• Uncategorized
  • 0

শিকড়ের সন্ধানেতে আজ “ব্যালেন্সিং রক : মামা-ভাগ্নে পাহাড়” – লিখেছেন রাজদীপ ভট্টাচার্য্য

রাবণ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের পর্যুদস্ত করে সীতাকে উদ্ধার করে আনাই তখন রামের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু লঙ্কায় পৌঁছানোর পথে প্রধান বাধা বিস্তৃত সমুদ্র। অতঃপর রামচন্দ্র স্থির করলেন পাথর, মাটি ফেলে ভারত বর্ষ থেকে লঙ্কা পর্যন্ত একটি সেতু রচনা করবেন। বানর সেনারা লেগে পড়ল কাজে। স্বয়ং রাম তাঁর আকাশপথে চলমান রথে চড়ে হিমালয় পর্বত থেকে বড় বড় পাথরের চাঁই বয়ে আনতে শুরু করলেন। পাথর নিয়ে ফেরার পথে এক স্থানে রথের ঘোড়াগুলো কিঞ্চিৎ ভয়ে লাফিয়ে উঠলে রথ কাৎ হয়ে গেল। আর কিছু পাথর পড়ে গেল নিচে। সেইসব বিশাল বিশাল প্রস্তরখন্ড মিলেই তৈরি করল এই মামা-ভাগ্নে পাহাড়।

প্রাচীন এই লোকগাথা আমাদের নিয়ে যায় বাংলার পশ্চিমপ্রান্তে বীরভূম জেলার মামা-ভাগ্নে পাহাড়ে। দুবরাজপুর শহরের বুকে এ যেন এক ডিজনিল্যান্ড। বেশ খানিকটা অঞ্চল জুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় গ্রানাইট পাথরের বোল্ডার। তাদের মধ্যমণি খাড়া অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভারসাম্যের খেলা খেলতে খেলতে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি দীর্ঘ পাথরের চাঁই। তাদের মাথার উপরেও পাথরের বোল্ডার।
ভূগোলের ভাষায় এই প্রকার ভূমিরূপকে বলা হয় ‘টর’ (Tor)। গ্রানাইট অত্যন্ত কঠিন পাতালিক আগ্নেয় শিলা। ভূগর্ভে ধীরে ধীরে তরল উত্তপ্ত ম্যাগমা শীতল হয়ে গ্রানাইট শিলা গঠন করে। পরে হাজার হাজার বছর ধরে উপরের অন্য শিলাস্তর ক্ষয় পেয়ে গেলে গ্রানাইট ভু-পৃষ্ঠের ওপরে উঠে আসে। উপর থেকে চাপ কমে যাওয়ায় এই শিলা অনেক ফাটল ফেটে যায়। তখন এই ফাটল বরাবর শিলাস্তরে ক্ষয় ঘটতে থাকে আবহবিকার, ভৌম জলের ওঠানামা ইত্যাদির কারণে। একটু একটু করে ফাটল ক্রমশ চওড়া ও প্রসারিত হয়। অবশেষে পড়ে থাকে বড় বড় বোল্ডার, যারা অনেক সময় একে অপরের উপর অদ্ভুত ভারসাম্যে অবস্থান করে টর বা ব্যালেন্সিং রক সৃষ্টি করে। আমাদের দুবরাজপুরে মামা ভাগ্নে পাহাড় তাই একপ্রকার টর বা ব্যালান্সিং রক জাতীয় ভূমিরূপ। ভারতের জব্বলপুর, মহাবলীপুরম, মেঘালয় প্রভৃতি স্থানেও ব্যালেন্সিং রক দেখা যায়।

ভিন্ন মতে শোনা যায় মহাস্থপতি বিশ্বকর্মা একবার শিবের আদেশ পান, বীরভূমের এই স্থানে একদিনের মধ্যে দ্বিতীয় কাশী নগরী তৈরি করে দিতে হবে। দ্রুত প্রয়োজনীয় উপকরণ রূপে পাথর সংগ্রহ শুরু করেন তিনি। কিন্তু দেখতে দেখতে দিন কাবার হয়ে যায়। ফলে দুবরাজপুরের আর কাশী হয়ে ওঠা হয় না। বিশ্বকর্মা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যান। স্মৃতি স্বরূপ পড়ে থাকে শুধু পাথরের চাঁই।
শুনতে পাওয়া যায় মহাভারতের কালে ঘুরতে ঘুরতে পঞ্চপান্ডব এখানে এসেছিলেন। এখানেই যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ রূপে অভিষিক্ত করা হয়। তাইতো স্থানটির নাম হয় যুবরাজপুর এবং তা থেকেই পরবর্তীকালে দুবরাজপুর।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, মামা ভাগ্নে পাহাড়ের পটভূমিতে বীরভূমের বরেণ্য সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘অভিযান’ ১৯৬২ সালে মুক্তি পায়। আজও পাহাড়েশ্বর শিবমন্দির, শ্মশান কালীর স্থান – এ সবকিছু নিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকে ‘মামা-ভাগ্নে পাহাড়’।

(ছবি সংগৃহীত)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।