• Uncategorized
  • 0

সম্পাদকীয়

বিদ্যাসাগর২০০/বিশেষ সংখ্যা

একটি না সম্পাদকীয়

দুশো বছর! হ্যাঁ,দুশো বছর পরেও আমরা তাঁর জন্মদিন এলেও তাঁকে ‘দয়ার সাগর’, ‘করুণা সাগর’,’মাতৃভক্ত’, ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বেশ একগ্লাস জল চোঁ-চাঁ পান করে একটা চোঁয়া ঢেকুর তুলে নিজেই নিজের প্রশংসা করে ধন্য হবো। ফেসবুকে ছোট্ট  বিদ্যাসাগরের ছবিকে পাশে রেখে নিজের বিশাল একটি ছবি আপলোডাবো। কেউ আবার বলবেন,তাঁর পায়ের কাছে বসে দুদণ্ড তাঁকে ভাবতে পেলে ধন্য হই।তাঁর নাম উচ্চারণ করলে অন্তরাত্মা শুদ্ধ হয়।তৈরি থাকুন বছরভর এসব শুনতে, দেখতে হবে। তারপর আবার যেই কে সেই । সেই আবার ধুমধামে নারী দিবস,কন্যা দিবস, হেন দিবস,তেন দিবস করে দিনকে দিন আমরা আরো আরো দীন হয়ে যাবো। গত দুশো বছরের মধ্যে যদি আর দুয়েকজন বিদ্যাসাগর পেতাম আমরা – বলে হাহুতাশ শুনতে পাবেন। আবার সমাজের স্থিতাবস্থার বা কুসংস্কার বা অশিক্ষার বিরুদ্ধে আপনি যদি মুখ খোলেন, তবে আপনাকে শুনতে হবে,’শালা, বিদ্যাসাগরের বাচ্চা’! আমাদের কর্মে ও চেতনায় বিদ্যাসাগর থেকে যাবেন অধরাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ প্রবন্ধে সেই কবে লিখেছিলেন,
“তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ হয়ে আছেন বিদ্যাসাগর সেই যুগকে ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।” -কবিগুরু তো ছিলেন দার্শনিক, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা! তাঁর কথা যে কতখানি সত্যি, তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি একা এক স্থবির সমাজে গতি আনতে গিয়ে আজীবন কষ্ট করে গেছেন। ঐ প্রবন্ধেই কবিগুরু লিখলেন,
” তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়েছেন।তিনি সুখী ছিলেন না;”
ভারতের নবজাগরণ পথের প্রথম পথিক রাজা রামমোহন রায়ের থেকে তিনি প্রায় ৪৫ বছরের ছোট ছিলেন।প্রায় একা সমাজপতিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে রামমোহন নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে সক্ষম হলেও সমাজে তখনও প্রগাঢ় অন্ধকার। একেকজন কুলীন ব্রাহ্মণ নাকি  ৭০ থেকে ৮০ টা পর্যন্ত বিয়ে করত! আর পাত্রীদের বয়স কত ছিল জানেন?  সাত-আট বছর মাত্র!
আর পাত্রের বয়স সত্তর থেকে আশি হতেও পারতো,কিংবা ঘাটের মড়া হলেও চলতো। শিশু বয়সে মেয়েদের বিয়ে না দিলে একঘরে হওয়ার ভয়ে বাল্যবিবাহ প্রথা তখন সমাজে গেড়ে বসেছে। মেয়েদের পড়াশোনা করা ছিল নিষিদ্ধ। সার্বজনীন শিক্ষা বলতে টোল আর কিছু চতুষ্পাঠী। জীর্ণ এই সমাজ ধর্মান্ধতা, কুপমণ্ডুকতা, কুসংস্কারে আবদ্ধ। এইসময়েই তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে এক অসমসাহসী কাজের সূচনা করেছিলেন। না,সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি ধর্মের আশ্রয় নেননি, নিজে গিরু হয়ে বসেন নি।তাঁর কাজ ছিল মানবতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং ধর্মীয় চিন্তামুক্ত।ভারতের গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন শিক্ষার চারাগাছটি তিনি স্বহস্তে রোপণ করেছেন, লালন করেছেন। তারজন্য সারাজীবন কষ্ট সহ্য করে গেছেন, তারপর একদিন সবকিছুতে লাথি মেরে কার্মাটাঁড়ের আদিবাসীদের মাঝে শান্তি পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি চুপ করে বসে থাকতে পারেন নি।অসুস্থ মানুষগুলির জন্য হাতে তুলে নিয়েছেন হোমিওপ্যাথি ঔষধের বাক্স। না,এই সমাজ,সংসার, পরিবার কেউ তাঁকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি।আর,তাতে তাঁর বয়েই গেছে।তিনি শান্তি খুঁজেছেন সমাজের মানুষের জন্য কিছু করার মধ্যে।
আমাদের দেশের নারীরা অনেকে এখনো তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর পুজো করেন কিন্তু তিনি নারীদের জন্য, মায়েদের জন্য,মেয়েদের জন্য যা যা করেছেন, তাতে ঐ দেবদেবীর মধ্যে তাঁর স্থান হওয়া উচিত ছিলো সবার আগে। কিন্তু তিনি তো নিজেই ধর্ম থেকে লক্ষ লক্ষ যোজন দূরে অবস্থান করতেন, তাই তিনি সেসব কিছু না ভেবে গোটা সমাজব্যবস্থার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে  আমাদের দেশের  নারীদের জন্য নারী শিক্ষা, বাল্যবিবাহ রোধ ও বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন।
বিদ্যাসাগর তাঁর জীবন ও কর্ম দিয়ে যে শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন আমরা তার কতটুকু স্মরণে রেখেছি। প্রশ্ন করুন, নিজেকেই প্রশ্ন করুন। বারবার প্রশ্ন করুন।
ভারতের অন্তরাত্মা হওয়ার কথা ছিল যাঁর, যাঁর জন্মদিনেই যথার্থ শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হতে পারতো, তিনি কেন আজও বাঙালি মনীষী হয়েই থেকে গেলেন?  তিনি ছাড়া আর কে ভেবেছিলেন,
‘এমন শিক্ষক চাই  যারা বাংলা ভাষা জানে,ইংরেজি ভাষা জানে আর ধর্মীয় কুসংস্কার মুক্ত। ‘
নানা ভাষার দেশে ‘বাংলা ভাষা’র জায়গায় পড়ুন মাতৃভাষা। তাঁর এমন শিক্ষক পাওয়ার স্বপ্ন কি পূরণ করতে পেরেছি আমরা?
আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার বিকাশে তাঁর উদ্যোগ সকলেরই জানা। কবিগুরু বলেছেন,
‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ  শিল্পী ছিলেন।’
তাঁর মত কজন বলেন, বলতে পেরেছেন স্পষ্ট ভাবে? হ্যাঁ,বিদ্যাসাগর পেরেছিলেন। সেই সময়ে তিনি লিখিত আকারে বলেছিলেন, ‘বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শন ভ্রান্ত ‘। প্রমথনাথ বিশী-র মতে-
‘আমার তো মনে হয়,প্রকাশ্যে বেদান্তকে ভ্রান্ত দর্শন ঘোষণা করাই  দুঃসাহসী বিদ্যাসাগরের দুঃসাহসিকতম কার্য, তুলনায় বিধবাবিবাহ সমর্থন বা বহুবিবাহ -প্রতিকূলতা নিতান্ত ছেলেখেলা ;ঐ এক উক্তির দ্বারা তিনি ভারতের বহুযুগসঞ্চিত সংস্কার ও অহম্মন্যতার মূলে আঘাত করিয়াছেন।’
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যেকথা বলেছেন আসুন আরও একবার চোখ বুলিয়ে নিই, সেই কথাগুলিতে–
‘… বস্তুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এত বড় ও আমরা এত ছোট,তিনি এত সোজা ও আমরা এত বাঁকা যে,তাঁহার নাম গ্রহণ আমাদের পক্ষে বিষম আস্পর্ধার কথা বলিয়া বিবেচনা হইতে পারে…।  বাঙালী চরিত্র ইতিহাসে যে স্থান লাভ করিয়া আসিয়াছে, বিদ্যাসাগর চরিত্র তাহা অপেক্ষা এত উচ্চে অবস্থিত যে, তাঁহাকে বাঙালী বলিয়া পরিচয় দিতেই কুণ্ঠিত হইতে হয়।’
একটি মানুষ আজীবন হাঁটুর উপর কাপড় পরে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, মানুষের জন্যই শাস্ত্র।জীবনে কাউকে পরোয়া করেন নি।নিজের লক্ষ্যে ও কর্মে অবিচল থেকে মানুষের জন্য,সমাজের জন্য আমৃত্যু শুধু কাজ আর কাজ করে গেছেন। নিজের ক্ষুদ্রস্বার্থের কথা ভাবেন নি কোনোদিন।
না, তিনি খাটোধুতি পরলেও জাতির পিতা নন,শিক্ষা বিস্তারে যতই তিনি কাজ করে যান না কেন, তাঁর জন্মদিনে শিক্ষক দিবস উদযাপিত হবে না। আসলে কি জানেন,তিনি তো জীবনেও ধান্দাবাজি করেন নি। খ্যাতি,পুরস্কার, অর্থ কোনোকিছুরই তিনি তোয়াক্কা করেন নি।
আর আমরা!আসুন, আরো বেশি বেশি মাচা ও প্রচার পাওয়ার চেষ্টা করি। আর শুনি ‘ওসব বিদ্যাসাগর করে বা মারিয়ে কী হবে!’  হ্যাঁ,বক্রোক্তির মতো এসব উক্তি শুনলেও সমাজে একদল মানুষ আছেন এখনো, আছেন। তাঁদের আদর্শ বিদ্যাসাগর। তাঁদের ‘ঈশ্বর’ গ্রামের মাটি থেকে উঠে আসা এক রক্তমাংসের মানুষ। তা,তোমরা যতই মূর্তি ভাঙো কিংবা গড়ো, আমরা তো জানি, ‘ঈশ্বরন্দ্র ঈশ্বর ছিলেন না’,ছিলেন মানুষ। আর এই মানুষটির জন্য আমাদের আহ্বানে যাঁরা কলম ধরলেন, লেখা পাঠালেন তাঁদের সকলকেই আমাদের শ্রদ্ধা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।