রাজনীতিতে কুবাক্য লিখেছেন- মৃদুল শ্রীমানী
কুকথায় পঞ্চমুখ, কণ্ঠ ভরা বিষ
রাজনৈতিক দলের নেতা হতে হলে বহু কথাই বলতে হয়। গান্ধিজীকেও বলতে হয়েছিল। তখনকার কংগ্রেস দলের সভাপতি পদে নির্বাচনে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন পট্টভি সীতারামাইয়া। কিন্তু সুভাষ চন্দ্র বসু নির্বাচনে জয়ী হলে গান্ধিজী মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলেছিলেন, সীতারামাইয়ার পরাজয়, আমার পরাজয়। মুশকিল হল, গান্ধিজী নির্বাচনে দাঁড়ান নি। আর ভোট দিয়েছেন কংগ্রেসের সদস্যগণ। কংগ্রেসের সদস্যরা তখন আজকের মত একটি পরিবারের পদলেহী ছিলেন না। তাঁদের বিচারবোধ ও চিন্তাভাবনা করার যোগ্যতা এখনকার কংগ্রেসের কর্মীদের চাইতে বহু উচ্চস্তরের ছিল। যেখানে দলের সদস্যদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছে, সেখানে তাঁরা সেই অধিকার প্রয়োগের পর, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তকে মান্য করাই ভদ্র সভ্য রীতি। সেখানে গান্ধিজী যদি একপক্ষের পরাজয়কে নিজের পরাজয় মনে করেন, সেটা দুর্ভাগ্যজনক।
গান্ধিজী একবার সুভাষচন্দ্রের প্রতি রুষ্ট হয়ে তাঁকে “স্পয়েল্ট চাইল্ড” বলেছিলেন। সে কথাও খুব শ্রুতিসুখকর ছিল না।
জাপানে পৌঁছে রাসবিহারী বসুর হাত থেকে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠিত বাহিনীকে আরো সুসংহত করে গড়ে নিয়ে জাপানি রাষ্ট্রশক্তির সমর্থন নিয়ে সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। জাপান ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জার্মানি ও ইটালির সঙ্গে। জার্মানিতে নাৎসিদের অত্যাচারের বৃত্তান্ত যাঁরা জানেন, যাঁরা জানেন ইটালিতে ফ্যাসিস্টদের ভূমিকা, হিটলার ও মুসোলিনি কোনো গতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জয়ী পক্ষ হলে, কী সাংঘাতিক আঘাত সভ্যতার উপর নেমে আসত, কল্পনা করতেও ভয় পাবেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর অগ্রগমনে ক্রুদ্ধ হয়ে জওহরলাল নেহরুর তরফে “সুভাষ এদেশে এলে তাকে তরোয়াল দিয়ে আঘাত করব”, কথাটা বাঙালির প্রাণে বেশ ব্যথা দেয়। চিরকাল যাঁরা কংগ্রেসের প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন, সেই কমিউনিস্টগণ সেদিন জওহরলাল নেহরুর কথার সূত্র ধরে বলেছিলেন “সুভাষচন্দ্র এলে তাঁকে বুলেট দিয়ে অভ্যর্থনা করা হবে।” নেহরু ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের রুচি সুভাষ বিরোধিতায় এক হয়ে গিয়েছিল।
দেশের অঙ্গচ্ছেদ করে এল স্বাধীনতা। কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশ তাতে বলল, “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়”। এ দেশের স্বাধীনতার যতই সীমাবদ্ধতা থাক না কেন, এক কথায় তাকে পুরোপুরি “ঝুটা” বলে দেওয়া বেশ কানে বাজে।
স্বাধীন দেশের মানুষ মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। এক পয়সা ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে হিংস্র আন্দোলন গড়ে তুলে অনেক ট্রাম পোড়ানো হল। কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশের নেতা জ্যোতি বসু সরকারি অর্থে কেনা ট্রাম পোড়ানোকে সমর্থন করে বললেন, “এক পয়সা ভাড়াবৃদ্ধি বড় কথা নয়, পয়সা কার পকেট থেকে কার পকেটে যাচ্ছে, সেটা বড় ব্যাপার।” সরকারের পয়সা যে আসলে করদাতাদের কষ্টার্জিত টাকার সমাহার, তা কিন্তু বুঝতে খুব বেশি মেধাবী হতে হয় না। জ্যোতি বসুর মতো ব্যারিস্টার তা বুঝতেন না, এটা হতে পারে না।
জ্যোতি বসু মহাশয়ের দলের বড় নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত মনের কথা খুব খোলসা করে বলতে জানতেন। জনগণের বিক্ষোভ আন্দোলন দমাতে পুলিশের কী করণীয় তা প্রমোদবাবুবিলক্ষণ জানতেন। পুলিশ সর্বদা শাসকের কাজ উৎরে দেয়। প্রমোদ দাশগুপ্ত সেটা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের কর্ণধার হিসেবে ভালো করে জানতেন। তাই বিপক্ষের আন্দোলন দমাতে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গুলি ছোঁড়ে নি কেন, একথা জানতে চেয়ে তিনি বলে ছিলেন, পুলিশের বন্দুকে কি “নিরোধ” পরানো ছিল? নিরোধ শব্দের বড়ো আর্টিস্টিক এই উচ্চারণ। পুলিশের বন্দুক, আর জন্মনিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম হিসেবে নিরোধ, পড়ুন কনডোম, কী অসাধারণ বাচিক কুশলতায় মিলিয়ে ছিলেন প্রমোদবাবু। অনেক দিন পরে কাংলা দুর্গের সেনাবাহিনীর জওয়ানরা সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে মনোরমা থাংজামের যৌনাঙ্গের ভিতরে বুলেট পুরে দিয়ে, বন্দুক ও কনডোম বিষয়ে প্রমোদবাবু কথিত বাক্যটিকে বিশেষ মর্যাদা দেন।
ধর্ষণ করার ঘটনা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব কিভাবে ট্যাকল করবেন, তা অসাধারণ প্রতিভায় বলে গিয়েছেন, মহামান্য জ্যোতি বসু। অনিতা দেওয়ান গ্রামোন্নয়ন করার কাজে গিয়ে ধর্ষিত ও পরে নিহত হলে, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার আলো করে বসে জ্যোতি বসু বলেন, “এমনটা তো হয়েই থাকে।”
কুকথা উচ্চারণ করতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তত দক্ষ ছিলেন না। তিনি বিধানসভায় নিজের দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে মোহিত হয়ে থাকতেন। বিপক্ষের সামান্য সংখ্যক জনপ্রতিনিধিকে তাচ্ছিল্যভরে বলে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।
কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বকারী অংশের অন্যতম ছিলেন বিনয় কোঙার। মেধা পাটকর যখন সিঙ্গুর বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে দৌড় ঝাঁপ করছেন, তখন মেধা দেবীকে কমিউনিস্ট দলের মহিলা সদস্যরা কি উদ্ভট প্রকারে অভ্যর্থনা জানাবেন, কোঙার মহাশয় তা খোলসা করে বলেছিলেন। পাশ্চাত্যে প্রতিবাদ জানিয়ে তীব্র বিরক্তি জ্ঞাপনের একটি পদ্ধতি হল “মুনিং”। যে ব্যক্তিকে ধিক্কার জানানো হবে, তার দিকে পিছন ফিরে প্যান্ট নামিয়ে উন্মুক্ত নিতম্ব প্রদর্শন করার রীতি আছে কোথাও কোথাও। সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে ওই পাশ্চাত্য ধাঁচের প্রতিবাদ করার ঘোষণা করেন বিনয় কোঙার। তবে তা তাঁর দল প্রয়োগ করেন নি।
আরেক বিনয়বাবু, বিনয় চৌধুরী মহাশয় ছিলেন মন্ত্রীসভার রীতিমতো ওজনদার ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজের দলের পরিচালনাধীন সরকারকে প্রমোটারদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেখিয়ে মতপ্রকাশ করলে, দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
রাজনীতিতে কুবাক্য ও কুকথার সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।