অকস্মাৎ প্রভু নারায়ণের নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল ৷ তথাপি উঠিলেন না , অর্ধ উপবেশিত হইয়া দক্ষিণহস্ত কৌনিক করিয়া উহাতে মস্তক স্থাপন করিলেন এবং লক্ষ্মীদেবীকে ইশারা করিলেন ৷ লক্ষ্মীদেবী অতিব নম্রস্বভাবা হওয়াতে নারায়ণের এইরূপ ইশারার মর্ম বুঝিয়াও চুপ করিয়া তাঁহার পদদ্বয় মার্জনা করিতে আরম্ভ করিলেন ৷ মনে মনে গাল পাড়িয়া কহিলেন , ” হতচ্ছাড়া মিনসের আরামে আর পোষায় না, ইচ্ছা করে পা নয় , গলা টিপে নিকেষ করি ৷” নারায়ণ এইসবের কিছুই শুনিতে পারিলেন না , তাঁহার দুই কর্ণে লক্ষ কোটি সকাতর প্রার্থনা একত্রে প্রবেশ করিতেছে , ফলস্বরূপ তাঁহার মস্তকে সহস্রাধিক হস্তি পদচারণা করিতেছে বলিয়া বোধ হইতেছে ৷ প্রভু বুঝিলেন বঙ্গবাসীর অতিরিক্ত আহ্বান বৈকুণ্ঠের সমস্ত শব্দনিরোধক অদৃশ্য সুরক্ষাজালিকা ছিন্ন করিয়াছে ! অর্ধ সহস্রবৎরের নিদ্রা অতিকষ্টে দূরীভূত করিয়া গোলকপতি উঠিয়া বসিলেন ৷ মাত্র কয়েক পলের জাগরণ তাহার চক্ষুদ্বয়ের নীচে কালিমা লেপিয়া দিয়াছে ৷ প্রভু আরক্ত চক্ষে স্ত্রীর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কাতর কণ্ঠে কহিলেন , ” দেবী নারদ ব্যাটাকে খবর দাও ৷ আর আসার সময় যেন পৃথিবীতে থেমে ওই ডালগোনা না চালগোনা কী একটা কফি বেরিয়েছে , তার একটা যেন নিয়ে আসে ৷” লক্ষ্মীদেবী তাঁহার শঙ্খটি তুলিয়া মৃদু বায়ুক্ষেপণ করিলেন ৷
গোলকপতি অনন্ত শয্যায় বসিয়া তাঁহার অনিন্দ্যসুন্দর চরণ দুইখানি দুলাইতে লাগিলেন ৷ দেবাদিদেব শিব পৃথিবীতে সংহার কার্য করিতেছেন ৷ করোনা নামক এক অতিক্ষুদ্র অদৃশ্য জীব খুঁজিয়া খুঁজিয়া মানুষ ধরিতেছে ৷ অসুস্থ, অশক্ত, প্রতিরোধহীন মনুষ্য দেখিলেই করোনা মুখগহ্বর, নাসিকা এবং চক্ষুদ্বয়ের মধ্য দিয়া মনুষ্যশরীরে প্রবেশ করিতেছে এবং মাত্র এক পক্ষকালের ভিতর শমনভবনে প্রেরণ করিতেছে ৷ কৃতান্ত ইতিমধ্যেই কর্মাবকাশ না পাইয়া কৃশকায় এবং মসীবর্ণ ধারণ করিয়াছেন ৷ সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী, সরোবরে গাত্র প্রক্ষালণকালে আপনার ছায়াকে চামচিকা ভাবিয়া সরোবরের জলে দাপাইয়া লাফাইয়া তাবৎ যমপুরীর শান্তিভঙ্গ করিয়াছেন ৷ নিদ্রাকালেও কী শান্তি আছে ! সমস্ত ঘটনাই নারায়ণ দিব্যদৃষ্টিতে দেখিতে পারেন ৷ শিবের সংহারপর্বের শেষলগ্নে নারায়ণের পুনরায় জগৎ- পালক রূপে আসিবার কথা, তাহার পূর্বেই নিদ্রাভঙ্গ হইয়া একী বিপদ ! এমন সময় নারদ প্রবেশ করিলেন ৷ হস্তে স্বচ্ছ স্ফটিক পাত্রে ডালগোনা কফি ৷
অতঃপর নারদ সংবাদ প্রত্যার্পণ প্রারম্ভ করিল ৷ প্রভু, করোনা-প্লাবিত বঙ্গদেশে এক অসহ্য অবস্থা উপস্থিত ৷ ঘরবন্দী নারী- পুরুষ উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন কারণে আপনাকে স্মরণ করিতেছে ৷ উহাদিগের কষ্টের সীমা অসীম-অনন্ত !
নারায়ণ চক্ষু মুদিয়া অনাস্বাদিতপূর্ব কফির স্বাদ গ্রহন করিতেছিলেন , তিনি কহিলেন, “খামোখা প্রিলুড শুরু করলে কেন ? বিষয়ে এস ৷”
নারদ স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছেন বাঙ্গালীজাতি এক্ষণে আপন আপন বাটিতে একপ্রকার বন্দীদশা কাটাইতেছে ৷ স্বামী-স্ত্রী অথবা মাতা-পুত্র যাহারা এতকাল স্বীয় স্বীয় দোষাবলী লুকাইয়া রাখিতে সক্ষম হইয়াছিলেন তাহা এখন গ্রীষ্মকালীন তপনতাপের ন্যায় প্রকাশ পাইতেছে ৷ গৃহস্বামীর আপন কর্ম ভার লাঘব হওয়ার দরুণ প্রভাত হইতেই গৃহিণীর কার্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড রাখিতেছেন এবং সুযোগ পাইলেই বার্তাকুর খোসাবাটা, কুষ্মাণ্ড রন্ধণপ্রণালী , আলুপোস্তর উপকারীতা বিষয়ক রচনা বলিতেছেন ; তৈজসপত্রাদি মার্জনার খুঁত ধরিতেছেন ৷ সময়বিশেষে আপন মাতার কার্যকলাপ দেখিয়া তাহাকে বয়সোচিত আচরণের বিবিধ উপদেশ বর্ষন করিতেছেন ; পিতা দিবসব্যাপী শয্যা আশ্রয় করিয়া ঘর পূতিগন্ধময় করিয়া তুলিতেছেন দেখিয়া বিবমিষা দমন করিতেছেন ! এতকাল যে পুত্রটিকে মণিরত্নের ন্যায় মস্তকোপরি ধারণ করিয়াছিলেন তাহার স্বরূপ দেখিয়া মূর্চ্ছাপ্রাপ্ত হইতেছেন ! পুত্র পিতার আড়ালে আবডালে যাইয়া তাম্রকূট সেবন করিতেছে এবং প্রতিবেশিনীর সহিত স্বল্পদৈর্ঘের বাতায়ন প্রেমের বৃথা চেষ্টা করিতেছে ! কন্যাগুলিরও সঙ্গীন দশা ! নখরঞ্জনীর অপ্রতুলতা উহাদিগের হৃদয় আকুল করিয়াছে ! ভ্রু এবং মুখমন্ডল রোমরাজিতে পরিপূর্ণ হইয়াছে ৷ কপির সহিত এইরূপ সাদৃশ্য ডারউইন সাহেবের তত্ত্বই যেন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিতেছে ! অচিরেই ‘সন্তান ঈশ্বরের দান নহে’ এই মর্মে পুস্তিকা প্রকাশ পাইবে ৷ গৃহকর্তা সবিশেষ হতাশ হইয়া অবশেষে গৃহিণীর বিপুল কেশরাশির আবডালে লুক্বায়িত উৎকুণ খুঁজিতে মনস্থ করিয়াছেন !
নারদ !
প্রভু তিষ্ঠ ! সংবাদ সম্পূর্ণ হয় নাই ৷ উক্ত বাঙ্গালী জাতি প্রভাতকালে সংবাদপত্র পাঠ সম্পন্ন করিয়া করোনাঘাতে মৃতব্যাক্তির আত্মার শান্তি কামনা এবং তাহাদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছে ; দূরাভাষে সখা, সম্বন্ধীর সহিত রোগীর পরিসংখ্যান এবং সরকারের অপদার্থতার ব্যাখ্যান করিয়া কালাতিপাত করিতেছে ; দ্বিপ্রহরে জগৎসংসার ভুলিয়া সুপক্ক রোহিত মৎস্য সহযোগে কিঞ্চিৎ অন্নগ্রহন করিয়া নিদ্রা যাইতেছে ….সন্ধ্যাকালে পুরুষশ্রেনীয়রা একত্রিত হইয়া নানাপ্রকার ক্রীড়ায় আপন অপন মনোরঞ্জন করিতেছে ৷ সুরার অভাবে প্রবল দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ইহারা ক্রমাগত ‘চা’ নামক পানীয় গলধঃকরণ করিতেছেন ৷
নারদ , ” পয়েন্টে এস বাছা ! তাহলে ডাকছে কারা ? এত গোল কিসের ? এরা তো সুখেই আছে ৷” নারায়ণ জিজ্ঞাসিলেন ৷
নারদ কহিলেন, ” প্রভু, পরিসংখ্যানও সেকথাই বলছে ৷ জনগন খোশ মেজাজেই ৷ সব বিরোধী দলের চক্রান্ত ৷ তবু আপনি চাইলে আর একবার ঢেঁকি চড়াই যায় ৷”
“তবে এস ৷ আর এবার অন্দরমহলে না ঢুকে একটু রাস্তাঘাটে ঘোরো ৷ লকডাউন উঠল বলে ৷” কহিয়া জগৎপতি পুনরায় অনন্ত শয্যায় চক্ষু মুদিলেন ৷ দেবী লক্ষী পদতলে বসিয়া অঞ্চলের বাতাস দিতে থাকিলেন ৷ অনতিবিলম্বেই তাঁহার নাসিকাগর্জনে বৈকুণ্ঠলোক কম্পিত হইতে লাগিল ৷ দেবী সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া কৈলাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিলেন , সন্তানদিগের ক্লেশ মাতার অসহ্য বোধ হইতেছে , এক্ষণে শিবশম্ভুই একমাত্র ভরসা ! নীলকণ্ঠ ব্যতীত পৃথিবীর গরল ধারণের ক্ষমতা ত্রিভুবনে আর কাহারো নাই ! রাখিলে উনিই রাখিবেন ৷