“রথযাত্রা Special” গল্পকথায় অনিন্দিতা সেন

পদ পল্লব মুদারম

আহীর ভৈরবের মৃদু তান। ভাল করে আলো ফোটেনি তখনো। পাখিদের কলকাকলির মাঝে আধো আঁধারে গুপ্ত প্রকোষ্ঠের দ্বার…ধীরে ধীরে খুলে গেল। মৃদু পায়ে বেরিয়ে এসে মাথায় বড় করে আঁচল টেনে নিলেন শশীমনি। অন্ধকার ময় গলিপথ ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে ভুগর্ভস্থ গঙ্গা ও সরস্বতীর প্রবাহে গা ভাসিয়ে নিজেকে শুদ্ধ করে নিলেন তিনি। মনে হয় যেন কত জন্মের পাপ ধুয়ে ফেলছেন শরীর থেকে! পিতলের বড় বড় মশালের আলোয় পথ। ফিরে এসে বিগ্রহের সামনে ভক্তিতে লুটিয়ে পড়লেন। অনতিদূরে মৃদুকন্ঠে শোনা যায় মঙ্গলাচরণ…শ্রী জগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে রচিত মঙ্গলারতির বোল।
তা ধেৎ তা… ধেৎ তা… ধেৎ ধেৎ তা…!
মোহাবিষ্টের মত ঘুঙুর বেঁধে নিলেন পায়ে। ঘরে ফিরে সামান্য শৃঙ্গার… মেতে উঠলেন মহাপ্রভুর সামনে আনন্দদায়িনী নৃত্যে…
দেহী পদ পল্লব মুদারম
রোচয় মানম্ ভঞ্জন কারী
তব ঘন সুন্দর শ্যাম…
দেহী পদ পল্লব মুদারম…!
স্নান পথ ঘিরি শত রক্ষা করি
রখিল ভক্তোরো মান
নিজ হাতো প্রভু লিখনি ধরিলো
হইলো পাদ পুরানো
হে মুক্তিময়ো পূর্ন পুন্য ময়ো
দিবানিশি মুঞ্জরো রূপম্
দেহী পদ পল্লব মুদারম্…!
নাচতে নাচতে মুর্ছিত প্রায় অন্তরের গভীর থেকে কিসের যেন ডাক শুনতে পান। সেই ডাক ধেয়ে যায় পাথরের সিঁড়ি…সুবিশাল কক্ষ…সোনার বিগ্রহ…রত্নখচিত মুকুটে…ঘিয়ের প্রদীপ এর শিখা পেরিয়ে অনেক দূ..রে!
## ## ## ##
ওড়িশার পঞ্চচৌরা গ্রামে বহুদিন আগে ছেড়ে আসা একটি হত দরিদ্র পরিবার।ফোটা ফুলের মত সদ্য কিশোরী মেয়েটি হারিয়ে গেল হঠাৎ। হারিয়ে গেল চেনা জানা পরিবেশ, সবুজ ঘাস…স্বচ্ছন্দ বাতাস…কুন্দফুলের আঘ্রান … মেঘের রাজ্যের অনাবিল আনন্দ মেলা। অচেনা পরিবেশ, পূজার্চিত দেবদাসি, প্রভু জগন্নাথের বালিকা সহধর্মিনী রূপে অভ্যস্ত হতে না হতেই সে নাড়ি কাটা নারী। সন্তান ধারনে অক্ষম নারীটি তখন সংগীত নৃত্য কলা নিপূনা ও মন্দির বারাঙ্গনা। কিছু রাজা, মহারাজা ও প্রধান পুরোহিতের ধর্মীয় গণিকা।
হায়… শ্যাম রে…
নিপট কঠিন মন তোর
বিরহ সাথী করি সজনী রাধা
রজনী করত হি ভোর।
একলি নিরল বিরল পর বৈঠত
নিরখত যমুনা পানে,
বরখত অশ্রু, বচন নহি নিকসত,
পরান থেহ না মানে।
কৈস মিটাওসি প্রেম পিপাসা
কঁহা বজাওসি বাঁশি
পীতবাস তুঁহু কথি রে ছোড় লি
কথি সে বঙ্কিম হাসি?
বিকিয়ে যায় তার শরীর…যে কোন মূল্যে… কিন্তু মন… সে যে বাঁধা পড়ে গেল মহাপ্রভুর শ্রীচরণে।
## ## ## ##
সত্য যুগের ওড়িশা তখন মালবদেশ। অবন্তী নগরের সূর্য্য বংশীয় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদেশ পেলেন ভগবান বিষ্ণুর জগন্নাথ রূপী বামন মুর্ত্তির রথযাত্রা করার। তিন ভাইবোন যথাক্রমে বলভদ্র, সুভদ্রা ও ভগবান শ্রী কৃষ্ণের বর্নাঢ্য রথের মনোরম শোভাযাত্রা। রথগুলি যথাক্রমে তালধ্বজ, দর্প দলন ও নন্দীঘোষ। বিভিন্ন রঙের সুবিশাল অপূর্ব তিনটি রথ। প্রতিটি রথের মাথা কিন্তু টকটকে রক্তবর্ণ। মহারাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুভক্ত হলেও কালের পরিক্রমায় হিন্দু সভ্যতার উত্থান কালে এই রথ যাত্রার মূলে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব। কালে কালে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা জ্যৈষ্ঠে ও আষাঢ়ে বিশেষ সমাদৃত হল।
## ## ## ##
জগন্নাথদেবের বামন মূর্তিই তাঁর স্বামী। মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন শশীমনি। ইহজগতের আর সব কিছুই তুচ্ছ। বিভোর হয়ে নাচেন…
জগন্নাথো স্বামী…নয়নো পথ গা…মী…ভবতু রে…
ধেৎ ধেৎ তানানা…তানা নানা নানা
তাধেৎ তাধেৎ তা!
পরিবার পরিজন হীন নির্বান্ধব পুরীতে প্রতিদিন পালন করেন সাবিত্রী ব্রত। নবকলেবর ও নন্দ উৎসবে নৃত্য গীত পরিবেশন…আষ্টে পৃষ্টে ছড়িয়ে পড়ল জীবনে।
রথযাত্রা সম্পূর্ণ হয়না দেবদাসীর নৃত্য ছাড়া। গড়গড় করে এগিয়ে চলে রথ, রথের সামনে সজ্জিত কাঠের উঁচু বেদীতে নৃত্যবিভোর শশীমনি। রথের রশি ধরে ভক্তবৃন্দের আকূল প্রার্থনা। রথারূর বামন সদৃশ ভগবান শ্রী জগন্নাথ দেব দর্শন। “আর যেন পুনর্জন্ম নাহয় ভগবান” ভক্তদের আকূল প্রার্থনা স্পর্শ করে শ্রী ক্ষেত্রের সমুদ্রের লোনা বাতাস। মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেবের জীবন দর্শন একাকার হয়ে মিলে যায় শ্রী জগন্নাথের চরণে।
## ## ## ##
অবশেষে সমাপ্ত হল যেন এক অবিনশ্বর অধ্যায়। নবকলেবর অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর আগেই তাঁর মৃত্যু। ভগবানের স্ত্রী তিনি…তাই কোন ডেথ সার্টিফিকেট ও নেই। প্রতিটি কালের যাত্রার দিনে ঝুল পড়া সাদা কালো ছবিটি তাই… যেন বড় বাঙ্ময়।
একলি যাওব তুঝ অভিসারে
যাক পিয়া তুঁহু কি ভয় তাহারে
ভয় বাধা সব অভয় মুরতি ধরি
পন্থ দিখাওব মোর।
দিবস ফুরাওল, অবহুঁ মো যাওব
সব কিছু টুটাইব বাধা,
মাধব পহুঁ মম, পিয়োসো মরণ সে
অব তুঁহু দেখ বিচারি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।