• Uncategorized
  • 0

লক্ষ্মীকে চিঠি লিখলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

সুজনেষু 
সব ব্রতীদের উদ্দেশ্যে আমার এই চিঠি। আমি আজ জেগেই থাকব সারাটা রাত। যতক্ষণ না পূর্ণিমার চাঁদ ডুবে যায় আকাশের মধ্যে। যতক্ষণ না আমার চোখের পাতা ক্লান্ত হয়। যতক্ষণ না আমি তার দেখা পাই। কেউ ঘুমিওনা আজ রাতে। ঘুমিয়ে পড়লেই আমার শব্দ শুনতে পাবে। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আমি চুপিচুপি বলব “জাগদেরহো”! আমার ঘুম নেই চোখে। আর আমিও ঘুমোতে দেবনা কারোকে। শারদপূর্ণিমা আমার যে ভীষণ প্রিয়। আশ্বিন-কার্তিকের এই পূর্ণিমার সময় বর্ষা ঋতু ফিরে যায় একবছরের মত। মৌসুমীবায়ু বিদায় নেয়। শস্যশ্যামলা মাটিতে নতুন আউস ধানের গন্ধ ওঠে। তোমাদের ঘরে ঘরে পরব আর আমি তখন কোজাগরী। আমার তখন কৌমুদী-উৎসব। চাঁদের আলোয় তখন আমার রাত পরিক্রমার শুরু। আমি কোজাগরী হয়ে দেখব কে আমাকে চায়। কে আমার পালন করে। কে আমাকে বেঁধে রাখে আজীবন। জানো? আমরা দুই যমজ বোন। লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মী। আমার সব সোজাসাপটা, সাধাসিধে। আমার ধীরস্থির চলনবলন। আমি শান্তশিষ্ট, বেশী আওয়াজ আমার নাপসন্দ। বেশী খাওয়া দেখলেই আমার বমি আসে। আমি মিষ্টি, দুধের খাবার পছন্দ করি। আর আমার বোন অলক্ষ্মীর সব উল্টো। সে যেমন কলহপ্রিয়া তেমনি কোলাহল প্রিয়া। সে বড্ড বেশী খায় আর যতসব টক, ঝাল আর বিদঘুটে সব খাবার তার পছন্দের। সে যেমনি বাচাল তেমনি চঞ্চল। আমাকে ছাড়তে নাছোড় সে। আমারো খুঁতখুঁতানি থাকে তাকে নিয়ে। নিজের সংস্কারটা শুদ্ধ রাখতে চাই যে! ওর সঙ্গদোষে যদি আমি খারাপ হয়ে যাই! ভয় হয়। অলক্ষ্মী যেমনি হোক, আমার আশেপাশেই থাকে। বোন তো! ফেলতে পারিনা, গিলতেও পারিনা তাকে। তবে আমার দাপটে সে একটু হলেও চাপে থাকে সর্বদা। সাধারণ মানুষ বিষ্ণুর অবতারত্ব নিয়ে কতকিছু বলে কিন্তু আমি মেয়ে বলে আমার কথা কেউ বলেনা। আমি ত্রেতায় রামের সহধর্মিণী সীতা, দ্বাপরে কৃষ্ণের পত্নী রুক্মিনী। পুরাণে বলে সমুদ্রমন্থনের সময় ক্ষীরসাগর থেকে পদ্মফুল হাতে আমি উঠে এসেছিলাম। তাই আমার অপর নাম পদ্মা। আমি আবার নাকি পদ্মফুলে বসি তাই আমার নাম কমলা। আমি বিষ্ণুর প্রেমিকা তাই আমার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। এমন সব কত আদরের, আহ্লাদের নাম আমার। সমুদ্রমন্থনের সময় উঠে এসেছিলাম তাই কেউ আমায় বলে সমুদ্রকন্যা। কেউ আবার ডাকে ভূদেবী অর্থাত সারা পৃথিবীর, সমগ্র প্রকৃতির পালনকর্ত্রী নাকি আমি। ঐ দ্যাখো সকলেই বলে “বিশ্বরূপস্য ভার্য্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে সর্বতো পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী নমোহস্তুতে” তবুও দেখো আমার না আছে পিতামাতা। না আছে স্বামীসন্তানের সুখ। তাই তো আমি সেই দুঃখ ভুলে গিয়ে জগতের পালন করতে তোমাদের ধনদৌলত আগলাতে সর্বদা ব্যস্ত থাকি। আমার আর কে আছে তোমরা ছাড়া!  আর কোজাগরীর দিনে মানে বছরের ঐ একটি বিশেষ পূর্ণিমা তিথিতে আমার কাজ হল ঘুরে ঘুরে দেখা কোথায় নষ্ট হল ধান, কার গৃহে অলক্ষ্মী বাস করল, কে খেতে পেয়েও রাখতে পারলনা আর কে তিলতিল করে সঞ্চয় করে ঘরে আনল লক্ষ্মী। উজ্জয়িনীর এক ধার্মিক রাজা তাঁর প্রজাপালনের জন্য খুব সুখে কাল যাপন করতেন। একবার তিনি ঢেঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন যে তাঁর রাজ্যের হাটে কোনো অবিক্রিত জিনিষ যেন না পাড়ে থাকে। দিনের শেষে তিনিই সেই জিনিষটি কিনে নেবেন দোকানীর কাছ থেকে। রটে গেল খবর। জানা গেল এক কামারের কাছে এক ভয়ানক চেহারার বিশ্রী নারীমূর্তি পড়ে রয়েছে। কামারকে জিগেস করতেই সে বলল, মহারাজ এটি নাকি অলক্ষ্মী মূর্তি তাই কেউ কিনতে চাইছেনা। মহারাজ বললেন, তিনি যখন কথা দিয়েছেন তখন সেটি কিনে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন। নয়ত অধার্মিক রাজা হিসেবে তাঁকে রাজ্যের মানুষ চিনে যাবে। রাজা অগত্যা সেই লোহার মূর্তিটি কিনে এনে নিজের ঠাকুরবাড়িতে তাকে আশ্রয় দিলেন। মাঝরাতে নিজের রাজপুরীর মধ্যে মেয়েলি কান্নার কন্ঠস্বর শুনে রাজা দেখতে পেলেন এক ক্রন্দনরতা নারীমূর্তিকে। রাজা তাকে জিগেস করলেন” তুমি কাঁদছো কেন মা?” সেই নারী বললে,” মহারাজ, আমি আপনার রাজলক্ষ্মী, আজ আপনার বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি” রাজা বললেন, কেন মা? আমি কি অন্যায় করেছি? জানতে পারি? “সেই নারীমূর্তি বললে,” আপনি রাজবাড়িতে অলক্ষ্মীকে ঠাঁই দিয়েছেন। অতএব আমি আর এখানে থাকতে পারবনা।” এই বলে অন্তর্হিতা হলেন। আবার কিছুপরে রাজা দেখলেন আরেক সুন্দরী, সুশীলা নারী প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে হল ভাগ্যলক্ষ্মী। তার কিছুপরেই যশোলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মী, সকলেই একে একে রাজপুরী থেকে বিদায় নিল। রাজার সেরাতে ঘুম এলনা। এবং সকলেরি বিদায় নেবার কারণ হল সেই অলক্ষ্মীমূর্তিটি যেটি রাজা কিনে এনেছিলেন। এভাবেই তাঁর দিন কাটে। তবুও শিল্পীর হাতে বানানো সেই অলক্ষ্মীমূর্তিটি ফেলে দিতে রাজার মন চায়না। শিল্পীতো আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরী করেছে তাকে। শিল্পীর শিল্পীসত্তায় আঘাত করতে মন চায়না রাজার। তাই প্রাসাদ থেকে একটু দূরেই সরিয়ে রাখেন তাঁকে কিন্তু ফেলতে পারেন না। ক্রমে তিনি দরিদ্র হতে থাকলেন। ধন, মান, যশ, সাফল্য ভাগ্য তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। একদিন রাজা দেখতে পেলেন ধর্মরাজ তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রাজা তখন নিরূপায় হয়ে ভাবলেন এটা মেনে নেওয়া যায়না। ধর্ম তাঁকে ত্যাগ করলে তিনিতো অধার্মিক রাজা রূপে পরিগণিত হবেন। রাজা তখন ধর্মকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। ধর্মরাজা রাজার যুক্তি শুনে খুব খুশি হলেন। ধর্মরজের কথায় আশ্বিনমাসের পূর্ণিমায় রাণীকে কোজাগরী ব্রত পালন করতে বললেন। রাণী সারারাত জেগে বসে রইলেন। আর নিষ্ঠাভরে লক্ষ্মীর পুজো করে রাজা সব ফিরে পেলেন। আবার আগের মত তাঁর রাজবাড়ি ভরে উঠল জাঁকজমকে, ধনসম্পত্তিতে। এইগল্পটা শুনে তোমরা বলবেতো নিজের ঢাক নিজে পেটালাম? আসলে কি জানো? আমি তো চাই তোমাদের ঘরে আটকে থাকতে। তোমাদের ভালোর জন্যে অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি সব দিয়ে তোমাদের ধনী করতে। কিন্তু তাই বলে অলক্ষ্মীর জন্যে সত্যকে, অধর্মকে তো আর মেনে নিতে পারিনা। ঐ রাজার চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো গুণ হল তিনি সত্‌ এবং ধার্মিক। আর তাইতো ধর্মরাজা সবকিছু ফিরিয়ে দিলেন রাজাকে। অলক্ষ্মীর প্রতিও অবিচার করেননি রাজা আর শিল্পীর প্রতি তো নয়ই। আমার জীবনের কত গল্পের কথা আর বলি তোমাদের? নারায়ণের পাশে আজীবন সদা সুহাসিনী লক্ষ্মীকে দেখে তোমরা ভাবো এই দম্পতির কত সুখ! আদর্শ স্বামীস্ত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে শোনো আমার সপত্নীর সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গল্প। কত ঝড় বয়ে গেলে একটা মেয়ে লক্ষ্মীমেয়েতে পরিণত হয় দ্যাখো তোমরা! কত অসহনীয় টানাপোড়েন একজন নারীকে লক্ষ্মী করে তোলে! পুরাণের আরেকটি গল্পের মতে সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং গঙ্গা ছিলেন বিষ্ণুর তিন পত্নী। বিষ্ণু কিন্তু গঙ্গার প্রতি একটু বেশিমাত্রায় আসক্ত ছিলেন। নম্রস্বভাবের লক্ষ্মী এই ঘটনায় মনে মনে খুব দুখঃ পেতেন কিন্তু কিছু প্রকাশ করতেন না। সরস্বতী কিন্তু বিষ্ণুর এই অতিরিক্ত গঙ্গাপ্রেমকে প্রশ্রয় না দিয়ে অশান্ত এবং রুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। একদিন তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। প্রচন্ড উগ্রমূর্তি ধরলেন তিনি। গঙ্গার মুখোমুখি হলেন। লক্ষ্মী একটি ভয়ানক কলহের পূর্বাভাস পেয়ে সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন । সরস্বতী লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিয়ে একটি গাছে পরিণত করলেন। লক্ষ্মী আবার সেই অভিশাপে প্রচন্ড আঘাত পেয়ে সরস্বতীকে নদীতে রূপান্তরিত করলেন। সরস্বতী নিজেও তখন উগ্রচন্ডা। নিজে নদীতে পরিণত হয়েছেন বলে গঙ্গাকেও নদী হতে অভিশাপ দিলেন। ইতিমধ্যে বিষ্ণু সেইখানে হাজির হলেন। এতসব ঝগড়া বিবাদ দেখে ও শুনে স্থির করলেন সরস্বতী ও গঙ্গার সাথে আর নয়। এখন থেকে তিনি কেবলমাত্র লক্ষ্মীর সাথেই ঘর করবেন। সরস্বতীকে ব্রহ্মার হাতে এবং গঙ্গাকে শিবের হাতে সমর্পণ করে বিষ্ণু হলেন লক্ষ্মীর প্রিয় পতিদেবতা। আর সরস্বতী ও গঙ্গার ওপর এরূপ অন্যায় শাস্তির জন্য লক্ষ্মী মনে মনে ব্যথিত হলেন আবার বিষ্ণুকে একান্ত নিজের স্বামীরূপে বরণ করে আনন্দিতও হলেন। বিষ্ণুকে শান্ত হতে বললেন এবং তাদের দুজনের আশীর্বাদে লক্ষ্মী ও গঙ্গা মর্ত্যের ওপর দিয়ে নিজ নিজ গতিপথে বইতে লাগল। স্বর্গে তাদের দুজনার একটি করে শাখা বিষ্ণুর হাত ধরে রইল। তবে যাই বলো সেই বৈদিকযুগ থেকে আমি স্বীকৃতি পেয়ে আসছি সৌভাগ্য ও ঋদ্ধিদায়িনী দেবী রূপে।আমি যখন শুভদায়িনী তখন কল্যাণী বা পুণ্যলক্ষ্মী আর অশুভদায়িনী যখন তখন আমি অলক্ষ্মী। কেউ বলেন আমি মাদুর্গার কন্যা। কেউ বলেন আমি মায়ের অন্য একটি রূপ। মহাদেব নিজের দেহ থেকে সৃষ্টি করেছিলেন ঊমাকে এবং ঊমা পরে সৃষ্টি করেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা এবং কালীকে। শ্রী শ্রী চন্ডীতে দুর্গাদেবীকেই মহালক্ষ্মী রূপে আখ্যা দেওয়া হয়। বাঙালী কল্পনাপ্রবণ জাতি। সপরিবারে মা দুর্গাকে না দেখলে তাদের যে মন ভরেনা। তাই তো দুই শক্তি লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে দুপাশে আমরা দেখি এবং মহানন্দে বরণ করি। লক্ষ্মীদেবী হলেন বিষ্ণুপ্রিয়া বা নারায়ণী যিনি সৌভাগ্য, ঐশ্বর্য্য এবং সমৃদ্ধির প্রতীক আর সরস্বতী হলেন বাগদেবী, বিদ্যা-বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী, জ্ঞানদায়িনী। অর্থাৎ এই দুই নারীশক্তি সকল শুভ, সৃজনশীল, গঠনমূলক ক্রিয়াকলাপের উৎস। তাই শুভ শক্তির প্রতীকও বটে। আমার বাহন পেঁচা। তাই বলে ঐটুকুনি পেঁচার ওপরে আমি বসে থাকি আর সে আমাকে নিয়ে উড়ুক আর কি! এসব বাহন তত্ত্ব মনগড়া। লক্ষ্মীর বাহন নিশাচর পেঁচা। অন্ধকার যার আশ্রয়। লক্ষ্মী সৌভাগ্য-সমৃদ্ধির আলোর দিশা দেখান পেঁচাকে সাথে নিয়ে অর্থাত অন্ধকার ও আলোর মধ্য থেকে জীবজগত আলোর দিশা খুঁজে নেবে। কারণ জীবনে ঘাত-প্রতিঘাতের লড়াইতে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য উভয়ই থাকবে কিন্তু সব পরিস্থিতিতেই অবিচল থেকে আলোর পথ যাত্রী হয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলতে হবে। জাগতিক সত্ত্ব ও তমগুণের মধ্য থেকে সত্ত্বটুকুকে বেছে নিতে হবে। তাই বলে তমকে বাদ দিলেও বাদ দেওয়া যাবে না তাই এই নিশাচর। এত জ্ঞান দিলাম চিঠিতে কিন্তু কেউ কি জানবে আমার কথা?
ইতি আমি কোজাগরী
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।