পৌনে ন । নীরব ম্যাসেঞ্জারে সত্যবতী একবার এসে হাই তুলে গেছে , তার ছাপ স্পষ্ট । সন্দীপন গুটি গুটি পায়ে ছেড়ে এলো গোপনে , সেখানেই , মনের শীতলতা ;
” ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস ,
পরান ছেড়ে যাস না উড়ে , যাস না
এ পরানে গাঁ আছে তোর
ওরে মায়ের দুচোখ আজ
বারির জলে ভেজাস না ।
অসময়ি মেঘলা বাতাস
রোদের ঘরে তোর ঠিকানা
আকর ছেড়ে গোটা সৃষ্টিটাকে
আঁধার আকাস আর ছড়াস না ,
ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস
পরের ঘরে যাস না উড়ে , যাস না ।
কত কথা বলতে গিয়েও
পারেনি রাঙা পথের একতারা
তোর ওই দুই চোখে কবিতা আছে
কালো অক্ষরে আজ সব হয়েছে ছন্নছাড়া
মেঘলা বাতাস , একতারে আর মন লাগাস না
ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস
পরের ঘরে যাস না উড়ে , যাস না ।
বৃষ্টি পটে দেখি দু চোখ ভরে
মা আমার আসছে ওই সোনার রথে করে
মেঘলা বাতাস , মনের কোণায় চুপটি করে দেখ
উতল প্রেমে ঝড়ের কথা , আজ আর বলিস না
মা আসছে চারটি দিন , প্রেম গড়া ওই হৃদয় ভাঙিস না
ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস
পরের ঘরে যাস না উড়ে , যাস না ।
মেঘলা আকাশ , তারায় ভরা ,
কবিতার এ ঘর , আজ ভাঙিস না ।
ওরে অসময়ি মেঘলা বাতাস ,
পরান ছেড়ে যাস না উড়ে , যাস না ” ।
তবে পালিয়ে আসতে পারেনি আর । চোর পালানোর আগেই গ্রেফতার করা হলো সত্যের বাঁধনে । তারপর ,
—— বাড়ি পেলে ?
গম্ভীর হয়ে লিখে পাঠালো সত্য ।
—– পেয়েছি । একটু দূরে , আরেরা মার্কেট , ১২ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের কাছে । কাল হ্যান্ডওভার পাওয়া যাবে ।
সন্দীপন উত্তর দিলো ।
—– বেশ । কাল কথা হবে তাহলে । আজ যাও বিশ্রাম করো । অসময়ি মেঘলা বাতাস সঙ্গে থাকলো সবসময় ।
উত্তর এলো ওদিক থেকে । এরপর বেশ কিছুক্ষণ অনলাইন কাটালেও সত্য দেখা দেয় নি একবারও । শেষে সন্দীপনও ঘুমিয়ে পড়লো , মাথায় প্রশ্নটি জড়িয়ে রেখেই ,
শেষ কথাটির অর্থ কি ?
২৬।।
—– নয়ে ঘর মে আপকা সওয়াগত হ্যায়
ব্রোকার মশাই , মিস্টার শেখ এক মুখ হাসি নিয়ে ঘরের দরজা খুলতে খুলতে বলে উঠলেন । তিন তলার ওপরের ফ্ল্যাট । গোকুল আবাসনে ঢুকেই সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি পার করে ডান হাত ঘুরেই সিঁড়ি । তাই ধরে তিন তলার ওপরে উঠে প্রথম ঘর তার । ঢুকতেই সামনে বড় বারান্দা । তার তিন দিক ঘেরা তিনটি কামড়া — একটি কিচেন , একটি স্নানাগার এবং একটি থাকার ঘর । বাইরে সুবিশাল ব্যালকনি । এক কথায় সন্দীপনের সৌদাটি মোটেও খারাপ মনে হয় নি , বিশেষ করে ভোপালের বড় বড়লোকি শহরের বুকে মাসিক ৮০০০ টাকা ভাড়া , ইলেক্ট্রিসিটি আলাদা । বাড়ির মালিক ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করেন , তাই পরিবার নিয়ে বাইরেই থাকেন । ভোপালের ফ্ল্যাটটির সব দায়িত্ব ওই ব্রোকারের হাতেই তাই দিয়ে গেছেন উনি ।
অন্ধকার কামড়াটিতে আলো জ্বেলে দিলো ব্রোকার শেখ । ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে রেখে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই ।
—– মি. সন্দীপন দত্ত , আজ থেকে এই প্রোপার্টি আপনার । ভাড়া নীচে চৌবে জি কে দিয়ে দেবেন । আমি নিয়ে নেবো সময় করে ।
এই টুকু বলে মি. শেখ বিদায় নিলেন ।
ঘরের চারপাশ সন্দীপন ভালো করে দেখতে লাগলো । পাথর বসানো ঘরগুলি তাকে প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ঠ করছে ক্রমাগত । ব্যালকনির দিকে দরজা খুলে সে বাইরে এসে দাড়ালো একবার । পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দুটান দিতে দিতে মাকে ফোন লাগলো সে ,
—– মা , ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা হয়ে গেছে । আমি ওখান থেকেই কথা বলছি ।
—– আমাকে কবে নিয়ে যাবি বাবা । আর যে সহ্য হয় না ।
মা করুন স্বরে উত্তর দিলো ।
—- মা কিছু হয়েছে আজ ? তুমি ঠিক আছো তো মা ?
বেশ উদগ্রীব হয়েই সন্দীপন জানতে চাইলো এবার ।
—– আমার কথা বাদ দে ।
মায়ের কথাগুলো শেষ না হতেই পিছনে দূর থেকে ভেসে এলো কিছু কথা যা সন্দীপন স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন ।
—– তোর মতো দিদির না থাকাই ভালো । অভিশাপ দিলাম তুই মুখে রক্ত উঠে মরবি …
হতাসগ্রস্থ নাবিকের কাছে দুটি পথ জীবিত থাকে । হয় সে সব মেনে নিয়ে নদীর স্রোতে ভেসে চলে যাক কোন অনন্ত গভীর অন্ধকারে , নয়তো ছুটে চলুক সেই অসময়ের মেঘলা বাতাসের পিছনে । মেঘ পিয়নের চিঠি হয়ে উড়ে যাক সে অন্য এক পৃথিবীর খোঁজে । ফেসবুকের পাতাগুলো নেড়ে ছেড়ে দেখতে দেখতে এসব কথা ভাবছে যখন , তখন কোথা থেকে ভাবনা এসে ছেপে দিয়ে গেল মনের কথাগুলো সে নিজেও বোঝে না । হয়তো সত্যকে খুঁজছিল মন , সব বলে দেওয়ার তাড়নায় আর অনুপস্থিত থেকেও সত্য খুঁজছে তাকে কিছু শুনতে মুখ থেকে তার ।
—– পড়াশুনা করছিস । পরীক্ষা কিন্তু দেখতে দেখতে চলে আসবে ।
সমরেশ ওপাশ থেকে বলে ওঠে ।
—– ও হয়ে যাবে । সময় আসুক সব হয়ে যাবে ।
বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে সন্দীপন উত্তর দেয় ।
বন্ধুর উত্তর শেষ হতে না হতেই , সমরেস বেশ গম্ভীর গলায় বলে ওঠে ,
—– এত সহজ নিও না । এই পরীক্ষাটা এত সোজা নয় । আমাদের অবস্থাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।
সন্দীপন , সমরেসের কথায় হেসে উঠে বলে ,
—— বেশ তো । ট্রেনিংটা শুরু হোক । দেখিই না কত কঠিন …. নিজের সাথে সকলের তুলনা করছিস কেন ?
—— যা ভালো বুঝিস কর । আমার বোঝানোর তাই বললাম ।
এই বলে ফোন কেটে দেয় সমরেস তার । এদিকে সাড়ে আটটা বাজছে , সন্দীপনও রাতের খাবার আনতে বের হবে বলে ল্যাপটপটি গুটিয়ে রেখে জামা প্যান্ট পড়তে উঠে পড়ে । দুই বন্ধুর বেড়ে যাওয়া প্রতিটি মুহূর্তের মাঝে ভালোবাসা বসে থাকে , কবিতা হয়ে । ভিজানো ল্যাপটপ জানে শুধু আজ ভালোবাসা উপস্থিত অনুপস্থিত কিছু চেনে না ; শুধু সাজানো অক্ষর জাল বন্দি হয়ে রয়ে যায় আমরণ …
” একগুচ্ছ জনতার ভিড়ে আমি একলা
অনেকের কথায় বোকা , তাই পারিনি আজও
জীবনের পূর্ণগোলক এঁকে দিতে ।। হয়ত ওরা কিছুটা ঠিকই বলে ,
কিন্তু যেটুকু জানে সেটুকুই বলে , যেটা জানেনা সেটা হল
রাজকন্যার সামনে দাঁড়িয়েও বলতে পারিনি আজও
খাঁটি হৃদয়ের খাঁটি তিনটে কথা ।।
বাড়ির কাছেই বিশাল ঝিল আছে , জলের ধরে কত পাখি
রোজ বসে আড্ডা দেয় , খেলা করে ।। সেদিন নজরে এল
দুইজন দূরে একলা বসে ।। ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে উপভোগ করছে
ভালবাসার মুহূর্ত ।।
এরকম কত তো রয়েছে , চোখ খুলে তাকালেই দেখা যায়
গাছে গাছে , পাতায় পাতায় , জলের স্রোতে , হাওয়ায় হাওয়ায় —
সবাই পেরেছিল বলতে ।। শুধু আমি ছাড়া ।।
সূর্যের অস্তগামী চেহারার পিছনে অন্ধকার নেমে আসছে ,
ঠিক যেন ঝড়ের পূর্বাভাস — ফিরতি পাখিদের দলে আমরা দুজন ;
চলো না মনের কথা শেষবার বলে ফেলা যাক ।।
তোমার জানি অভাব নেই কোন ,
খুঁজলেই ভাল ছেলে পেয়ে যাবে অনায়াসে :
সমস্যাটা আমার ; বলেই দেখি অন্তত যদি কোন পেত্নিও
জুটে যায় শেষমেস ।। “
২৭।।
রাত কেটে সকাল হলো । সূর্যের আলোতে ভরে উঠেছে পৃথিবী । এক নতুন সূচনার মধ্যেই নিজেকে মেলে ধরতে উড়ে চললো দিন । প্রতিদিনের নিয়ম করে হয়ে চলা ক্লাস ক্লান্ত করে তুলছে নায়কের জীবন যখন , তখন হঠাৎই একদিন সন্ধ্যায় ডাক এলো তার বাক্সে । যে সে ডাক নয় গো এ , মেঘ পিয়নের চিঠি এসেছে আজ । এক মুহূর্তে চারিপাশ ভরে উঠল সবুজে । গেরুয়া হৃদয়ে এ হেন পরিবর্তন জীবন স্রোতে নতুন আর নতুন এ বসন্তে প্রাণ চঞ্চল না হয়ে কি পারে ! আকন্ঠ নেশায় টলমল চারিপাশ আজ চরম নেশার্ত । প্রতিটি চুমুকে এক চরম আনন্দের অনুভূতির স্পর্শ । এরই নাম হয়তো ভালোবাসা ; এক অজ্ঞাত ভালোবাসা ।
—– এই দেবী কে ?
ম্যাসেঞ্জারে ভেসে আসা প্রশ্নটিতে রীতিমত চমকে উঠলো সন্দীপন । তবু কিছু না বোঝার ভান করেই উত্তর দিলো ,
—— কে দেবী ?
—— ওই যে যার জন্য এতদিন ধরে প্রেম পত্র লিখে চলেছো ।
উত্তর দিলো সত্যবতী ।
সন্দীপন কিছুই ভেবে পাচ্ছে না কি উত্তর দেবে সে আজ । যার জন্য এত দিনের প্রচেষ্টা তার , সেই যখন ঘুরিয়ে প্রশ্ন করছে , তখন সত্য বলে দেওয়ার সাধ্যি নেই তার । তবু অনেক ভেবে বেশ কায়দা করেই লিখে পাঠালো সন্দীপন ,
—— তুমি জেনে কি করবে ? সে যেই হোক না ।
সত্যবতী একটুও সময় নষ্ট না করে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলো ,
—– আমি কিছুই করবো না । শুধু বলছিলাম যে প্রেম পত্রগুলি যার তাকে পাঠিয়ে দিন ।
সন্দীপন দৃঢ় নিশ্চিত এ কথায় , যে , সত্য সব বুঝে গেছে , এবং হয়তো সেও চাইছে এটা সফল হোক । তবু সাহস করে লিখে পাঠালো সে ,
—– ঠিকানা জানলে পাঠিয়ে দেবো ।
কিন্তু ততক্ষণে সত্য অফলাইন হয়ে গেছে । উত্তরখানা পড়ে আছে উত্তরপত্রে আজ , প্রশ্ন যত রয়ে গেছে অতৃপ্ত হৃদয়ে । ভালোবাসা এমনই , শেষ না হলে তৃপ্তি হয় না একফোঁটাও । রাতের খাবারের খোঁজে বেড়িয়ে আসা ছেলেটির মাথায় তাড়া । প্রেমিকার উত্তর না শুনে ঘুমও আসবে না , সেখানে এ তো সামান্য খাওয়া ।
অনেক রাত অবধি সন্দীপন আজ অনলাইন উপস্থিত । আসলে নিজের উত্তেজনা কমাতে ইউটিউব থেকে গান শুনে চলেছে সে । এরই মাঝে কৃষ্ণদীপের গল্পটা ভীষন মনে পড়ছে । ফেসবুকেই প্রথম পরিচয় ওদের , সূত্র সেই লেখা । বাড়ি এই মধ্যপ্রদেশেই । ভোপালে আছে শুনে , সন্দীপনের সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল দুদিন আগে , ফোন করে । সন্দীপনও রাজি হয়ে যায় ।
লোয়ার লেকের ধারে দুপুরে প্রায় ঘন্টা তিনেক জমিয়ে আড্ডা হয় । সন্দীপনের মেয়েটিকে নিয়ে গড়ে ভাবনা দেখে সে নিজের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিল ,
—– দাদা ভালোবেসেছো বলে নিজেকে বিকিয়ে দিও না । নিজের জন্য রেখে দেওয়া এক একটা সময় তোমার । আমিও একই ভুল করেছিলাম , আর তারপর পরিণামটাও পেয়েছিলাম । প্রায় চার বছর শ্রীতমার পেছন পেছন ঘুরেছিলাম কলেজে থাকতে । তখন আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র । মর্নিং কলেজ , তাই ভিড় কম । সাত জনের সেই ব্যাচে মেয়েটিও ছিল । সময়ের সাথে সাথে ওর ওপর একটা টান জন্মায় । আমাদের প্রথম কথা হয় ওর জন্মদিনে । ওকে একটা কানের দুল উপহার দিয়েছিলাম । তারপর থেকে ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম , অবশ্য আমার চোখে সে আমার ভালোবাসা হয়ে উঠেছিল । যা বলতো তাই করতাম । এক রকম ওর পোষা কুকুর হয়ে উঠি আমি । আর সে নিজের বয় ফ্রেন্ড আছে এই একটা কথাতেই আটকে থেকে গেছিল । দাদা , এসব থেকে বেড়িয়ে আসতে চার বছর লেগেছিল আমার । আজ মাঝে পর্বজুড়ে শুধু কান্না , দুঃখ আর বুকফাটা হাহাকার ।
আজ মনে হয় দাদা কত বোকামি করেছিলাম সেদিন । ও যেদিন প্রথম না বলেছিল সেদিনকেই সরে আসা উচিত ছিল আমার । যাই হোক আমি পারিনি , তাই তোমাকে বলবো , ভালোবেসেছো বলে ফেলো , তবে উত্তর যদি না হয় , তাহলে সরে এসো ।
তার কথাগুলো সন্দীপনের মনে পড়তেই , সে কেমন যেন ভেঙে পড়লো । যদি সত্যিই না বলে দেয় , তাহলে …. হয়তো সরে আসবে সে কিন্তু নতুন করে এগিয়ে যেতে পারবে তো যে কোন পথেই । ল্যাপটপ ছেড়ে বাইরের ব্যালকনিতে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে এবার ।
২৮।।
রাত গভীর হয়েছে এখন । আকাশের চাঁদ জ্বলে উঠেছে আকাশে । তার খণ্ডিত আলোর লাইট হাউস দাঁড়িয়ে একাকি , পথভোলা পথিককে নতুন পথের সন্ধান দিতে । অসহ্য অন্ধকার অসহায় করে দেয় জীবন যখন , তখন নতুন নতুন প্লট লেখা হয় বিধাতার কলমে । জন্ম হয় নতুন প্রেমের , ভাঙন ধরে অনেক হৃদয়ের আর প্রতিটি জন্ম ও ভাঙনের পিছনে লেখা হয় এক একটা গল্পের ; যা শুধু লেখক জানে , দৃশ্যপটে দৃষ্ট হয় বিদ্যুতের ঝলকানির মতো ।
সময়ের হিসেবে এখন রাত এগারোটা । ফেসবুক খুলে বসলো সন্দীপন আবার । মনের ভেতরটা উৎসুক । আনচান এ অবস্থায় ঘুম আসে না । সত্যবতীকে অনলাইন দেখে মনে হল , সেও একই তীরে বিদ্ধ আজ । সাহস করে লিখে পাঠালো সে ,
—– এত রাতে জেগে আছো যে ।
সত্য কয়েক মিনিট সময় নিয়ে শুধু একটি হু লিখে নীরব হয়ে গেল আবার । সন্দীপনের মন কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছে না । এক একবার মনে হচ্ছে সব সত্যিকথা বলে দিই তাকে ; কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে কই ! উৎসুক অবস্থা আর শঙ্কার দোলাচলে সে যখন বাঁধা পড়েছে তখন হঠাৎই ওপাশ থেকে ভেসে এলো কিছু ম্যাসেজ আবার ,
সন্দীপনের মুখে এক অদ্ভুত আনন্দ ফুটে উঠলো এবার । কিন্তু পরক্ষনের গভীর নীরবতা তাকে দমিয়ে দিলো আবার । সে ভেবে পাচ্ছে না কোন সে উত্তর আসতে চলেছে এর পর ।
মিনিট পাঁচেকের নীরবতা ভাঙলো আবার একটি প্রশ্নে ,
—- বাড়িতে সব বলে দিয়েছি । ওরা ইচ্ছুক তবে সমস্যা একটাই ।
সন্দীপন তৎক্ষনাৎ লিখে পাঠালো ,
—– কী ? কী সমস্যা ?
উত্তর এলো না আর । প্রায় মিনিট দশেক ওই ভাবেই বসে রইল তারা । তারপর ভেসে এলো একটা প্রশ্ন সন্দীপনের দিকে ,
—— তুমি কি কোনদিন বাঙলায় ফিরবে না আর । ফিরে এসো প্লিস ।
সত্যবতীর করুন এ মিনতি সন্দীপন ফেলে দিতে পারছে না কিছুতেই । কিন্তু …. পরন্তু সব ভেবেই সে লিখে জানালো ,
——- ফিরে আসা এত সোজা নয় ; মিউচুয়াল ট্র্যান্সফার পাওয়া খুবই কঠিন । তবু সে আপ্রাণ চেষ্টা করবে । বাকি ঈশ্বর যা চান ….
—— আমি তোমার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবো । অপেক্ষা করবো তোমার ।
সত্যবতী উত্তর দিলো ।
সেই আনন্দের মুহূর্তটুকু সন্দীপন মিস করতে চাইনি সেদিন । সে সত্যবতীর কাছে একবার ফোন করার আবদার করে বসলো । কিন্তু সত্যবতী সব কিছু একদিনে হোক এমন চাইনি । সে সন্দীপনকে লিখে জানায় ,
—— মা পাশেই বসে আছে । আজ নয় তাই । কাল আমার ক্লাসে যাওয়ার পথে আমি তোমায় কল করে নেবো । তুমি বরং নিজের ফোন নাম্বারটা আমায় দাও ।
সন্দীপন , সত্যবতীকে বিশ্বাস করে ফোন নম্বর টি ম্যাসেঞ্জারে ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো এক বুক তৃপ্তি নিয়ে ।
পরেরদিন সকালকে আর কড়া নাড়তে হয়নি সন্দীপনের দরজায় , সূর্যের অনেক আগেই সে ঘুম থেকে জেগে গেছে । ভালোবাসা বোধহয় এমনই , মানুষকে পুরোপুরি পাল্টে দেয় নিমেষের মধ্যে । ঘড়িতে তখন সাতটা বাজে । এক একটা মিনিট সন্দীপনের কাছে এক একটা দিন মনে হতে লাগল । উপায় না পেয়ে সে তার কবিতার খাতা খুলে কয়েক লাইন লিখে নিজের চাপ হালকা করতে চাইল ;
” আজ সূর্য আমার দরজায় আসেনি
আমি সূর্যের দরজায় বসে আছি
একটা মেঘ পিয়ন ফিরবে এই পথেই
তাকে বৃষ্টি করে নিয়ে যাবো বলে “।
লেখাটা তখনও শেষ হয়নি তার , হঠাৎ বেজে ওঠা মোবাইলের শব্দে ধ্যানভঙ্গ হল সন্দীপনের । ঘড়িতে ঠিক নটা আর ফোনে একটি আননোন নম্বর । ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ের গলা ভেসে এল
—- হ্যালো , সন্দীপন । আমি সত্যবতী বলছি ।
নামটা শোনামাত্রই সে কেমন যেন নিথর হয়ে গেল । সন্দীপন ভাবতে পারছে না , যে মুহূর্তের জন্য এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা তার , সেই মুহূর্ত অবশেষে উপস্থিত তার কামরায় । কি কথা বলবে কিছুই বুঝতে পাচ্ছে না সে , ওদিকে ওপাশ থেকে ভেসে আসছে সত্যবতীর উৎকণ্ঠা ভরা কণ্ঠস্বর ,
—– হ্যালো । শুনতে পাচ্ছো আমায় ।
ছেলেটি দুবার জোরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবার জানান দিলো যে সে সত্যবতীর সঙ্গেই আছে । এরপর প্রায় ঘন্টাখানেক পার হল । কিছু প্রেম আদান প্রদান আর অনেকটা প্রথম পরিচয়ের আলাপ চারিতা চললো ওদের মধ্যে । তাদের চোখ , মুখের হাসি আর শরীরের ভঙ্গিমা দেখে একটা জিনিস অনায়াসেই বলা যেতে পারে , ইটস দা স্টার্টিং অভ আ লাভ স্টোরি ।