মেহফিল -এ- কিসসা কবিতা: ডিসেকশন ও আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ শাপলা সপর্যিতা

পেশা শিক্ষকতা। অরণী বিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য ও সৃজনশীল লেখা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত হয়েছে এই পৃথিবী এই দেশ ও নিভৃত পরবাস নামে দুটি কবিতার বই। টাইমমেশিন ও গুপ্তহত্যা অতঃপর নামে দুটি বড় গল্পের বই। মূলত উপন্যাস লিখছেন। বর্তমানে ‘সম্পর্কটি শুধুই জৈবিক’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন। ঢাকায় বসবাস করেন।

কবিতাঃ ডিসেকশন ও আবৃত্তি যোগ্য নির্মাণ

পর্ব – ৮

যে যায় সে দীর্ঘ যায় (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) যে যায় সে দীর্ঘ যায় – কবিতাটি এক দীর্ঘতম দূরত্ব অতিক্রম করবার গল্প। অদ্ভুত কোনো এক বাঁধনে দারুণ প্রেমে নিদারুণ শাসনে দুঃসহ বিরহে প্রজ্জ্বলিত ঐশ্বর্যে এবং বিস্তৃত ও দূরহ দৈন্যে দীর্ঘ, দীর্ঘ যে জীবনের স্থিতি যে জীবনের স্তুতি আর তারপর বিষন্ন নির্মোহ এক নিবিঢ় বিচ্ছেদী দীর্ঘতর জীবন এ কবিতাটি ঠিক তার এক অদ্ভুত রূপায়ণ। অদ্ভুত বলছি এ কারণে ঠিক এভাবে বিরহ একাকীত্ব এভাবে জীবন আর মৃত্যুর সংলগ্ন সময় এবং অবসানকে লেখা হয়নি তার অন্য কোনো কবিতায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরই অন্যান্য আরো অনেক কবিতায় বিরহ কিংবা একাকীত্বের বিয়োগের কিংবা ব্যথার দারুণ দারুণ সব মনোসংলগ্ন আবেদন রয়েছে। কিন্তু এর বর্ণনা অন্যরকম। অন্য আমেজে। অন্য ধারায়। আজ যদিও বা এমন গুছিয়ে বলা সম্ভব হচ্ছে তখন কিন্তু অতটা সহজ ছিলনা যখন এ কবিতাটি আমি মঞ্চে আবৃত্তি করবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকি তখন বয়স বড়জোর ২২। কবিতাটি বুঝবার জন্য সেই বয়স আদৌ সক্ষম নয়, এখন বুঝতে পারি সেটা। কিন্তু তখন সেই বোধটাও প্রাজ্ঞ ছিলনা। ‘পদ্য বাউল’ প্রযোজনাটির গ্রন্থনাকার ইশরাত নিশাত কিংবা পরিচালক আবৃত্তিকার মাসুদুজ্জামান-দুজনের কেউ একজন ঠিক করেছিলেন আমাকে দিয়ে কবিতাটি পড়াবেন। আমার হাস্কি ভয়েজ কতটা যাবে এর সাথে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি সেই প্রত্যুষে, এটা ঠিক। কিন্তু…, কিন্তু কবিতাটি আমার ভালো লেগে যায়।কবিতাটি পড়লেই বোঝা যাবে এখানে ভালো লাগবার কিছু নেই। ‘যম’ কবিতাটিতে যে অসাধারণ এক রহস্য গভীর দীর্ঘ আর ক্ষিপ্র শব্দগুলো কেবলই জটাজট খুলবার হাতছানি দেয়। এখানে তেমন নয়। খুব সাধারণ শব্দ। সাধারণ ভাষা। সহজ বাক্য। প্রত্যন্ত এখানকার ভাষাভঙ্গী। খুব একটা উপমা নেই। নেই তেমন বিস্তৃত কোনো চিত্রকল্পও। ভিজু্য়ালাইজ করবার মতো তেমন বিশদ ব্যাখ্যাও নেই কোথাও। আপতদৃষ্টে মনে হয় নেই কোনো প্রেম কিংবা বিরহ যা সাধারণে আকৃষ্ট করবে তবু কেন যে একজন দীর্ঘ লোক আমাকে ক্রমাগত আকৃষ্ট করে। কে সে দীর্ঘ লোক! তার দৈর্ঘেরও পরিমাপ আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে ক্রমাগত। আমি সাধারণত ভালো না লাগলে কোনো কবিতা নির্মাণ করিনা। সে আমার নিজের জন্য হোক কিংবা মঞ্চে আবৃত্তি করবার জন্য হোক। যখনই ভাবছি কবিতাটি আমি আবৃত্তি করবো। প্রথম চার থেকে দশবার পরবার পর একটা বিষয়ই মাথায় প্রখরতর গভীরতায় ঢুকে যেতে থাকে। এই চমকবিহীন শব্দে শব্দে শ্রোতাকে কতটা ধরে রাখা সম্ভব। কোথায় করবো কাজ! কোথায় লুকোনো রয়েছে এর প্রাণ। দূরহ..কঠিণ এক সংকটের মুখোমুখি হতে হয় তখন আমার। প্রথম দুটো লাইনে কেবল এক দৃশ্যকল্প। আর সেটাই আমাকে প্রলুব্ধ করতে থাকে। পড়তে থাকি..পড়তেই থাকি…পড়তেই থাকি। জীবন এবং মৃত্যুর দৈর্ঘে একজন মানুষ খুঁজে পাই সেদিন। তাকেই তুলে আনতে চেষ্টা করি প্রাণপণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের ৫০৯ নম্বর রূমের সব রুমমেট যখন রুমের বাইরে তখন আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই। ২০ বারের মতো পড়বার পর কবিতার প্রথম ৪টি লাইন এমনিই মুখস্ত হয়ে যায়। আর বলতে থাকি ‘একজন দীর্ঘ লোক….. একজ..ন দী…র্ঘ লোক। একজন…দীর্ঘ লোক। কোন জায়গা থেকে উচ্চারণ করবো প্রথম শব্দ, কী প্রজেকশন হবে এর। এত গভীর এত ব্যপক শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়ে কোনোভাবেই নিজের কানে ভালো লাগেনা। বুঝতে পারিনা কী সব হচ্ছে!তারপর হঠাৎ খুব জেঁকে বসে যায় প্রখরতর গভীরতায়। ঠিক করি কবিতাটি ঠিক যেমন প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ শব্দে লেখা ঠিক তেমনি খুব সাধারণ হবে এর প্রথম উচ্চারণ
একজন দীর্ঘ লোক সামনে থেকে চলে গেল দূরে
দিগন্তের দিকে মুখ, পিছনে প্রসিদ্ধ বটচ্ছায়া
মানুষের বয়স হয়। জীবনের ভার কমে আসে। নিজেরই দেহের ভার তখন পর্যাপ্ত মনে হয়। সম্পর্কগুলো আলগা হয়, দূর দূর হয় সব যখন সেই সময়ের এক করুণ চিত্র এখানে। যখন কেবল মৃত্যুরই অপেক্ষা। যাপিত জীবনের বেঁচে থাকার স্বপ্ন বোনা হয় কত শত। এই স্বপ্নই জ্বালিয়ে রাখে আলো। নিয়ে চলে সামনে। তারপর স্বপ্নের অবসান। জীবনের অবসান। একটা স্থির নির্দিষ্ট প্রশস্ত বাসস্থান। যেন গাছের এক গভীর শেকড়ে বসে থাকে মানুষ। সেখানে এক গভীর নিরবতা। একাকী। নিঃসঙ্গ। নিঃশঙ্ক তখন চিত্ত। এখানে আর কোনো স্বপ্ন নেই। কোনো প্রত্যাশার হাতছানি নেই। সব ধুলো সব মায়া। নিশ্চল সেই জীবনই মানুষের চিরকালের বর্তমান। সেই মৃত্যু পরের ছায়াছবি যা তার অসংখ্য কবিতায় নানা ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। এখানেও সেই একই কথা। ভিন্ন আঙ্গিকে আর একেবারে বিপ্রতীপ ধারায়।
বিষয়ের ব্যাখ্যায় আজ কমই যেতে চাই বরং কবিতাটির নির্মাণের প্রসঙ্গেই বেশি থাকতে চাই। পরিচালক নির্মাণের কঠিন এক ধ্যাণের মধ্যে এখানে এনে দাঁড় করালেন আমাকে এবং ‘পদ্য বাউল’ প্রযোজনার আর সকলকে। সাধারণত আমাদেরকে নানা পঙক্তি নানাভাবে পড়বার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো অন্যান্য সব প্রযোজনাতে। কিন্তু এখানে তা নয়। প্রত্যেকের পড়বার ভঙ্গী তার তার খুঁজে বের করতে হবে। তাই এখানেই সবচেয়ে শ্রমসাধ্য কাজগুলো করতে হলো। একটিই কবিতা শত শতবার পড়েছি তখন। তারপর সহজ হয়ে এলো জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানের পরিমাপটি। যে হ্রস্ব একটি ধারায় শুরু হয় তারপর চলতে চলতে দিগন্তের কাছাকাছি পড়ন্ত সূর্যের বয়সী হয়ে ওঠে জীবনের দৈর্ঘ সে জীবনেরই গল্প এখানে। এখানে আমার গল্প এখানে আমার বাবার গল্প এখানে আমার দাদা এবং পূর্বাপর সমগ্র মানব জীবনের শুরু আর শেষের কাহিনি কেবল নয়। শিকড় মানুষ এবং মহিষ কেবলমাত্র এ তিনটি শব্দের মধ্যে দিয়েই সমস্ত প্রাণি জগতের বিপুল জীবন প্রবাহের স্রোতটিকে দুটি মাত্র পঙক্তিতে বিন্যস্ত করতে দারুণভাবে সমর্থ হয়েছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এটা আমার মত। কারণ ওই বয়সে অন্তত এইটুকু আমি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম। আর বুঝতে পারার সাথে সাথে এর নির্মাণ ও উপস্থাপন আমার কাছে সহজতর হয়ে উঠেছিল।
আজকের কথা যদি বলি – বয়সের সাথে সাথে বোধের ব্যাপ্তি অসীমে চলে। তখন ধীরে ধীরে খুলে যায় অনেক অনেক অস্পষ্টতার দেয়াল। তাই আজ এত বছর পরেও যখন কবিতাটি পড়তে বসেছি তখনও তার স্বাদ অদ্ভুত এক মাদকতা তৈরী করছে যা কেবল আমিই এই লেখা লিখতে বসে অনুধাবন করতে পারছি। আমার কাছে মনে হয় এই হল আবৃত্তির জন্য নির্মাণ যোগ্য কবিতার সক্ষমতা। সব কবিতা আবৃত্তির যোগ্য নয় যেমন তেমনি সব আবৃত্তিও কবিতার যোগ্যতাকে ধারণ করতে পারেনা। কোনো কোনো আবৃত্তিও কবিতার যোগ্যতাকে হরণ করে আমি এও মানি। কিন্তু আজ জীবনের জটিল গভীর প্রখর ক্ষরণ দহন একাকীত্ব আর যাতনার সফল যাপনের পর কবিতাটিকে আমার এতটাই সহজবোধ্য মনে হয় যেমন ভোরবেলায় ঘর থেকে বাইরে পা ফেললেই শিশিরে ভিজে যায় পা…যদিও তখনো কবিতাটির মঞ্চায়নে শ্রোতা ভর্তি অডিটরিয়মে ছিল পিনপতন নিস্তব্ধতা। পরবর্তী সময়ে স্রোত আবৃত্তি সংসদের আর এক আবৃত্তিকার সানজিদা সোহেলীও কবিতাটি পড়েছিলেন। তার আবৃত্তিও যথারীতি শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল। পর্বর্তীতে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের আমন্ত্রণে ‘পদ্য বাউল’ প্রযোজনার কিছু অংশ আমরা মঞ্চস্থ করেছিলাম…
একজন দীর্ঘ লোক সামনে থেকে চলে গেল দূরে-
দিগন্তের দিকে মুখ, পিছনে প্রসিদ্ধ বটচ্ছায়া
কে জানে কোথায় যাবে-কোথা থেকে এসেছে দৈবাৎ-ই
এসেছে বলেই গেলো, না এলে যেতো না দূরে আজ!
সমস্ত মানুষ, শুধু আসে বলে, যেতে চায় ফিরে।
মানুষের মধ্যে আলো, মানুষেরই ভূমধ্য তিমিরে লুকোতে চেয়েছে বলে
আরও দীপ্যমান হয়ে ওঠে-আশা দেয়, ভাষা দেয়, অধিকন্তু, স্বপ্ন দেয় ঘোর
যে যায় সে দীর্ঘ যায়,
থাকা মানে সীমাবদ্ধ থাকা
একটা উদাত্ত মাঠে, শিকড়ে কি বসেছে মানুষ-ই?
তখন নিশ্চিত একা, তার থাকা-তার বর্তমানে,
স্বপ্নহীন, ঘুমহীন-ধুলাধুম তাকে নাহি টানে।
একজন দীর্ঘ লোক সামনে থেকে চলে গেলো দূরে-
এভাবেই যেতে হয়, যেতে পারে মানুষ, মহিষ!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।